bangla-sydney
bangla-sydney.com
News and views of Bangladeshi community in Australia













অস্ট্রেলিয়ার পাখ-পাখালী (১)
রফিক হক



কল্পনা করুন তো, ঠোঁটে হলুদ ফুলের পাপড়ি নিয়ে ছোট্ট একটা পাখী প্রেমিকাকে প্রপোজ করছে, অথবা অন্য একটি পাখি নীল রঙে রঙ্গমঞ্চ সাজিয়ে বসে আছে-নৃত্যের তালে তালে প্রেমিকার মনোরঞ্জন করতে!! গল্পের মত শোনাচ্ছে, তাই না? কিন্তু এ সবই অস্ট্রেলিয়ার পক্ষী-রাজ্যে নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। আমাদের চারিপাশে প্রকৃতিতে কত শত অদ্ভুত ঘটনা ঘটে চলেছে, আমরা তার কত টুকুই বা জানি অথবা দেখি!! অস্ট্রেলিয়ার প্রতিটি পাখী তাদের স্বকীয় স্বাতন্ত্র্যে অনন্য, নিজ নিজ স্বভাবের বৈশিষ্ট্যে অদ্বিতীয়।

অস্ট্রেলিয়ার পাখ-পাখালীর রাজ্যে আপনাদেরকে স্বাগত জানাই, এখন থেকে প্রতিবার একটি করি পাখীর সাথে পরিচয় করিয়ে দেব, সেই সাথে তাদের বিশেষ কোন স্বভাব প্রসঙ্গে আলোকপাত করতে চেষ্টা করবো। তবে শুরুতেই বলে নেওয়া দরকার, জীব-বৈচিত্র্যে অস্ট্রেলিয়া মেগা-ডাইভার্স দেশগুলির মধ্যে অন্যতম। এই দেশগুলি পৃথিবীর মাত্র দশ ভাগ এলাকা জুড়ে বিস্তৃত, অথচ বিশ্বের যাবতীয় উদ্ভিদ এবং প্রাণীকুলের সত্তর ভাগ বাস করে এই দেশগুলিতে। অস্ট্রেলিয়ার বিপুল জীব বৈচিত্র্যের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ হচ্ছে পক্ষী-সম্পদ। অস্ট্রেলিয়ান সরকারের রিপোর্ট অনুযায়ী ৮২৮ প্রজাতির পাখীকে অস্ট্রেলিয়ান পাখী বলা যায়। মাইগ্রেটরি অতিথি পাখী, বিদেশ থেকে নিয়ে আসা পাখী এবং অন্যান্য ক্যাটাগরির পাখির টেক্সা এই পরিসংখ্যানে যুক্ত করলে অস্ট্রেলিয়ায় পাখীর প্রজাতি ৯০০ পার হয়ে যায়। তবে ৪৫ ভাগ পাখীর প্রজাতি একবারেই অস্ট্রেলিয়ার স্থানীয়, অর্থাৎ এই সকল পাখী পৃথিবীর অন্য কোথাও দেখা যায় না। এ-তো ছিল শুধু প্রজাতির হিসাব। সংখ্যা হিসাবে ২০২৩ সালে জাতীয় পক্ষী-গণনায় দেখা গিয়েছে অস্ট্রেলিয়ায় ৩৬,০৮,৫৪৫ (মোটামুটি ভাবে ৩.৬ মিলিয়ন) পাখীর বসবাস। উল্লেখ্য যে, জাতীয় সিটিজেন সায়েন্স প্রোগ্রাম হিসাবে এই গণনায় সর্বমোট ৬০,৫৯৮ জন ছাত্র ছাত্রী এবং সাধারণ অস্ট্রেলিয়ান অংশগ্রহণ করেছিলেন।



Bell Bird বা ঘণ্টা পাখী (Manorina melanophrys)

আজকে যে পাখিটার সাথে আপনাদেরকে পরিচয় করিয়ে দেব, আমি নিশ্চিত ভাবে বলতে পারি তাকে আপনারা প্রায় সকলে কখনো ভালো করে দেখেন নাই। তবে নদী বা পাহাড়ি ক্রিকের পাড়ে অথবা রেইন-ফরেস্ট ধরণের অস্ট্রেলিয়ান বুশ বা জঙ্গলের বড় বড় গাছ থেকে তাদের ডাক নিশ্চয়ই শুনে থাকবেন। এই পাখীর সাথে পরিচয়ের আমার নিজের অভিজ্ঞতার গল্প দিয়ে শুরু করি।

তিন দশক আগে পেশার প্রয়োজনে অস্ট্রেলিয়ার বনানী এবং প্রকৃতির সাথে পরিচয়ের সূত্রপাতেই এই পাখিটার সাথী পরিচয় হয়েছিল। নেপিয়ান নদীর উজানে রেইন-ফরেস্ট ধরনের জঙ্গলে ঢোকার আগে থেকেই একটা তীক্ষ্ণ 'টিং টিং' শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। সহকর্মীদেরকে শব্দের উৎসের কথা জিজ্ঞাসা করাতে তারা একটা লতাপাতা জড়ানো প্রকাণ্ড ইউক্যালিপটাস গাছ দেখিয়ে দিলো। বাংলাদেশের সবাই প্রায় বাকল-হীন ইউক্যালিপটাস গাছ দেখে থাকেন, কিন্তু তাদের অনেকেই জানেন না অস্ট্রেলিয়াতে ৭০০-৮০০ ইউক্যালিপটাসের প্রজাতি দেখা যায়। একেকটা প্রজাতিতে একেক ধরনের বাকল এবং বাকলের সন্নিবেশ হয়ে থাকে। এই বাকলের ধরন দেখে ইউক্যালিপটাস প্রজাতি সনাক্ত করা যায়। যাহোক, লক্ষ্য করে দেখলাম ধূসর রঙের বাকল দ্বারা আবৃত এই দৈত্যাকার গাছটির মাঝামাঝি স্থানে কতগুলি পাখী এক ডাল থেকে অন্য ডালে লাফালাফি করছে এবং সেই টিং টিং শব্দটি সেখান থেকেই আসছে। পাখীগুলির গায়ের রং গাছ এবং লতা-পাতার সাথে ক্যামোফ্লাজ করে গিয়েছিল, তাই গাছের নিচ দাঁড়িয়েও তাদেরকে স্পষ্ট করে দেখা যাচ্ছিল না । যাহোক, তাদের সেই টিং টিং শব্দটির একটু বর্ণনা না দিলেই নয়। শব্দটা খুব জোরালো বা কান ফাটানো নয়, বরং এক কথায় শ্রুতিমধুর। কান পেতে শুনলে এই শ্রুতিমধুর শব্দটি প্রায় এক কিলোমিটার দূর থেকেও শোনা যায়। শব্দটি কেমন যেন প্রতিধ্বনিত হয়ে বাতাসে ভেসে যায়।

ঘণ্টা-পাখি আকারে মাঝারি, বাংলাদেশের শালিক পাখীর মত, গায়ের রং অলিভ গ্রিন, তবে পাখা গুলি ধূসর এবং পা-হলুদ। অস্ট্রেলিয়ার পূর্ব এবং দক্ষিণ-পূর্ব উপকুলে রেইন-ফরেস্ট ধরনের জঙ্গলে এদের দেখা মেলে। ঘণ্টা-পাখীরা নির্দিষ্ট জোড়ায় জোড়ায় ঝাঁক-বেঁধে সামাজিক ভাবে বসবাস করে। তারা বেশি একটা উড়ে বেড়ায় না। তাই তারা অত্যন্ত টেরিটোরিয়াল এবং প্রতিটি ঝাঁক তাদের নিজেদের এলাকায় অন্য কোন পাখীদেরকে এক রকম বসতেও দেয় না। এই পাখীদের প্রতিটি বাসা রক্ষণাবেক্ষণ এবং বাসার ছানা-পোনাদের লালন-পালন করতে মা-বাবা পাখীদেরকে সবসময় ১৫-২০টি পাখী সাহায্য করে থাকে। এদেরকে Nest Helpers বলা হয়।

ঘণ্টা-পাখির ডাক শ্রুতি মধুর হলেও প্রকৃতিতে তাদের অবদান কিন্তু বিশেষ ভালো চোখে দেখা হয় না। একদিকে তাদের আক্রমণাত্মক ব্যবহারের জন্য অন্য পাখীরা তাদের এলাকার ধরে কাছে আসতে পারে না। অনেক সময় বড় বড় পাখীদেরকেও তারা দল বেঁধে তাড়া করে থাকে। অন্যদিকে তাদের অদ্ভুত খাদ্যাভ্যাস তাদের আশ্রয় দানকারী গাছ গুলির জন্য ভয়াবহ। তাদের খাবারের প্রায় ৯০% ভাগ সিলিড (Psyllid) নামে গাছের রস শোষণকারী এক ধরনের ক্ষুদ্র পতঙ্গ এবং তাদের নিঃসৃত জমাট বাঁধা বিন্দু বিন্দু মধু। গবেষণায় দেখা গিয়েছে ঘণ্টা-পাখিরা রীতিমত অভিজ্ঞ কৃষিবিদ, তারা তাদের প্রয়োজন মত সিলিড-পতঙ্গ চাষাবাদ করে থাকে। সিলিড পতঙ্গের আক্রমণে দৈত্যাকার সব ইউক্যালিপটাস গাছ Dieback রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। সম্প্রতি পশ্চিম সিডনীর অসংখ্য গাছ এই পতঙ্গের আক্রমণে মারা গিয়েছে। তবে লক্ষ্য করা যায় যে শুধুমাত্র একটি প্রজাতির ইউক্যালিপটাস (Eucalyptus moluccana) সিলিড আক্রমণ এবং তার ফলশ্রুতিতে Dieback রোগে মারা যাচ্ছে। অনেকে তাই তাদের শ্রুতি মধুর ঘণ্টার মত ডাককে 'মৃত্যুর-ঘণ্টা' বলে থাকেন। YouTube এ Australian Bell Bird's call সার্চ করলে খুব সহজেই এই পাখির ডাক শুনতে পাবেন।



রফিক হক, সিডনি




Share on Facebook               Home Page             Published on: 19-May-2025

Coming Events:

Blacktown Money raised so far