bangla-sydney
bangla-sydney.com
News and views of Bangladeshi community in Australia













সতীনাথ ভাদুড়ী - এক প্রথিতযশা সাহিত্যিক
পুরুষোত্তম চক্রবর্তী



ভাগলপুর সেন্ট্রাল জেলের ঠান্ডা মেঝেতে বসে ঘাড় গুঁজে একমনে কী যেন লিখে চলেছেন এক বন্দি। যে সে বন্দি নন, রাজবন্দি। জেলের ভেতরেও তিনি কড়া নজরদারিতে থাকেন। আগে একবার দলবল নিয়ে জেল ভেঙে পালাবার চেষ্টা করেছিলেন। পারেননি। সেই স্মৃতি ঘাড়ের পাশে পুলিশের রুলের মোটা দাগ নিয়ে জেগে। কয়েক দিন আগেই তিনি জেল সুপারিন্টেন্ডেন্টের কাছে আর্জি জানিয়েছেন তাঁকে যেন কোনও একটি ‘টি সেলে’ পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

‘টি সেল’ গুলিতে রাখা হয় খতরনাক বন্দিদের। ছোট্ট খুপরি, একা একা থাকা। আলো বাতাস ঢোকে না বললেই চলে। সেখানে কি কেউ সাধ করে ঢুকতে চায়? সুপারিন্টেন্ডেন্ট জিজ্ঞাসাই করে ফেললেন, “বলেন কী মশাই! ওখানে কেন?”
বন্দির উত্তর, “একা থাকলে লেখাপড়ার কাজটা ভাল হয়।”
“বেশ, ব্যবস্থা করছি তাহলে।”

ব্যবস্থা হল। আর ওই টি-সেলে বসেই রুল টানা খাতায় লেড পেন্সিলে লেখা হল এক উপন্যাস, যার নাম জাগরী।
লেখক ‘ভাদুড়ীজি’। সতীনাথ ভাদুড়ী। সময়টা ১৯৪২। গোটা ভারতবর্ষ তখন গাঁধীজির “ভারত ছাড়ো” আন্দোলনের জ্বরে কাঁপছে। সতীনাথ লেখক হিসেবে একেবারেই আনকোরা নতুন, কে পড়বে তার ওই লেখা?

জেলে বসেই সেই লেখা পড়ে ফেললেন তাঁরই এক অনুগত শিষ্য, তিনিও রাজবন্দি। ‘ময়লা আঁচল’-এর লেখক হিন্দি ঔপন্যাসিক ফণীশ্বরনাথ ‘রেণু’, যিনি অনন্য হিন্দি সাহিত্যিক মুন্সী প্রেমচাঁদের পরবর্তী সময়ের সবচেয়ে শক্তিশালী হিন্দি সাহিত্যিক। তাঁর লেখা উপন্যাস “তিসরি কসম” চলচ্চিত্রে রূপায়িত হয়েছে। ফণীশ্বর সতীনাথের ‘জাগরী’ উপন্যাস টি পড়ে শুধু মুগ্ধই হলেন না, কেঁদে ফেললেন। ‘ভাদুড়ীজি’র পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বললেন, “আমি ধন্য হলাম এই অসামান্য উপন্যাসের প্রথম পাঠক হতে পেরে।”

‘জাগরী’ প্রকাশ হওয়া নিয়েও এক মস্ত গল্প। সতীনাথ জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর সেই পাণ্ডুলিপি পড়েই রইল বাক্সবন্দি হয়ে। চিরকালেরই মিতভাষী সতীনাথ।

নিজের সম্পর্কে তো একেবারেই বলিয়ে কইয়ে নন, সুতরাং জেলের ভেতর কী লিখেছেন কেই বা জানবে? কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঘটনাটি আর চাপা রইল না।

‘বনফুল’, অর্থাৎ বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় ছিলেন সতীনাথের পরম বন্ধু। তাঁর বাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত ছিল সতীনাথের। একদিন গেলেন বনফুলের বাড়ি। কথায় কথায় সংকোচে বলেই ফেললেন, “একটি উপন্যাস লিখে ফেলেছি জেলে বসে, একবার পড়ে দেখবে?”

“আরে অবশ্যই দিয়ে যাও।”

কয়েক দিনের মধ্যেই পড়ে ফেললেন গোটা উপন্যাসখানি। মুগ্ধ! আহা কী লিখেছে সতীনাথ! আবার ডেকে পাঠালেন বন্ধুকে।

“কী লিখেছ তুমি! এ যে অসামান্য! এক্ষুনি এই উপন্যাস ছাপানোর ব্যবস্থা করতে হবে।”

“কিন্তু আমার যে কোনও সম্পাদকের সঙ্গে পরিচয়ই নেই!”

“দাঁড়াও, আমি ব্যবস্থা করছি। আমার ভাই ঢুলু-র (অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়, চলচ্চিত্র পরিচালক) সঙ্গে সাগরময় ঘোষের ভাল পরিচয় আছে। ওঁর কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করছি।” সাগরময় ঘোষ তখন “দেশ” পত্রিকার সহ-সম্পাদক। অরবিন্দ নিজে গেলেন পত্রিকার দফতরে সাগরময় ঘোষের সঙ্গে দেখা করতে। ‘জাগরী’র পাণ্ডুলিপিও জমা দিলেন। সাগরবাবু বললেন, “একমাস পর এসে খোঁজ নিতে।”

একমাস পর আবার গেলেন অরবিন্দ। সাগরবাবু পাণ্ডুলিপি ফেরত দিয়ে বললেন, “অমনোনীত।”

অরবিন্দ শুনে অবাক, “সে কী! সাগরদা আপনি নিজে পড়েছেন?”

“না আমি পড়িনি, তবে যিনি পড়েছেন তিনিও সাহিত্যের মস্ত বড় একজন সমঝদার।”

ফেরত চলে এল ‘জাগরী’। এবার উপায়? হাল ছাড়ার পাত্র নয় অরবিন্দ। সোজা গেলেন ‘শনিবারের চিঠি’র সম্পাদক সজনীকান্ত দাসের বাড়ি।

“দাদা এই উপন্যাসটা একবার পড়ে দেখবেন? একজন নতুন লেখক।”

দু’দিন পরেই কাকভোরে অরবিন্দবাবুর বাগবাজারের বাড়ির নীচে সজনীকান্তর ডাকাডাকি।

“এক্ষুনি নীচে এসো। আরে এ কে! কী সাংঘাতিক লেখা! এই লেখা এক্ষুনি ছাপাতে হবে।”

“আপনি ছাপবেন?”

“ছাপতে পারলে ধন্য হতাম। আমার পত্রিকায় এখন তারাশংকর আর বনফুলের ধারাবাহিক উপন্যাস বেরোচ্ছে, কবে শেষ হবে জানি না। কিন্তু তত দিন এই লেখা ফেলে রাখলে চলবে না। এখনই পাঠকদের কাছে পৌঁছানো দরকার। ব্যবস্থা করছি। আমি চিঠি লিখে দিচ্ছি। তুমি চিঠি আর এই পাণ্ডুলিপি নিয়ে এখনই যোগাযোগ করো।”

সজনীকান্ত চিঠি লিখলেন একটি হিন্দি দৈনিকের সম্পাদককে। চিঠির বয়ান, “তুমি জাগরী ছাপবে। ছেপে ধন্য হবে।— সজনীকান্ত দাস”

লালচে নিউজপ্রিন্টে সরাসরি বই হয়ে জাগরী-র গতি হল। আর প্রকাশ হওয়া মাত্রই বাংলার পাঠক মহলে হই হই। তারপর? সতীনাথ ভাদুড়ী নামের এক নতুন বাঙালি লেখকের প্রথম উপন্যাস ‘জাগরী’ পেল প্রথম রবীন্দ্রপুরস্কার।

সাগরময় ঘোষ ছুটলেন সতীনাথ ভাদুড়ীর বাড়ি। একবার বড় ভুল হয়ে গেছে খাঁটি হীরে চিনতে, দ্বিতীয় বার আর নয়। নিজেকেই নিজে বললেন, “ওকে আমাদের একটা উপন্যাস দিতেই হবে।”

সাগরময়ের অনুরোধ ফেরাননি সতীনাথ। দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিক প্রকাশ পেল তাঁর আরেক কালজয়ী উপন্যাস— “ঢোঁড়াই চরিত মানস”।

সতীনাথ ভাদুড়ীর জন্ম ২৭শে সেপ্টেম্বর ১৯০৬, বিহারের পূর্ণিয়া জেলার ভাট্টাবাজারে। পিতা ইন্দুভূষণের আদি বাড়ি নদীয়ার কৃষ্ণনগরে। ১৮৯৬ খৃষ্টাব্দে জীবিকাসূত্রে ইন্দুভূষণ পূর্ণিয়ায় চলে আসেন। সঙ্গত কারণেই সতীনাথের স্কুলজীবন শুরু হয় পূর্ণিয়া জেলা স্কুলে। প্রতি বছর সব পরীক্ষায় প্রথম। ১৯২৪ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হবার পর সতীনাথ পাটনা সায়েন্স কলেজে অর্থনীতি নিয়ে পড়া শুরু করেন। ১৯২৮ সালে অর্থনীতিতে স্নাতক ও ১৯৩০ সালে অর্থনীতিতে এম এ পাশ করেন। তার পরের বছরই সতীনাথ পাটনা আইন কলেজে থেকে বি এল পাশ করেন। ছোটবেলা থেকেই সতীনাথ স্বভাবে বড় মুখচোরা। এমনিতে চেনা পরিচিতদের মধ্যে দিব্যি গল্পবাজ, কিন্তু অচেনা কেউ সামনে এলেই মুখে কুলুপ। কিন্তু যে সতীনাথ অপরিচিত, স্বল্পপরিচিত মানুষের সামনে কথা বলতেও সংকোচ করত, সে-ই কিনা ঝাঁপিয়ে পড়ল স্বাধীনতা সংগ্রামে।

দেশ জুড়ে তখন শুধু একটাই স্লোগান ‘ইংরেজ ভারত ছাড়’। গাঁধীজির ডাকে ঝাঁপিয়ে পড়ছে দেশের লাখো লাখো তরুণ। সেই ডাক আচমকা ঢুকে গিয়েছিল যুবক সতীনাথের ভেতরেও। গাঁধীজির ডাকে তখন দেশের সর্বত্র পিকেটিং চলছে। একদিন বন্ধুদের ডাকে গেলেন মদের দোকানে পিকেটিং করতে। হঠাৎই রে রে করে ব্যাটন উঁচিয়ে তেড়ে এল আবগারি পুলিশ। বন্ধুরা পালাল লাঠির ভয়ে। একা বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন একরোখা বরাবরের জেদি সতীনাথ। পুলিশও থমকে গেল ছেলেটির সাহস দেখে। শুরু হল তর্কাতর্কি। পুলিশ পিছু হটল এই একলা ছেলেটির গনগনে চোখের সামনে থেকে। তার পর থেকেই দ্রুত বদলে যেতে থাকল নিভৃতচারী জীবন।

পিকেটিং তো ছিলই। সঙ্গে নিত্যদিন যোগ হল অন্য সব স্বদেশির কাজ। যে জন্য পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে পালাতেও হত প্রায়ই। পায়ে হেঁটে, নয়তো চুপিসাড়ে রাতবিরেতে ট্রেনে চেপে। অন্ধকারে মাইলের পর মাইল বিনা টর্চে জল কাদা মাড়িয়ে গিয়ে মিটিং করাও ছিল যখন তখন। দিনের মধ্যে খাওয়াদাওয়া বলতে শুধু স্বপাক সেদ্ধভাত। স্বদেশির টান তাঁকে এতটাই একরোখা করে দিয়েছে, বলতেন, “দেশের মানুষ যেদিন ভাল করে খেতে পাবে, সেদিন আমি নিজে ভাল খাবার খাব।”

রাজনীতিতে আসার পর জনপ্রিয়তা বিপুল। সকলেই ভাদুড়ীজি বলতে অজ্ঞান। দেশ স্বাধীন হল। তত দিনে তিনি কংগ্রেস মহলে, সাধারণ মানুষের কাছে বিপুল জনপ্রিয়। মন্ত্রিত্বের প্রস্তাব এল। সরাসরি বললেন, না। শুধু তাই নয় স্বাধীনতার জন্য তিন-তিনবার জেলখাটা সতীনাথ অবলীলায় সরে এলেন রাজনীতি থেকে। বন্ধুরা-পরিচিতরা অবাক। প্রশ্নে উত্তর দিলেন, “আর কী দরকার? দেশ স্বাধীন করার জন্য লড়াই করেছিলাম, স্বাধীন হয়ে গেছে, এবার রাজনীতিতে থাকলে ক্ষমতার লোভ আসবে মনের মধ্যে!”

১৯৬৫ সালের ৩০ মার্চ। আগের দিনই দাদা ভূতনাথ চিঠি পেয়েছেন সতীনাথের। চিঠিতে ভাই লিখেছে, ‘দাদা, আমি ভাল আছি।’ আর তার পরের দিন সকালে ‘বাবাজি’কে বাজারে পাঠালেন ভাল পাবদা মাছ আনতে। বাবুর জন্য জলখাবার তৈরি করে টেবিলে সাজিয়ে বাবাজি গেল বাজারে। শরীরটা আজ যেন বড় বেশি আনচান করছে সতীনাথের। হাতে জাগরীর ইংরেজি অনুবাদ ‘দ্য ভিজিল’ নিয়ে পায়চারি করতে বেরোলেন নিজের শখের বাগানে। বেশ কিছুক্ষণ পরে বাবাজি তার বাবুকে খুঁজতে এসে দেখলো, বাগানে সতীনাথ মুখ থুবড়ে পড়ে রয়েছেন তাঁরই হাতের তৈরি এক ফুলগাছের নীচে।




প্রফেসর পুরুষোত্তম চক্রবর্তী, কলকাতা থেকে






Share on Facebook               Home Page             Published on: 28-Sep-2020

Coming Events:



A day full of activities, games and fun.







Lakemba Blacktown Mascot
Minto Money raised so far





Lakemba Blacktown Mascot
Minto Money raised so far



Blacktown Lakemba Mascot
Minto Money raised so far







Blacktown Lakemba Mascot
Minto Money raised so far