bangla-sydney
bangla-sydney.com
News and views of Bangladeshi community in Australia













বরিশাল ভ্রমণের দুর্লভ স্মৃতি -
একটি ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার প্রতিবেদন

পুরুষোত্তম চক্রবর্তী



আমার পিতৃপুরুষ ও মাতার পূর্বপুরুষ উভয় দিকেরই আদি নিবাস ছিল তদানীন্তন পূর্ববঙ্গের বরিশাল জেলা। তখনও বঙ্গভঙ্গ হয়নি। পিতৃপুরুষের আদি নিবাস ছিল বরিশালের ঝালকাঠির অন্তর্গত বাদলকাঠি গ্রাম, আর মামাদের ছিল শিকারপুর। আমার মেঝ-মামীর বাবা স্বর্গত বরোদাকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন বরিশাল মিউনিসিপালিটির প্রাক্তন চেয়ারম্যান। শুনেছি, উনি খুব উদারচেতা মানুষ ছিলেন এবং বরিশাল তথা তদানীন্তন বাকেরগঞ্জ উপজেলার জন্য অনেক জনহিতকর কাজ করেছিলেন। সমগ্র বরিশাল ওঁকে যথেষ্ট সম্ভ্রম ও সমীহের চোখে দেখতো। তাঁর নাম এখনও বরিশাল মিউনিসিপালিটির পুরনো রেকর্ডে উল্লেখ আছে। আমার বাবা বি এম কলেজে কমার্স নিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন, যখন তাঁর বয়স ছিল আনুমানিক ষোল বছর। আমার দাদু (ঠাকুরদা) ১৯৪৫ সালের কিছু আগেই তদানীন্তন পূর্ববঙ্গ ছেড়ে সপরিবারে কলকাতায় চলে এসেছিলেন। তার পরে তাঁর পরিবারের কেউই আর কোনদিন তাঁদের জন্মস্থানে ফিরে যাননি। বাবা কলকাতায় এসে আমহার্স্ট স্ট্রিটের সিটি কলেজে পুনরায় কমার্স নিয়েই পড়া শুরু করেন এবং স্নাতক হবার পর একটি কেন্দ্রীয় সরকারি চাকুরীতে নিযুক্ত হন। কলকাতার অদূরে তদানীন্তন বিহারের ধানবাদ শহরে (এখন ঝাড়খণ্ডের অন্তর্ভুক্ত) তিনি তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। মা কলকাতায় পড়াশোনা করতেন। আমার জন্ম উত্তর কলকাতার শ্যামবাজার অঞ্চলে; বড়মামা সুকুমার চট্টোপাধ্যায় ওখানেই থাকতেন। পদার্থবিজ্ঞানের স্নাতক এই মামার কাছেই আমার মায়ের ছোটবেলা অতিবাহিত হয়েছিল। মেজ মামা প্রফুল্ল চট্টোপাধ্যায় লব্ধপ্রতিষ্ঠ রসায়নবিদ ছিলেন। প্রথম জীবনে তিনি আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় প্রতিষ্ঠিত বেঙ্গল কেমিক্যাল ও পরে ইষ্ট ইন্ডিয়া ফার্মাসিউটিক্যালস এ কেমিস্ট হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ইস্ট ইন্ডিয়া ফার্মাসিউটিক্যালস্ এ কর্মরত অবস্থায় তাঁর তৈরি 'এন্টারোকুইনল' ট্যাবলেটের নাম আজও অনেকের মুখে শুনতে পাওয়া যায়। তাঁর কৃতী সন্তানদের মধ্যে আমেরিকার প্রখ্যাত জীব-প্রত্নতত্ত্ববিদ শঙ্কর চট্টোপাধ্যায় ও স্বনামধন্য বাংলাব্যান্ড 'মহিনের ঘোড়াগুলি'র গৌতম চট্টোপাধ্যায় অন্যতম। আমার জন্মের কিছুদিন পরেই মা আমাকে নিয়ে বাবার কর্মস্থল ধানবাদে ফিরে যান এবং আমার সমগ্র বাল্যকাল ও স্কুলজীবন ধানবাদ - ঝরিয়ার কয়লাখনি অঞ্চলেই অতিবাহিত হয়।

বেশ কয়েক বছর আগে বাংলাদেশ ভ্রমণের সুবাদে বরিশালে গিয়ে কয়েকদিন কাটিয়েছিলাম। যাত্রা শুরু হয়েছিল চট্টগ্রাম থেকে। আগের দিন সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক প্রফেসর বিকিরণ প্রসাদ বড়ুয়া মহাশয়ের আমন্ত্রণে তাঁর নন্দনকাননের বাড়ীতে আমার অনাবিল আনন্দঘন একটি সন্ধ্যা কেটেছিল। প্রোফেসর বড়ুয়া এবং ওঁর স্ত্রীর অপরিসীম আন্তরিকতা ও আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়েছিলাম। অধ্যাপক বড়ুয়া মহাশয় চট্টগ্রামের একজন কৃতী মানুষ এবং বাংলাদেশ সরকারের দুর্লভ সম্মান “একুশে পদক” সম্মানে ভূষিত । একুশে পদক বাংলাদেশের জাতীয় ও দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননার পদক। মেধা ও মনন চর্চার ক্ষেত্রে বিশেষ কৃতী মানুষদের বাংলাদেশ সরকার এই সম্মানে সম্মানিত করে থাকেন। বৌদ্ধধর্মের প্রচার ও প্রসার দুটোতেই প্রোফেসর বড়ুয়ার প্রভূত কর্মকাণ্ড ও অবদান অনস্বীকার্য। সৌভাগ্যক্রমে ওঁর সঙ্গে বহুকাল বাদে আমার যোগাযোগ পুনস্হাপন হয়েছে, এই অপ্রত্যাশিত যোগাযোগ ঘটবার জন্য ঈশ্বরের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। আর একটা কথা না বললেই নয়, প্রোফেসর বড়ুয়া কলকাতার সাহা ইন্সটিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্স থেকে পি-এইচ-ডি করেছিলেন এবং সেই সূত্রেই ওঁর সঙ্গে আমার পরিচিতি বলা যেতে পারে। সাহা ইন্সটিটিউট ভারত সরকারের আণবিক শক্তি দপ্তরের অন্তর্গত একটি উল্লেখযোগ্য মৌলিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং আমার নিজেরও এই প্রতিষ্ঠানে গবেষণা ও অধ্যাপনার কার্যে জীবনের অনেকটা সময় অতিবাহিত হয়েছে।

পরের দিন সকালে চট্টগ্রাম থেকে বাসে করে কুমিল্লার চাঁদপুরে এসেছিলাম। মনে পড়ছে সেদিন সকাল থেকেই ভয়ঙ্কর প্রাকৃতিক দুর্যোগ শুরু হয়েছিল। অঝোর বৃষ্টির মধ্যে বাস ছুটছিল; মনে হচ্ছিল রাস্তাঘাট যেন বন্যায় প্লাবিত! কয়েক ঘণ্টা পর চাঁদপুরের লঞ্চঘাটে এসে পৌঁছলাম। প্রকাণ্ড একটি স্টিমারে করে মেঘনা নদীর মধ্য দিয়ে দীর্ঘ ১০/১২ ঘণ্টা জলসফর অতীব মনোমুগ্ধকর লেগেছিল। কখনো কখনো ভয়ঙ্কর মেঘনাকে আমার সমুদ্র বলে ভ্রম হচ্ছিল। লঞ্চে উঠবার আগে চাঁদপুরের লঞ্চঘাটের রেস্টুরেন্টে সদ্য রান্না করা ইলিশ মাছ সহযোগে গরম ভাত পরম সুস্বাদু লেগেছিল। রাত একটায় ষ্টীমার বরিশাল সদরঘাটে এসে পৌঁছালো। সদরঘাটের কাছাকাছি কোন একটি হোটেলে রাতটুকু কাটিয়েছিলাম। পরের দিন তৎকালীন বরিশাল মিউনিসিপালিটির চেয়ারম্যান এস এম ইকবাল সাহেবের সংস্পর্শে আসার সুযোগ আমার কাছে অপ্রত্যাশিত ছিল। তাঁর বিশেষ অভ্যর্থনা ও আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়েছিলাম। তাঁরই সূত্রে স্থানীয় এক প্রতিষ্ঠিত পুস্তক ব্যবসায়ী শ্রীযুক্ত তিনু সেন মহাশয়ের সঙ্গে পরিচিতি ঘটে। যে কদিন বরিশালে ছিলাম, তাঁর দোতলা বাড়ীর একখানা ঘর আমার জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছিল। ওঁর সৌজন্যে ও সহযোগিতায় বরিশাল সফরটি অতীব আনন্দময় হয়েছিল। বরিশালের বিখ্যাত সরকারী ব্রজমোহন কলেজ (বি এম কলেজ) পরিদর্শন করে গর্বিত বোধ করেছি। আমার পিতৃদেব স্বয়ং এই ঐতিহ্যবাহী মহাবিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন এবং সেই প্রতিষ্ঠানের ভিতরে আমি দাঁড়িয়ে আছি, এটা ভেবেই একরকম রোমাঞ্চ বোধ হচ্ছিল। শুনেছি, বি এম কলেজ এখন একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়েছে। আশ্চর্যের বিষয়, প্রফেসর বড়ুয়াও তাঁর সরকারী চাকুরীর প্রথম দিকে কিছুদিন এই কলেজের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগেই অধ্যাপনা করেছিলেন।

পিতৃভূমি বাদলকাঠি গ্রামে পৌঁছানোটা খুব সহজ ছিল না। বরিশাল শহর থেকে একটি গাড়ীতে করে ঝালকাঠি এসে পৌঁছলাম। ইকবাল সাহেবের সৌজন্যেই ঐ গাড়ীটির বন্দোবস্ত হয়েছিল। ঝালকাঠি একটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দর। বরিশালে নদীর প্রাচুর্য; তাই কত নদী যে পার হয়েছিলাম, তা মনে নেই। কথায় আছে “যাইতে শাল আইতে শাল; তার নাম বরিশাল”! বহু নদী, খালবিল না পেরিয়ে বরিশাল যাওয়া যায় না। নদীগুলোর উপরে কোন সাঁকো ছিলনা; নদীর মধ্য দিয়ে যে বিশালাকৃতি মোটরলঞ্চ পারাপার করতো, সেগুলোর পাটাতনের উপরেই মোটরগাড়ি বা বাস উঠে পড়তো। আশা করি অবস্থাটা এখন সেরকম আর নেই!

বাদলকাঠি গ্রামটি বলতে গেলে ঝালকাঠি শহর থেকে অনেক দূরের একটি অজপাড়া গাঁ। স্থানীয় মানুষদের অনেকের কাছে এটি এখনও অজানা। অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করে ও অনেকটা পথ অতিক্রম করার পর অবশেষে বাদলকাঠি গ্রামে পৌঁছালাম। বহুদিনের সুপ্ত বাসনা বাস্তবায়িত হওয়ার আনন্দে আত্মহারা ও বিহ্বল হয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু গন্তব্যস্হলে পৌঁছোবো কি করে? কিছুই তো চিনিনা বা কেউ যে সাহায্য করবে এমনও তো কোন উপায় নেই। খানিকটা নিরাশ হয়ে ভাবছিলাম, রণে ভঙ্গ দেবো কি না! এমন অবস্থায় কিছুটা দূরে চোখে পড়লো প্রায় আশি বছরের এক বৃদ্ধ চাচা তাঁর বাড়ীর সামনের একটি বাগান পরিচর্যা করছেন। কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “চাচা একটা বাড়ীর সন্ধান করছি, একটু সাহায্য করতে পারেন”? উনি জিজ্ঞাসা করলেন, “কোন জাগায় যাবা?” বললাম, “কাঠাইল্লা বাড়ী” । বাবা - কাকাদের কাছ থেকে তাঁদের বাড়ীর তো এই নামই শুনে এসেছি এতকাল ধরে। চাচা যেন চমকে উঠলেন, মনে হোল যেন ভূত দেখছেন। চিৎকার করে উঠলেন “কাঠাইল্লা বাড়ী! তুমি ক্যাডা?” গর্বিত স্বরে বললাম, “আমার ঠাকুরদাদা ছিলেন হীরালাল চক্রবর্তী”। যেন আচমকা তড়িৎপৃষ্ট হয়েছেন, চিৎকার করে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কার পোলা?” বাবার ডাকনাম ছিল শ্রীরাম, তাই বললাম, “বাবার ভালো নাম বিভূতি ভূষণ চক্রবর্তী, তবে নিকটজনেরা শ্রীরাম বলে ডাকে”। আরেকবার ভিরমি খাওয়ার মত অবস্থা, একরকম বাকরুদ্ধ অবস্থায় বলে উঠলেন “হায় আল্লা, এ আমি কি দ্যাখলাম! হিরালাল চক্রবর্তী কি যে ভালো মানুষ আছিল, তার আর কি কমু! আইজ তারই নাতি আমাগো শ্রীরামের পোলা আমার সামনে দাড়াইয়া রইছে; এডাও কি সম্ভব?” আমি বললাম, “তাড়াতাড়ি বলুন চাচা, কাঠাইল্লা বাড়ীটা কোথায়? আমার যে দেরী হয়ে যাচ্ছে”। চাচা দূরের দিকে তর্জনী নিক্ষেপ করে বললেন, “সোজা হাডতে থাকো। দুইটা মোড় পার কইরা তিন নম্বর মোড়ের ডাইন দিকে যাবা। অল্প এটটু গ্যালেই একটা সাদা রঙের দুই তলা মকান দ্যাখতে পাবা। ঐডাই তোমাগো 'কাঠাইল্লা বাড়ী'। চাচাকে ধন্যবাদ জানিয়ে ওনার নির্দেশিত পথ ধরে হাঁটতে থাকলাম।

প্রায় মিনিট পনেরো হাঁটবার পর বহু প্রতীক্ষিত সেই কাঠাইল্লা বাড়ীতে এসে উপনীত হলাম। একটি অতি বিবর্ণ দোতলা বাড়ি, জানলাগুলো আরও বিবর্ণ! জানলাগুলোয় কোন কাঠের পাল্লা নেই, চটের বস্তার টুকরো দিয়ে কোনরকমে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। বাড়ীর প্রধান ফটকের সামান্য কাছাকাছি আসতেই এক মাঝবয়েসী ভদ্রলোক এগিয়ে এসে একরকম হুঙ্কার দিলেন “কে আপনে? এখানে আইছেন কেন? কি চায়েন?” আমি বিনীত ভাবে জিজ্ঞেস করলাম, “আজ্ঞে, এটা কি কাঠাইল্লা-বাড়ী”? ভদ্রলোক আরও চেঁচিয়ে বললেন “হ, এডা কাঠাইল্লা-বাড়ী, আমারই বাড়ী। আমার নাম কাসেম আলী খান”। আমি বললাম, “আমি কলকাতা থেকে এসেছি, আমি কাঠাইল্লাবাড়ীর হীরালাল চক্রবর্তীর নাতি”। ভদ্রলোক তৎক্ষণাৎ যেন ভুত দেখার মত চমকে উঠলেন এবং একটু পরেই তারস্বরে চেঁচিয়ে বলে উঠলেন, “বাড়ীর মালিক আইসে, বাড়ীর মালিক আইসে; কে কোথায় আছো দেইখা যাও”। আমি লজ্জায় কানে হাত চাপা দিয়ে বললাম, “ছি ছি, এ কি বলছেন আপনি? দয়া করে চুপ করুন, আমায় লজ্জা দেবেন না। আমি বাড়ীর মালিক নই। আমি বাংলাদেশে বেড়াতে এসেছি, বরিশাল আমার পিতৃভূমি, তাই শুধু একবার আমার পৈত্রিক বাড়িটি নিজের চোখে দেখে চোখদুটো একটু সার্থক করতে চাই। এর বেশী কিছু নয়।” ভদ্রলোক নাছোড়বান্দা, বলতেই থাকলেন, “না না, তা বল্লে তো হয়না, আপনিই এই বাড়ীর মালিক। আমি ধইন্য, আপনি আইসেন। আসেন আসেন ভিতরে আসেন, আপনার ঠাকুরদাদার নিজের সৃষ্টি দেইখা যান”।

ঠাকুরদার নিজের হাতে তৈরি দোতলা পাকা বাড়ী, বিশাল মনোমুগ্ধকর ঘাট বাঁধানো দিঘী, আম জাম কাঁঠাল গাছ সম্বলিত কয়েকশো বিঘা জমি পরিদর্শন করে আপ্লুত হয়েছিলাম। মনে হোল, এরাও যেন আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে আমাকে সাদর অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করছে! দিঘীর শীতল জলে হাত মুখ প্রক্ষালন করে লাল সিমেন্টের বাঁধানো ঘাটে কিছুক্ষণ বসলাম। হঠাৎ চোখে পড়লো ঘাটের উপর খোদাইকৃত “বাঘবন্দি” খেলার ছক। কাসেম আলীকে জিজ্ঞেস করলাম, “এখানে বাঘবন্দি খেলার ছক আঁকা রয়েছে কেন?” কাসেম আলীর তৎক্ষণাৎ জবাব, “এখানে আপনার ঠাকুরমা, বড়জ্যেঠীমা, মেজজ্যেঠীমা সবাই মিলে রোজ দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর বাঘবন্দি খেলতেন”। মনটা কেমন যেন উদাস হয়ে গেল! শুনেছি, ঠাকুরদার বাবার পূর্বপুরুষেরা 'বন্দ্যোপাধ্যায়' ছিলেন; বিশাল সম্পত্তি ও কয়েকশো বিঘে জমি থাকার ফলে বৃটিশদের কাছ থেকে 'রাজচক্রবর্তী' উপাধি পেয়েছিলেন। সেই থেকে আমরা পরম্পরায় চক্রবর্তী পদবী ব্যবহার করে আসছি। বেশ কিছুক্ষণ ওখানে কাটিয়ে অন্তরে এক অনাবিল আনন্দ নিয়ে বরিশাল শহরে প্রত্যাগমন করলাম। তখন প্রায় রাত দশটা।

এর পরেও একাধিকবার বাংলাদেশে যাবার সুযোগ হয়েছিল বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (Bangladesh University of Engineering and Technolgy, Dhaka) থেকে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে; কিন্তু বরিশাল ভ্রমণের সেই তৃপ্তি আর কখনও আসেনি। আজও সেই স্মৃতি আমার মনের মনিকোঠায় উজ্জ্বল হয়ে বিরাজ করছে।

যখন বঙ্গভঙ্গ হোল ধর্মের ভিত্তিতে, তখন দুই বঙ্গের শান্তি বিঘ্নিত হোল ও পরিস্থিতি উত্তাল হয়ে উঠলো। সাম্প্রদায়িক অশান্তি মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। ক্রমে ক্রমে অবস্থা নিয়ন্ত্রণের বাইরে বেরিয়ে গেল। পূর্ববঙ্গের হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষদের মধ্যে নিজেদের জন্মস্থান ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার প্রবণতা শুরু হোল। তারপর, ১৯৪৭ সালের কিছু আগে ইংরেজ শাসনকালে ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান নামক একটি নতুন দেশের জন্ম হোল এবং সেই একই ধর্মের ভিত্তিতে পূর্ববঙ্গ পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হোল। নতুন নাম হোল “পূর্ব পাকিস্তান” এবং যথারীতি, সেটি ইসলামী দেশ - পাকিস্তানের অধীনে চলে এল। এর পরের অবস্থা সহজেই অনুমেয়। সাম্প্রদায়িক অশান্তি তীব্র থেকে তীব্রতর হোল। প্রাণের ভয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পূর্ব পাকিস্তান থেকে হাজার হাজার হিন্দু ভারতবর্ষে আসা শুরু করলো। অচিরেই তাঁদের ফেলে আসা জমিজমা বিষয় সম্পত্তি ওখানকার মুসলমান ধর্মাবলম্বী মানুষের দখলে চলে এল এবং সেগুলি “শত্রু সম্পত্তি” হিসেবে ঘোষিত হোল। লক্ষ লক্ষ হিন্দু ভিটেমাটি ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে উদ্বাস্তু হিসেবে বাস করা শুরু করলো এক নিদারুণ সঙ্কটের মধ্য দিয়ে! কালে কালে তাঁরা তাঁদের বিদ্যাবুদ্ধি এবং প্রতিভা কাজে লাগিয়ে ভারতীয় নাগরিক হিসেবে পশ্চিমবঙ্গে সুপ্রতিষ্ঠিত হোল এবং স্বভাবতই ওপার বাংলায় ফেলে আসা জমিজমা ও বিষয়সম্পত্তির প্রতি তাঁদের কোন আকর্ষণই আর রইলো না।

আমার ঠাকুরদা বিচক্ষণ মানুষ ছিলেন; তিনি অবিশ্যি আগেই অনুমান করতে পেরেছিলেন, তাই আগেভাগেই তিনি পূর্ব পাকিস্তান হবার বহু আগেই সপরিবারে পূর্ববাংলা ছেড়ে এই দেশে চলে আসেন। তিনি বা তাঁর পরিবারের সবাই বুকভরা দুঃখ ও‌ অভিমান নিয়ে সারাজীবন কাটিয়েছেন, তবু কোনদিন পূর্ববঙ্গ বা অধুনা বাংলাদেশে ফিরে যাবার কথা কল্পনাও করতে পারেননি।




প্রফেসর পুরুষোত্তম চক্রবর্তী, কলকাতা থেকে






Share on Facebook               Home Page             Published on: 1-Sep-2020

Coming Events:



A day full of activities, games and fun.







Lakemba Blacktown Mascot
Minto Money raised so far





Lakemba Blacktown Mascot
Minto Money raised so far



Blacktown Lakemba Mascot
Minto Money raised so far







Blacktown Lakemba Mascot
Minto Money raised so far