শুভ বিজয়া - হারিয়ে যাওয়া স্মৃতির রোমন্থন পুরুষোত্তম চক্রবর্তী
বিজয়া দশমী শুভ শক্তির বিজয়ের দিন। আপামর বাঙালির বিষাদের দিন। ফেলে আসা মহাশক্তির আরাধনার উৎসবকে আবার ফিরে দেখার দিন। “শুভ বিজয়া” এখন যেন ইতিহাস! সেই প্রাণের আবেগ কোথায়? এখন বিজয়ার মিষ্টিমুখ করতে কেউ বাড়ীতেও আসে না, আমরাও যাই না। শুধুই WhatsApp ও টেলিফোন!
বিজয়ার একটা nostalgic অনুভূতি আছে। ধানবাদে ছোটবেলার সেই দিনগুলো খুব মিস্ করছি। স্হান-কাল-পাত্র নির্বিশেষে গুরুজনদের পা ছুঁয়ে বিজয়ার প্রণাম আর তাঁদের স্নেহাশীর্বাদ কুড়োনো, আর পরিশেষে মিষ্টিমুখ করা - আমার স্মৃতিপটে আজও অমলিন হয়ে রয়েছে। আমি তো এখনও আমার থেকে বয়সে বড় যে কোন মানুষের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করি। সে আত্মীয়-স্বজনই হোক, বা প্রতিবেশীই হোক। আর মাস্টারমশাই হলে তো কথাই নেই। তখন তো আর বয়স দেখিনা, মাস্টারমশাই বলে কথা! পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করার এই অভ্যাস টা সেই বাল্যকাল থেকেই হৃদয়ের মধ্যে গেঁথে গিয়েছে। আমার ছেলের মধ্যেও এই অভ্যাসটা একরকম ঢুকিয়ে দিয়েছি। আমার বন্ধুবান্ধবদের কেউ বাড়ীতে এলেই দেখেছি ও আগেই তাঁকে ঢিপ করে একটা প্রণাম করে বসে।
মনে আছে, বিজয়ার মিষ্টি খেতে দশমীর দিন রাত্রেই পাড়ার বিভিন্ন বাড়ীতে দল বেঁধে যাওয়া শুরু করতাম। নিজের বাড়ীতে ঐ দিন সারা দুপুর ধরে মা নারকেল নাড়ু, কুচো নিমকি, আর মাংসের কিমা দিয়ে কাবলি ছোলার ঘুগনি তৈরি করতেন। তখন আমার বয়স আনুমানিক ১০ বছর হবে! বাবা দশমীর দিন সন্ধ্যে হলেই স্নান করে ধবধবে সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি পরে একটা প্লেটে খানিকটা ধান আর কয়েক গাছা দূর্বা রেখে অপেক্ষা করতেন আমরা কতক্ষণে বাবাকে আর মাকে প্রণাম করবো। বাবা, মা পাশাপাশি বসতেন আর আমরা বাবা-মার পা ছুঁয়ে প্রণাম করেই বেড়িয়ে পড়তাম বিজয়া করতে। দশমীর সন্ধ্যায় মায়ের তৈরি করা বাড়ীর সেই লোভনীয় খাবার উপেক্ষা করে পাড়ার কাকুদের বাড়ীতে বিজয়া করাটাই যেন প্রাধান্য পেত। জানিনা কেন? আজ বাবা-মাকে বড্ড মনে পড়ছে, চোখ ফেটে জল আসছে!
পাড়ার সবাইকে যে চিনতাম তা নয়, কিন্তু সেই সব ভাবতাম না। ভাবলাম, আগে ঢুকে তো পড়ি, তারপর দেখা যাবে! বাড়ীর মধ্যে ঢুকে যাকে সামনে দেখতাম চোখের সামনে, ঢিপ করে একটা প্রণাম। কিছু না কিছু তো জুটতোই। কোথাও একটি করে মুগের লাড্ডু আবার কোথাও কয়েকটি করে তিলের নাড়ু। একটি বাড়ীতে একজন ভদ্রমহিলা ডান হাতের মুঠোতে করে মুঠোভর্তি কুচো নিমকি নিয়ে এসে আমাদের সামনে এসে হাত টা মেলে দাঁড়ালেন। বললেন “ নে, তোরা এর থেকে তুলে নে একটু একটু করে”। মনে হোল, কি অপমান! ছোট বলে কি আমাদের সম্মান নেই?
যাই হোক, এইভাবে বিজয়া করে চলেছি দুর্বার গতিতে একটার পর একটা বাড়ীতে গিয়ে। কোন একটি বাড়ীতে ঢুকবার আগে বেমালুম ভুলেই গিয়েছিলাম যে সেই বাড়ীতে বিজয়া করা হয়ে গিয়েছে; কিছুক্ষণ আগেই ঐ বাড়ীতে কুচো নিমকি, রসগোল্লা... ইত্যাদি খেয়ে এসেছি। যেই না ঢুকেছি, বাড়ীর কেউ একজন অন্য কাউকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো “আরে আরে দেখ দেখ, ছেলেগুলো আবার এসেছে। এরা একটু আগেই তো খেয়ে গেল!” কি লজ্জা কি লজ্জা! মুখের দিকে আর তাকাতে পারিনি, একেবারে চো চা দৌড়! দৌড়েই সটান আরেকটি বাড়ী। সেই বাড়ীতে আবার মুরগীর একটি পোল্ট্রি ফার্ম ছিল। ঢুকতেই খানিকটা আঁশটে গন্ধ হুস করে নাকের মধ্যে ঢুকে গেল! যেন মনে হোল সারা গায়ে-মুখে মুরগীদের গায়ের গন্ধ একেবারে আষ্টেপৃষ্ঠে মিশে গিয়েছে! ওঁরা মনে হল তৈরি ছিলেন না আতিথেয়তা করার জন্য। তাই ওঁরা খানিকক্ষণ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন আমাদের সামনে। তারপরে অবশ্য ওঁরা আমাদের সাদর অভ্যর্থনা করেছিলেন মুরগীর টাটকা ডিমের গরম গরম অমলেট খাইয়ে। আমরাও যেন কৃতার্থ বোধ করেছিলাম!
সেই দলের মধ্যে আমি ও আমার চার-পাঁচ জন পাড়ার বন্ধু; কখনো সখনো আমার মেজ ভাইও সঙ্গ দিত। পরের দিন অর্থাৎ একাদশীর দিন সকাল থেকেই আবার শুরু হল আমাদের সেই কর্মকাণ্ড। এবার নিজেদের পাড়ার গণ্ডি ছাড়িয়ে একরকম বেপাড়ায় চলে গিয়েছি। সম্পূর্ণ অজানা বাড়ী। কেউ একজন কড়া নাড়লাম বাড়ীর দরজায়। ভিতর থেকে মেয়েলী কণ্ঠের চিৎকার “কৌন রে?” আমাদের মধ্যে কেউ একজন ততোধিক জোরে বলে উঠলো “চাচি, হমলোগ হ্যায়, দরওয়াজা খোলিয়ে”। এক মধ্যবয়স্কা গুজরাতি মহিলা বেড়িয়ে এসে একগাল হাসি দিয়ে বললেন “আও আও, অন্দর আও। বৈঠো।” আমাদের প্রণাম শুরু হয়ে গেল। ততক্ষণে গৃহকর্তার প্রবেশ। তাঁকেও প্রণাম। একটু বাদেই চাচি একটা বড় প্লেটে খানিকটা চানাচুর, ঝুরিভাজা আর কয়েকটা মুরুক্কু নিয়ে হাজির। দেখেই “এ বাবা, সবই যে নোনতা, মিষ্টি কৈ”- একজন মুখ ব্যাজার করে বলে উঠলো।
পাড়াটা অবাঙালি অধ্যুষিত। তাতে কি! আমাদের কর্মকাণ্ডের বিরাম নেই, কারণ আমাদের বিজয়ার মিষ্টি খেতেই হবে। গেলাম আরেকটি বাড়ীতে। দরজা খোলাই ছিল। সামনের ঘরে শতচ্ছিন্ন মলিন একটি দড়ির খাটিয়া পাতা, তাতে এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক আধশোয়া অবস্থায় রয়েছেন। আমাদের এক এক করে প্রবেশ। যথারীতি ভদ্রলোকের পায়ে ঢিপ ঢিপ করে প্রণাম-পর্ব শেষ হল। বাড়ীর গিন্নী ঢুকলেন এক বিরাট বাটি ভর্তি মুড়ি নিয়ে। এই রে, মুড়ি খেতে হবে না কি! দেখলাম, মুড়ির বাটি খাটিয়ার ভদ্রলোকের হাতে চালান হল এবং গিন্নী ভিতরে চলে গেলেন। আমরা তীর্থের কাকের মত বসে আছি। ভদ্রলোক মুড়ি চিবাচ্ছেন আর আমাদের সাথে খোসগপ্পো জুড়ে দিয়েছেন। মিনিট দশেকের মধ্যে ভিতর থেকে কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে বুঝলাম, এ বাড়ী থেকে মিষ্টিমন্ডা পাবার কোন সম্ভাবনা নেই! অগত্যা রণে ভঙ্গ দিলাম।
হঠাৎ একজনের কথা মনে পড়ে গেল। বন্ধুদের বললাম, “এই, একটা বাড়ীতে যাবি? আমার বাবার বন্ধু মজুমদার-কাকুর বাড়ী। জানিস তো, মজুমদার-কাকু আর মজুমদার-কাকীমা খুব ভালোবাসে আমাদের। যাবি?” বন্ধুরা এক পায়ে খাড়া। অনেকটা দূরে সেই বাড়ী। বাবার সঙ্গে ঐ বাড়ীতে একবারই গিয়েছিলাম, তাই বাড়ীটা খুঁজতে খুব একটা অসুবিধে হয়নি।
তখন বেলা প্রায় ১১টা। সকলে মিলে হাজির। মজুমদার-কাকু তখন অফিসে। কাকুর অনেকগুলো ছেলেমেয়ে, বাড়ীতে তাণ্ডব নৃত্য হচ্ছে। আমরা ঘরের মধ্যে ঢুকে একটা চৌকিতে গিয়ে বসলাম। কাকীমা রান্নাঘরের মধ্য থেকে চেঁচিয়ে আমাকে নাম ধরে ডাকলেন। বললেন “উত্তম, রান্নাঘরে এসে বোস। তোর সঙ্গে কথা বলবো। তোর বন্ধুরা ঘরে বসুক।”
রান্নাঘরের মধ্যে সবে ঢুকেছি, দেখলাম কাকীমা পিড়েতে বসে কড়াইতে একমনে খুন্তি নাড়ছেন। হঠাৎ দেখলাম, কাকীমা সেই একই খুন্তি দিয়ে পাশের দেওয়ালে লেগে থাকা স্তূপাকৃতি একটি বস্তু থেকে খানিকটা অংশ খুঁচিয়ে বার করে কড়াইয়ের মধ্যে ফেলে দিলেন। একটু অবাক হলাম। দেখলাম, দেওয়ালে একটা বড় ঘুঁটের মত কিছু একটা লাগানো আছে, খানিকটা কালচে বর্ণের! সেই ঘুঁটে থেকেই খানিকটা অংশ খুঁচিয়ে বার করে রান্নায় দিয়েছেন। জিজ্ঞেস করলাম, ওটা কি কাকীমা? কাকীমার অমলিন হাসি! বললেন, “আসলে রোজ রোজ বাটনা বাটতে পারি না, তাই সারা মাসের হলুদ টা বেটে দেওয়ালে লাগিয়ে রাখি। শুকিয়ে গেছে তো, তাই খুঁচিয়ে বার করতে হয়। রোজ এখান থেকেই একটু একটু করে নিয়ে রান্নাতে দেই। সারা মাসে আর বাটতে হয় না। তোর মা কি করে রে? রোজই কি বাটনা বাটে?”
মজুমদার কাকীমার মুখ থেকে এই কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই আমার কি রকম যেন একটা বমি বমি ভাব আসতে শুরু করলো। বললাম, “কাকীমা আজকে শরীরটা খারাপ লাগছে। অন্য দিন আসবো।” কাকীমা একরকম কাতর স্বরে মিনতি করে উঠলো, “সে কি রে, মিষ্টি খাবিনি”? কোন উত্তর আর দেবার অবকাশ হয়নি; একরকম তৎক্ষণাৎ বন্ধুদেরকে নিয়ে একেবারে বাড়ীর দিকে সোজা হন টন!
বিকেলে আবার সেই একই কর্মসূচি। মনে পড়লো, নিজেদের পাড়ার মধ্যে একটা বাড়ীই বাকি আছে, যেখানে এখনও বিজয়া করা হয়নি! অতএব যাওয়া যাক। আমরা ক'জন সেই বাড়ীতে ঢুকলাম। সেই বাড়ীর ঘোষকাকু আমাদের খুব পরিচিত। উনি ভীষণ বদমেজাজি ছিলেন, তাই আমাদের প্রণাম যেন ওঁর কাছে অপ্রত্যাশিত ছিল! প্রণাম পেয়ে ফোকলা দাঁতের হাসি খেলে গেল মুখে; যেন একেবারে 'বিগলিত করুণা, জাহ্নবী যমুনা'! দেখলাম, ঘোষকাকু তখন তাঁর ছেলেদের পড়াচ্ছেন; তাঁর হাতে একটি জব্বর লাঠি। সবাই ঘরের মেঝেতে বসে আছে। দুই ছেলে কিছু যেন লিখছে, আর একটি ছেলে জোরে জোরে বাংলা ব্যাকরণ পড়ছে “কয়েকটি শব্দ লইয়া একটি পদ গঠিত হয়। কয়েকটি শব্দ লইয়া একটি পদ গঠিত হয়।” এই বাক্যটি বার বার পড়ছে; মুখস্থ করবার প্রয়াস আর কি। আমরা ক'জন ঘোষকাকুর পাশেই বসে আছি। হঠাৎ দেখলাম, ঘোষকাকু সপাং করে লাঠির বাড়ি মারলেন ছেলেটির পিঠে, যে ছেলেটি পড়ছিল “কয়েকটি শব্দ লইয়া একটি পদ গঠিত হয়।” ছেলেটি যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠলো। আমি চমকে উঠলাম ও অবাক বিস্ময়ে ভাবতে লাগলাম, কি এমন হোল যে ছেলেটিকে এরকম মার খেতে হোল! ব্যাপারটা বুঝতে চাইছিলাম। বুঝে উঠবার আগেই ঘোষকাকুর হুঙ্কার “কি পড়ছিস রে ব্যাটা? কি পড়ছিস তুই তখন থেকে?” লাঠি টা দিয়ে পিঠের উপর আরেকবার সজোরে ঘা দিয়ে বলে উঠলেন “এর নাম 'শব্দ'। এই যে তোকে মারলাম আর কক্ করে একটা আওয়াজ হোল, এই আওয়াজটাই হচ্ছে 'শব্দ'। বুঝতে পারলি?” ভাবলাম, বলছে কি লোকটা? ভাবতে না ভাবতে আবার চমক। ঘোষকাকু বললেন “আর 'পদ' হচ্ছে এইটা”। বলেই নিজের পা-দুটো বাড়িয়ে আবার বলে উঠলেন “ওরে বুদ্ধু, এই টা হচ্ছে পদ বা পা। পা রে পা।” ভেবে শিউরে উঠলাম, কি সাংঘাতিক! এ তো এক সৃষ্টিছাড়া উন্মাদ ব্যাকরণ - শিক্ষক! আমি 'শব্দ' আর 'পদের' পার্থক্য সেদিন আবার নতুন ভাবে শিখলাম!
ততক্ষণে ঘোষ কাকীমা কয়েকটি প্লেটে নিমকি আর নীল রঙের মিষ্টি নিয়ে এসেছেন। নীল মিষ্টির দানাগুলো দেখতে হুবহু বোঁদের মতো! আমি বললাম, কাকু এটা কি মিষ্টি? কাকু আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন “ওরে, এটা নীল বোঁদে। বাড়ীতে নিজের হাতে তৈরি করেছি। লাল বোঁদে তো অনেক খেয়েছিস, নীল বোঁদে কখনও খেয়েছিস? খা, খেয়ে দেখ”। সোহাগ করে গিন্নী কে বললেন “ওদের আরো নীল বোঁদে দাও গো!”
ঐরকম ঘননীল বোঁদে দেখে আমাদের চোখ ছানাবড়া! খাওয়া ডকে উঠে গিয়েছে ততক্ষণে! আমার কেন জানিনা মনে হয়েছিল, ঘোষকাকু নির্ঘাত কাপড় কাচার নীল ব্যবহার করেছেন! কি ভাবে যে ঘোষকাকুর কবল থেকে মুক্ত হয়ে বাইরে বেরিয়ে আসতে পেরেছিলাম, মনে নেই!
কলকাতা, ১৮ই অক্টোবর ২০২১
প্রফেসর পুরুষোত্তম চক্রবর্তী, কলকাতা থেকে
|