মধুবন্তী মা (একটি কাব্য কাহন) ড. রতন কুন্ডু
আমার দিদিমার নাম জানিনা কিংবা মনে নেই, ছেলেবেলায় সতর্কবার্তা- মায়ের নাম মুখে নিতে নেই! কবে সেই মায়ের মুখে শোনা নিমাই সন্ন্যাসের পালা! পুরুষ শাসিত সমাজে নারীর নাম ধাম- বিদ্যালয়ের কাঠের বোর্ডে- খড়িমাটির লিখার মতোই মুছে যায়। লুপ্ত প্রায় বিরল প্রজাতির মতো।
অপয়া মায়ের গর্ভে একে একে ছয়টি সন্তান! একটিও ছেলে নয়, ভয় হয় কবে যেনো পরিত্যক্তা হয়! ঘরের জলসায় মন্থরা ব্রজবালা- রসিয়ে রসিয়ে বলে বাজা মেয়ের চেয়ে কম কিসে! এতই বিয়ালি যখন, কেনো নয় একটি মরদ, একটি বকোন!
মায়ের চোখের জলে তুলসীতলা ভিজে যায়। আমার কি দোষ প্রভু? তুমি দয়াময়! অন্ন মাসি মাথায় হাত বুলায়- মা ললিতা তোর বাবা আদরে সোহাগে মেয়েদের নাম রেখেছিলো অম্বিকা, রাধিকা, ললিতা, বিশাখা, মল্লিকা আর চম্পকা।
চোখের নোনা জলে বন্ধ্যা মাটি উর্বর হয়না, পারেনা মৃতপ্রায় তুলসীকে জীবন দিতে। কোনদিন ফুলবতী আর ফলবতী হতে। তিন প্রহর চোখের জল নয়, প্রার্থনার জল দে। দেখবি কদিনেই শুকনো ডানারা পাতা মেলে দেবে! তাবিজ কবচ তো অনেক করলি, কি পেলি? প্রণয় পুরাণ পুরনো হয়ে গেছে। এবার সকাতরে প্রাণভরে জীবনের গান গেয়ে নে।
প্রলম্বিত দুঃখ নিয়ে মা আমার নির্বিকার- ব্যাকরণের “কাক বন্ধ্যা” বিশেষণের অর্থ খোঁজে, মুখ গোঁজে শাড়ির আঁচলে-হে প্রভু দয়াময় আমাকে একটি ছেলে সন্তান দাও। বাও বাতাস দুষ্টগ্রহ বশ করে, মন্দ বিশেষণ থেকে কাঙ্ক্ষিত সেই শোভন শালীন ভোর এনে দাও।
একদিন কাক-ডাকা সকালের রোদ সরিয়ে, গ্রাম পেড়িয়ে যশোদা পিসি পা রাখে নারীর উঠোনে ললিতা ও ললিতা একবার বেড়িয়ে আয় শুনে যা, কি দেখেছি কাল ভোর রাতে আধো জাগরণে! জানিস তো ভোরের স্বপ্ন ফলে যায় অবলীলায়।
আদুল তনু, অগোছালো মন আর নিষ্প্রাণ আঁখি, এক-বুক পাথর নিয়ে ললিতা তাকায়- কও পিসি দিবানিশি যন্ত্রণা আর যে সয়না। কবে বিধাতা হবেন সহায়, কবে হবে চিরতরে একেবারে আমার বিদায়!
যশোদা জিভ কাটে, বালাই ষাট! আমার খুকি, ও কথা মুখে আনিসনা। জানিস, কাল মহাদেব এসেছিলেন, বলেছেন আমি যাচ্ছি কৈলাসে। অনায়াসে বছর না ঘুরতেই আসবো আবার ফিরে ললিতার কোল জুড়ে। ওঁকে বিলাপ করতে বারণ করে দে।
ললিতা শেষ বারের মতো পোয়াতি হয়। ভয় হয় এবারেও বুঝিবা কন্যা সন্তানই হয়! ধ্রুপদী প্রার্থনা, চাপা চাপা কান্না, প্রলম্বিত কষ্ট ভ্রূণের অস্তিত্ব, উদরের ওম, নরোম নরোম অনুভব, উপমিত অষ্টপ্রহর! অদেখা শহর! আর অপেক্ষার বন্দরে- অভিলাষী নাওয়ের বহর!
দিনশেষে অবশেষে প্রতীক্ষার প্রহর ঠেলে, হেসে খেলে অনিন্দ্য সুন্দর! ওয়াও ওয়াও চিৎকারে অনুপম অভিষেক! এওঁদের পাঁচ জাক জোকার, একাকার হয় পরম মায়ায়। সাত নড়ি বন্ধনের ছেদ। চম্পকা মাসির খিল খিল হাসি বেজে ওঠে শাখা, ললিতার চোখে প্রশ্ন- কি হয়েছে চম্পকা?
এখনো বুঝতে পারছিসনা? শুনিসনি পাঁচ জাক জোকার? ছেলে হয়েছে গো ছেলে! তুমি এবার পুত্রবতী হলে। ললিতা মাথা তোলে, বিহ্বলে সন্তানের মুখ দেখে। অভিষিক্ত করে চোখের জলে। হৃদয়ের অতল তলে। মোহনীয় মায়াময় আধো বোজা চোখে, যেন তারই চোখে চোখ রেখে বলে এসে গেছি আমি এইতো এখন, কাঙ্ক্ষিত শরণে।
যশোদা পিসি বলে গেছেন, নিয়তির বচন, ছেলে হলে নাম রেখো নীল রতন।
ম্যাক্সিম গোর্কির মায়ের চেয়েও মাতৃময়, অথচ অসহায়, পুরুষ শাসিত ভাগাড়ের এক কোনায়- আগলে রাখে মায়াময় বুকের লোহার বাসরে, আমার সোনা চাঁন পাখি, নিরুপম স্বপ্নভোর। করজোড় ঈশ্বর, এই ভয়ার্ত নগরে- আমার বাবু-সোনা যেনো হয় জাতিস্মর।
৮ই মে ২০২২, বিশ্ব মাতৃ দিবস গ্রানভিল
|