রিপেট্রিয়েশন ও দর্পণে শরৎশশী ড. রতন কুন্ডু কোন এক রোববার। কিশোর-দা জানালেন তিনি ও এক ঝাক প্রত্যয়ী তরুণ সিডনীতে "প্রতিবিম্ব" সংগঠনের ব্যানারে দুটো নাটক মঞ্চস্থ’ করতে চান। মারানা অডিটোরিয়াম বুকিং দেয়া হয়েছে। বৃন্দাবন দাস, চঞ্চল চৌধুরী, শাহনাজ ও তাদের অন্যান্য কো - আর্টিস্টরা আসবেন দেশজ উপাদান নিয়ে। কিশোর দাস একজন সদাশিব, সদা-হাস্য বাঙালী সমাজকর্মী। বাংলাদেশ পূজা এসোসিয়েশনের সভাপতি ছিলেন একাধিকবার। পূজামণ্ডপের পাশেই প্রতিবছর উপস্থাপিত হয় বাঙালী শিশু, কিশোর, কিশোরী, যুবক, যুবতী, সদ্য দম্পতি ও পুরনোদের অংশগ্রহণে মনোজ্ঞ বিচিত্রানুষ্ঠান। সার্বজনীন বিধায় আপামর সিডনীর বাঙালী, কর্ম-ক্লান্ত সময়ের অবসরে ছুটে আসেন পূজামণ্ডপে, উপভোগ করেন দেশজ সংস্কৃতি। এক পরিতৃপ্তি নিয়ে ঘরে ফিরে যান। আমাকে অনুরোধ জানালেন সহযোগিতার জন্য। আমি মঞ্চের লোক, মঞ্চের আহ্বান ফিরিয়ে দেয়া, লেখার উপরোধে না বলা প্রায় অসম্ভব। এখানে প্রবাসীরা সকলেই কম বেশী নস্টালজিক। আমি একটু বেশী।
ফিরে যাই ১৯৯৩ সালের ১ লা ডিসেম্বরে। থিয়েটার স্কুলে পঞ্চম ব্যাচে পারফর্মিং আর্টস এর উপর প্রশিক্ষণ নিচ্ছি। প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক শ্রদ্ধেয় কবীর চৌধুরী, রামেন্দু মজুমদার, ফেরদৌসি মজুমদার, আবদুল্লাহ আল মামুন থিয়েটার স্কুলের প্রাণ। সখ্যতা হয় জাহিদ, শওকত, তিথি, কান্তা, আপন, শামীমা, ত্রপা, মমতা ও আরও অনেকের সাথে। প্রশিক্ষণের পাশাপাশি মহিলা সমিতি ও গাইডে বৈশাখীর "হ-য-ব-র-ল এর নিয়মিত শো’র জন্য কাজ করে যাচ্ছি। নাটকটি মূলত: ফরাসী নাট্যকার- মলিয়েরের সম্ভবত: "লা মেদিস মালগ্রে লুই" অনুসরণে অনুবাদ করেছেন গাজী রাকায়েত। পরিচালনাও করছেন তিনি। মাঝে অসুস্থ হওয়াতে কিছুদিনের জন্য শহীদুল আলম সাচ্চুকে ধার করা হয়েছে। অন্যদিকে আমি নাগরিক নাট্যাংগনের বের্টল্ড ব্রেখট এর 'থ্রি পেনি অপেরা’র অনুবাদক ও পরিচালক জামাল উদ্দিন হোসেন এর ’ তিন পয়সার পালা ’ নাটকের মহড়ায় ব্যস্ত। জামাল ভাই, রওশন আরা ভাবী, ইনাম ভাই (ড. ইনামুল হক) লাকি ইনাম, কাসেম ভাই ও আমরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছি। এই মূহুর্তে অফার আসলো রাকা (গাজী রাকায়েত) ভাইর কাছ থেকে -
- মনোজ মিত্রের দর্পণে শরৎশশী পড়েছেন?
- না পড়িনি তবে মনোজ মিত্রের অন্যান্য প্রোডাকশন দেখেছি। ভালো।
- শুধু ভাল ! রাকা ভাইর মুখ হা হয়ে গেল। পাশে কাঠের গুড়িতে বসা তার সদ্য সহধর্মীনি অফসানা মিমি হৈ হৈ করে ওঠে
- ইউনিক এন্ড এক্সেলেন্ট রতন দা ! অসম্ভব ক্লাসিকাল। আসেন না আমাদের সাথে! বলা প্রাসঙ্গিক মিমিদের বাসা পূর্ব মালিবাগ আর আমার বাসা পশ্চিম মালিবাগ। রাস্তার এপার-ওপাড়। তাই মাঝে মাঝেই আড্ডা হত ওদের বাসায়। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল ইনাম ভাইকে নিয়ে। আমি এ্যাপ্রোচ করতেই তিনি অসহিষ্ণু হলেন-
- আমি এই রিপেট্রিয়েশনের কনসেপ্টে বিশ্বাস করিনা। দ্যাখোনা, গ্রুপ থিয়েটার কনসেপ্ট নিয়ে আমরা যাত্রা শুরু করলাম স্বাধীনতার পরপর। নাগরিক ছিল সবচে' সুসংগঠিত ও জনপ্রিয় নাট্যগোষ্ঠী। রামেন্দু দা দের থিয়েটার ৪/৫ টুকরা হয়ে গেছে। আরামবাগ, সবুজবাগ, ঢাকাবাগ আরও কি কি ! নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় থেকে বাবলুরা বেড়িয়ে গেল। শুধু শুধু যায়নি। জামাল ভাই ও আমরা যারা সবচে' বেশী ডেডিকেটেড ছিলাম তাদের সবসময় দারিয়ে রাখার ষড়যন্ত্র। আতাউর রহমান, আলী যাকের আর হায়াৎ পরিবারের কাছে সংগঠন জিম্মি হয়ে আছে। নবীনরা মহিলা কিংবা গাইডে চেয়ার টেবিল টানা আর ফ্লায়ার বিলানো ছাড়া কোন কাজ পায়না। এই রাকারা ১০ বছর যাবত গাধার মত খেটে যাচ্ছে একটি কাস্টিং পাওয়ার জন্য। আজ পর্যন্ত ওদের একটা ভালো রোল দেয়া হয়নি। তাইলে রিপেট্রিয়েশন কেন ? ভালো কিছু করতে চাইলে নিজেদের মত করে করো। আমি সেদিন চুপচাপ ইনাম ভাইয়ের অন্তক্ষরনের সংলাপ শুনে যাচ্ছিলাম। একটি কথাও বলিনি। এর মাঝে ছোট্ট হৃদি সোনামণি এসে জানাল
- বাবা, তোমাদের চা ইনাম ভাই চা এ চুমুক দিয়ে আবার শুরু করলেন। এরমধ্যে লাকি ইনাম এসে বাঁধ সাধলেন।
- এইবার লাগাম টানো। আরাম করে চা’ টা খাও তারপর চলো ক্যাফেটেরিয়ায়। রওশন ভাবী আর আরিফ বসে আছে। জামাল ভাই’র একটু দেরী হবে। আমরা না গেলে মহড়া শুরু করা যাবেনা।
নাহ, শেষ পর্যন্ত গাজী রাফায়েত ও আফসানা মিমির অনুরোধ রাখতে পারিনি তবে তাদের প্রথম স্টেজ শো তে গিয়েছিলাম।
মিমি এসে বলল-
- রতন দা, আপনি তো লেখালেখি করেন। কাইন্ডলি একটা সমালোচনা লেখেন না কাল পত্রিকা গুলোতে দেবো। আমি বললাম
- কাগজ-কলম চাই, আর প্রথম সারিতে সিট চাই। যে কথা সেই কাজ। শুরু হল আবার লিখা-
অনিন্দ্য সুন্দর এক যুগোর্ত্তীন বাস্তব, দান্দ্বিক প্রবাহময়, ছোট অথচ বিরাট, এখন অথচ এখন নয়, এখানে অথচ অনেক দূরে। অনেক কাল আগে, প্রাক বারীন্দ্রিক যুগের কোন এক শরৎশশী। খুবই সাধারণ অথচ অসাধারণ মহিমায় মহিমান্বিত। নাট্য সংকটের সংঘাত, গিরিশচন্দ্র যুগের নানা ঘাত-প্রতিঘাতের অত্যন্ত বাস্তব প্রতিফলন ঘটিয়েছেন মনোজ মিত্র তার "দর্পণে শরৎশশী" নাটকে। শরৎশশী একটি প্রতীক এবং এই প্রতীককে ঘিরে রচিত হয়েছে প্রবাহ। যে প্রবাহের পরিণতি অনাকাঙ্ক্ষিত দুঃখময় অথচ বাস্তব। ঠিক যেমনি বিংশ শতাব্দীর "কীর্তন খোলার" সেই উঠতি যৌবনা নটরানী অবৈধ ভ্রূণের অপরাধে অভিযুক্ত হয়, ‘গ্রন্থিক-গন কহে’র নিশি-রূপী শরৎশশীরা জামাইবাবুর বজরায় আত্মাহুতি দেয়।
শরৎশশী একটি গ্রাম্য সাধারণ মেয়ে। মাসী মনোরমার স্বপ্ন তার রূপের পসরাকে পূঁজি করে তাকে বিখ্যাত অভিনেত্রী হিসেবে গড়ে তুলবে আর সে হবে কাড়ি কাড়ি অর্থ-সম্পদ আর যশ এর মালিক। নাটুলাল এর স্বপ্ন তাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে বেশ্যার পরিণত করে ফায়দা লুটবে।
জামাইবাবু-রূপী গুরুচরণ চায় কড়ির বিনিময়ে সম্ভোগ। বৃদ্ধ জ্যাঠামশাই- কুঞ্জবিহারী পূর্ণিমা রাতে ঝিলের পাড়ে একান্তে কামনা করে শরৎশশীর সান্নিধ্য। জমিদার-পুত্র ইন্দ্রনাথ তার মধ্যে প্রণয় জাগিয়ে তোলার জন্য বেপরোয়া। আর অন্যদিকে নিশিকন্ঠ বোহেমিয়ান। যার সরল বাংলা পাগল। সে চায় প্রতীক নারীর মধ্যে শিল্পী-সত্ত্বা জাগাতে, মাটির প্রতিমার মধ্যে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে। অনেক প্রচেষ্টার পরে অনেকটা সফলও হয়। এখানে ইন্দ্রনাথ ও নিশিকন্ঠের দ্বন্দ্ব মনে করিয়ে দেয় শিশির ভাদুরী ও দানী বাবুর সংঘাতময় নাট্য-জীবনকে। নাটকের শেষ দৃশ্যে নাটকের মূল সংকট ও দ্বন্দ্ব চরম রূপে প্রতিভাত হয়েছে। না পাওয়ার জ্বালা ইন্দ্রনাথকে পাগল করে তোলে। তারই প্ররোচনায় দর্শকরা যাত্রা প্যান্ডেলে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং নিশিকন্ঠ আক্রমণের শিকার হয়। মঞ্চের পেছনের অন্ধকারে নাটুলাল তার বাগদত্তা শরৎশশীকে নগদ ১০০ টাকায় বিক্রি করে দেয় জামাইবাবুর কাছে। সমস্ত মঞ্চ গভীর কালো ধোয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়, জ্বলতে থাকে আগুন। পেছনে পরে থাকে সামান্ত প্রভুর কংকাল।
নাটকের এই সংকটময় ভবিষ্যতের লাল সংকেত মূলত: নাট্য আন্দোলনের প্রধান বাধা ও সামাজিক অবস্থানকে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। প্রায়ত: কথাশীল্পি বরণ্যে নাট্যকার, চলচ্চিত্রকার ও ঔপন্যাসিক- হুমায়ুন আহমেদ যথার্থই বলেছেন-
- সব শ্রেণীর পাঠকের জন্য সব লেখা নয়, আর সব শ্রেণীর উপভোগ্য করে একটি লিখা বা একটি নাটক মঞ্চায়ন সম্ভব নয়। বিশেষ বিশেষ শ্রেণী বিশেষ বিশেষ জিনিস পছন্দ করবে এটাই স্বাভাবিক। তবে অধিকাংশ পাঠক আর অধিকাংশ দর্শকদের যা আকৃষ্ট করতে পারবে এবং ধরে রাখতে পারবে তাই সার্থক সৃষ্টি। সেদিক দিয়ে বিচার করলে "দর্পণে শরৎশশী" এক রূচিবান ও মননশীল দর্শক সমাজ তৈরিতে অবদান রাখবে বলে আমার বিশ্বাস।
আলী যাকের এর নাট্য-বোধের গভীরতা প্রমাণিত হয় ২য় দৃশ্যে শরৎশশীর অবিচল নিশুব্ধতার অভিব্যক্তি ও দু’চোখ ভরা প্রশ্নময় আবেগে। শরৎশশীর মূল চরিত্রটি আফসানা মিমি খুব চমৎকার ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। মনে হয়েছে যেন নাট্যকার মিনির কথা মাথায় রেখেই চরিত্রটি তৈরি করেছেন। নাটুলালের অশ্লীল স্পর্শ, মনোরমার টানা হেঁচড়া, জ্যাঠামশাইর কামুক অভিব্যক্তি, শশীর বোধহীন অথচ প্রতিবাদী অবয়ব একজন সুপরিচালক এর কথাই মনে করিয়ে দেয়। অন্যদিকে নিশিকঠের সাত্ত্বিক আঘাতে একই শশীর মধ্যে অশান্ত সমুদ্র একদিকে যেমনি চরিত্র রূপায়নকারীনির কৃতিত্ব, অন্যদিকে তেমনি বলিষ্ঠ প্রযোজনায় ইংগিত বহন করে। বিভিন্ন চরিত্রে ইশরাত নিশাত, সালাউদ্দিন লাভলু, তপন দাস, আউয়াল রেজা সহ অন্যান্য সবাই সাবলীল ছিলেন। কখনই অসহ্য মনে হয়নি। বেঁচে থাক বাংলার নাট্য আন্দোলন, বেঁচে থাক বাংলা নাট্য চর্চা দেশে ও বিদেশে।
|