হেরোডটাসের ইতিহাসে ভারতবর্ষের বর্ণনা নৃপেশ পোদ্দার
গ্রীক লেখক হেরোডটাস তা’র ইতিহাস লিখেছিলেন প্রায় আরাই হাজার বছর আগে। যদিও বইটির মূল বিষয় পারস্য সম্রাটদের একাধিকবার গ্রীক আক্রমণ, তবুও অন্যান্য কয়েকটি দেশের কথা প্রসঙ্গক্রমে এই গ্রন্থে এসেছে। ভারতের কথাও এসেছে যেহেতু পারস্য সম্রাট সাইরাস (কুরু) ক্যামবাইসিস এবং দারায়ুস বা দারিয়াসের সৈন্যদলে বেশ কিছু ভারতীয় সৈন্য যুদ্ধ করেছিল (হয়তো ভাড়াটে হিসাবে) এবং ভারতবর্ষ থেকে বেশ কিছু রাজস্ব পারস্য বাজারে গিয়েছে। এর কারণ তদানীন্তন ভারতের উত্তর পশ্চিমাংশের বেশকিছু অঞ্চল বিশেষকরে গান্ধার এবং কাশ্মীর তাদের অধীনে ছিল।
যা হোক, আমি এ প্রবন্ধে হেরোডটাসের ভারতবর্ষ বর্ণনার কথা লিখছি। মনে রাখতে হবে যে হেরোডটাস কখনো ভারতবর্ষে আসেননি। তিনি লোকমুখে যা শুনেছেন তাই লিখেছেন। তখনকার দিনে যে কোন দেশেই অন্যদেশ সম্বন্ধে অনেক উদ্ভট গল্প প্রচলিত ছিল।
হেরোডটাস লিখেছেন: ভারতবর্ষ থেকে পারস্য সম্রাটের যে রাজস্ব আদায় হতো তা অন্য প্রদেশের তুলনায় অনেক বেশী এবং তা সোনা দিয়ে দেওয়া হতো। কারণ ভারতবর্ষে প্রচুর পরিমাণে সোনা পাওয়া যেত। ভারতবর্ষই তখনকার পরিচিত সভ্য জগতের পূর্বতম প্রান্তে অবস্থিত। সেখানে বহু বিচিত্র উপজাতির বাস। তা’রা বিভিন্ন ভাষায় কথা বলে। তা’দের পেশাও বিভিন্ন। কেও চাষবাস করে, কেও পশুপালন করে কেউবা যাযাবর। কোন কোন উপজাতি নদীর ধারে জলা জমিতে বাস করে। ওরা নৌকায় চেপে মাছ ধরে এবং কাঁচা মাছ খেয়ে বেঁচে থাকে। ওরা একরকম নলখাগড়া জলে পচিয়ে তার গা থেকে সুতো বার করে (পাট) তাদিয়ে বস্ত্র বানিয়ে বক্ষদেশ আবৃত করে রাখে। সে দেশের পূর্বতম প্রান্তে একটি উপজাতির লোক কাঁচা মাংস খেয়ে জীবন ধারণ করে।
তিনি আরো লিখেছেন যে, ভারতে বেশ কয়টি উপজাতির লোকের মধ্যে একটি অদ্ভুত প্রথা প্রচলিত আছে। তা’দের কোন আত্মীয় কোন রোগে অসুস্থ হলেই পরিবারের লোকেরা তাকে মেরে তা’র মাংস খেয়ে ফেলে, কারণ অসুস্থ ব্যক্তি বেশীদিন রোগে ভুগলে তা’র মাংস আর খাওয়ার মতো থাকবে না। অসুস্থ ব্যক্তি যদি বলে যে তার কিছুই হয়নি, সে সম্পূর্ণ সুস্থ তাতেও কোন ফল হয় না। তার আত্মীয় বন্ধুরা তা’কে বিশ্বাস করে না। কারো যদি দীর্ঘ জীবন হয় (সেটা কদাচিৎ ঘটে, কারণ কোন কোন রোগ যে কোন লোকের জীবনে একবার হবেই) তবে তা’র আত্মীয় বন্ধুরা তাকে জবাই করে উদর পূরণ করে।
আর একটি উপজাতি আছে যাদের জীবন যাত্রা সম্পূর্ণ বিপরীত। তা’রা কোন জীবের সামান্যতম অনিষ্ট করে না। এমনকি তারা খাদ্যের প্রয়োজনে সবজি বা ফলের জন্য কোন বীজ বপন করে না। পাছে মাটি খুড়তে গিয়ে কোন কীট পতঙ্গের মৃত্যু হয়। ওরা নিজ হাতে বাড়ী ঘরও বানায় না। এরা শাকসবজি খেয়েই জীবন ধারণ করে। ওদেশে এক ধরনের বন্য উদ্ভিদ জন্মায় যার কড়াইশুঁটির খোসার মত আধারে পোস্তের মত এক ধরনের বীজ হয়। ওরা সেগুলো সংগ্রহ করে জলে সেদ্ধ করে খায়। এই উপজাতির মধ্যে কোন ব্যক্তি যদি অসুস্থ হয়ে পড়ে তবে তার আত্মীয় বন্ধুদের ছেড়ে কোন নির্জন অরণ্যে চলে যায় এবং মৃত্যু পর্যন্ত সেখানেই থাকে। তা’র আত্মীয় বন্ধুরা তা’র কথা মন থেকে মুছে ফেলে। (পাঠক হয়তো অনুমান করতে পারছেন যে এটা নিশ্চয়ই জৈন ধর্মাবলম্বীদের বর্ণনা।)
তিনি লিখেছেন, ভারতের সব উপজাতির স্ত্রী-পুরুষই গরু-ছাগলের মত প্রকাশ্যে সর্বজন সমক্ষে রতিক্রিয়া করে। ভারতের সব মানুষের গাত্রবর্ণ একই রকম। অনেকটা ইথিওপিয়ার হাবসিদের মত ঘোর কালো বর্ণ। এর কারণ ভারতীয় পুরুষদের বীর্যের রং কালো! হাবসিদের ব্যাপারেও একই কথা বলা যায়।
ভারতের পূর্ব এবং দক্ষিণপ্রান্তের অধিবাসীরা পারস্যরাজ দারায়ুগের প্রজা নয়। ঐসব অঞ্চলের নিজস্ব রাজা রয়েছেন কিন্তু ভারতের উত্তর পশ্চিমের অধিবাসীরা প্রায় সবাই পারস্যরাজের প্রজা এবং তাদের জীবনযাত্রা অনেকটা ব্যাকট্রিয়াবাসীদের মত। (ব্যাকট্রিয়া অঞ্চল উত্তর আফগানিস্তান এবং দক্ষিণ উজবেকিস্তানের মাঝখানে তখনকার দিনে একটি গ্রীক উপনিবেশ ছিল) ওরাই ভারতবর্ষের সবচেয়ে যুদ্ধবাজ লোক। ওদের অঞ্চলের কাছেই মরুভূমি রয়েছে এবং ওরাই স্বর্ণরেনু সংগ্রহ করতে যায়। এইসব মরুভূমিতে একধরনের অস্বাভাবিক পিঁপড়ে থাকে যাদের প্রত্যেকের আকার শেয়ালের চাইতে একটু বড় এবং কুকুরের চাইতে একটু ছোট। এরকম কয়টি পিঁপড়ে ধরে পারস্য রাজের জন্তুর বাগানে রাখা হয়েছে। এই জন্তুগুলিও আমাদের দেশের ছোট পিঁপড়ের মত মাটির গর্ত বানিয়ে তার মধ্যে বাস করে। গর্ত বানাতে গিয়ে মরুভূমির পিঁপড়েগুলি প্রচুর পরিমাণে বালি ছুড়ে বিশাল স্তূপ তৈরি করে ফেলে। এই বালির সাথে প্রচুর স্বর্ণকনা মেশানো থাকে। এই স্বর্ণকনা মেশানো বালি সংগ্রহ করার উদ্দেশ্যেই উত্তরাঞ্চলের ভারতীয়রা মরুভূমি অঞ্চলের দিকে অভিযান চালায়।
সেই অভিযানের প্রস্তুতি সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, প্রতিটি লোক তিনটি উট পাশাপাশি একটি জোয়ালে বাঁধে। মাঝখানের উটটি হয় মাদী যে কিনা সদ্য সন্তান প্রসব করেছে। এই মাদী উটের পিঠেই মানুষটি সওয়ারী হয়। তা’র দুইপাশে থাকে দুটি পুরুষ উট। লোকটি বেশ কয়টি থলি সঙ্গে নিয়ে এমন সময় যাত্রা করে যাতে সে দিনের তপ্ত-তম সময়ে বালিস্তুপে পৌছতে পারে কারণ সে সময় পিঁপড়েরা শীতল হওয়ার উদ্দেশ্যে গর্তে গিয়ে বিশ্রাম করে। সঙ্গে আনা থলিগুলো বালিভর্তি করে লোকটি উটের পিঠে চেপে তড়িৎ গতিতে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করে। যদি বিলম্ব হয়ে যায় তবে পিঁপড়ের আক্রমণে তা’র অবধারিত মৃত্যু। পুরুষ উটগুলোর গতি যেহেতু একটু মন্থর তারা সবাই আগেই হাঁপিয়ে পড়ে। মানুষটি একে একে দুটি পুরুষ উটকে বন্ধনমুক্ত করে দেয় এবং তারা পিঁপড়ের শিকার হয়। সেই সুযোগে লোকটি পালিয়ে যেতে পারে কারণ মাদী উটটি তার সদ্যজাত সন্তানের কথা মনে রেখে তড়িৎ গতিতে ছুটতে থাকে। এই পদ্ধতিতে সোনা সংগ্রহ ছাড়াও ভারতীয়রা খনি থেকে বেশ কিছুটা সোনা উদ্ধার করে থাকে।
হেরোডটাস লিখেছেন, এসব বিবরণ থেকে এটাই প্রতিপন্ন হয় যে সভ্য জগতে প্রত্যন্তর দেশগুলিই খনিজ সম্পদে সবচেয়ে সমৃদ্ধ এবং সেসব দেশই উন্নত মানের বনজ সম্পদ এবং প্রাণীর জন্ম দেয়। আমার লেখা থেকে এটা সহজেই বোঝা যায় যে ভারতবর্ষ সভ্য জগতের সুদুরতম প্রাচ্যে অবস্থিত এবং ওখানেই জন্তু জানোয়ার এবং পাখী আকারে বৃহত্তম। শুধু ভারতীয় ঘোড়ার ক্ষেত্রে এ কথাটা খাটেনা। ওখানে সোনার পরিমাণ পৃথিবীর সর্ববৃহৎ। খনি থেকে তোলা, নদীর জলে ভেসে আসা স্বর্ণরেনু এবং পিঁপড়েদের কাছ থেকে চুরি করা মিলিয়ে।
ভারতবর্ষে একধরনের গাছ জন্মায় যাতে পশম (তুলা) উৎপন্ন হয় এবং সেই পশম সৌন্দর্যে এবং ব্যাবহারে যে কোন পশুর লোম দিয়ে বানানো পশমের চেয়ে অনেক উন্নত। ওখানে এক ধরনের চারাগাছ হয় যার ডাল (আখ) নিংড়ালে অতি সুমিষ্ট রস বেরয়।
এই ছিল মোটামুটি হোরোডটাসকৃত সেই কালের ভারতবর্ষের বিবরণ।
Professor Nripesh Podder , PhD, has lived most of his life in Australia teaching at Queensland University and The University of New South Wales. He has published extensively in academic journals.
|