পৃথিবীর প্রথম আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্মৃতিসৌধের দশম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উদযাপন
প্রাথমিক পরিকল্পনার খসড়া রূপরেখা নির্মল পাল
দেখতে দেখতেই দশটি বছর কেটে গেল। এইতো এসফিল্ড পার্কে সেই ২০০৫ সালের একুশের বইমেলা শেষে “শহীদ মিনার” প্রতিষ্ঠার আনুষ্ঠানিক ঘোষণার পর প্রায় একটি বছর সিডনির আকাশ-বাতাস একটি “শহীদ মিনার” নাকি তার আদলে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্মার্থে ‘অন্যকিছু' প্রতিষ্ঠার পক্ষ-বিপক্ষে আলোচনায় ছিল মহা-সরব। বিভিন্নধর্মী টানা আলোচনা-সমালোচনা, আশা-উদ্দীপনার নিরসন ঘটিয়ে মাত্র ১৫ মাসের ব্যবধানে এসফিল্ড কাউন্সিল, বাংলাদেশ সরকার এবং স্থানীয় মাতৃভাষা-প্রেমী সকলের সার্বিক ও সামগ্রিক সহযোগিতায় ১৯ই ফেব্রুয়ারি ২০০৬ পৃথিবীর সকল মাতৃভাষা সংরক্ষণের বার্তা নিয়ে বাংলার মহান “শহীদ মিনার” এর আদলে আন্তর্জাতিক সংস্করণে আনুষ্ঠানিকভাবে এসফিল্ড হেরিটেজ পার্কে প্রতিষ্ঠালাভ করে “পৃথিবীর প্রথম আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্মৃতিসৌধ”। আন্তর্জাতিক বলয়ে এটি যেমন বাঙালিদের গর্বিত নতুন অধ্যায় এবং ইতিহাস, তেমনি বাঙালিদের পক্ষ থেকে সকল ক্ষয়িষ্ণু মাতৃভাষা সংরক্ষণে মহান যুগান্তকারী প্রতিশ্রুতির প্রাতিষ্ঠানিক মাইলফলক। ‘সকল মাতৃভাষার প্রতীকী সংরক্ষণ’, ‘মহান একুশের চেতনা বিধৃত’, ‘বহুজাতিক সমাজ ও সংস্কৃতি পরিস্ফুটন’ ও ‘বিশ্বায়নের বৈশ্বিক বার্তা’ এই চারটি মহান বিষয়ের সম্মিলিত প্রকাশে বাংলাভাষাকে সর্বোর্ধে স্থান দিয়ে এবং মহান ‘শহীদ মিনার’কে বক্ষে ধারণ করে মাত্র তিন মিটার দীর্ঘ-প্রস্থ ও উচ্চতায় নির্মিত এই মহান স্মৃতিসৌধের নকশা, মহান ভাষা শহীদদের স্বর্ণখচিত নাম সহ প্রতিটি অংশ, পরিমাপ ও ব্যবহৃত উপাদান বিশেষভাবে অর্থবহ ও তাৎপর্যপূর্ণ। বিগত বছর গুলিতে এই স্মৃতিসৌধের পাদদেশে একুশের প্রথম প্রহরে প্রভাতফেরি, একুশে বইমেলা, একুশের চেতনা ভিত্তিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও বাঙালিদের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ছাড়াও এই ঐতিহাসিক স্মৃতিসৌধের মর্মবার্তা এখন পৃথিবীর সর্বত্র, একই চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে বিভিন্ন ভাবে গড়ে উঠছে একুশের চেতনার সম্প্রসারিত কার্যক্রম। তন্মধ্যে পৃথিবীর প্রতিটি লাইব্রেরীতে “একুশে কর্নার” প্রতিষ্ঠার কার্যকরী উদ্যোগ, কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়া স্টেটের সারে কাউন্সিলে মনুমেন্ট প্রতিষ্ঠাসহ প্রদেশের সর্বত্র যথাযথ মর্যাদায় একুশে উদযাপনে সরকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ, ক্যানবেরায় সকল ভাষাভাষীদের একুশের হাঁটা, বিশ্বায়নে শহীদ মিনার গ্রন্থের প্রকাশনা, ক্যানবেরা, টরেন্টো, নিউ ইয়র্কসহ পৃথিবীর বিভিন্ন শহরে স্মৃতিসৌধ নির্মাণের সক্রিয় উদ্যোগ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আসছে ১৯ই ফেব্রুয়ারি আমাদের অহংকারে বিধৃত আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে নির্মিত এই ঐতিহাসিক গর্বের স্মৃতিসৌধ ১০ বছর পূর্ণ করবে। শুরু হবে এর বিশ্বপ্রসারমুখি নতুন আরো একটি অর্থবহ দশক এবং একুশের চেতনার বৈশ্বিক প্রাতিষ্ঠানিকতা অর্জনের পথ সঞ্চারিত হবে সর্বত্র, সংযোজিত হবে আরো অনেক নতুন নতুন মাত্রা। স্মৃতিসৌধে বিধৃত নকশা, তথ্য ও উপাত্তের অর্থবহ ব্যপ্ততা-পরিধি নতুনভাবে আমদের একুশের চেতনাকে বিশ্বে আরও নন্দিত গর্বিত করে তুলবে। ক্ষয়িষ্ণু ভাষা রক্ষায় আমরা সকলের পাশে উদাহরণ হয়ে থাকব। বাঙালিদের যার যার অবস্থান থেকে প্রতিটি লাইব্রেরীতে “একুশে কর্নার” প্রতিষ্ঠার দর্শনের মত বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে সারা পৃথিবীতে বাঙালিরা নতুন ভাবে, ভিন্ন ধাঁচে, ভিন্ন মানে বিশেষ মর্যাদায় নিজেদের সামাজিক অবস্থান করে নেওয়ার সুযোগ পাবে এই প্রত্যাশা আমাদের সকলের। “পৃথিবীর প্রথম আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্মৃতিসৌধ” এর ১০ম বর্ষপূর্তির বর্ণীল আয়োজন হবে আমাদের এই প্রত্যাশার আনুষ্ঠানিক সূচনা মাত্র। অত্যন্ত গৌরব ও আনন্দের বিষয়, এসফিল্ড কাউন্সিল বিশ্বনন্দিত, ঐতিহাসিক এই অর্জনের দশম বর্ষপূর্তিকে সামনে রেখে সম্ভাব্য সকল ভাষাভাষীর অংশগ্রহণের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় নিয়েছে। এসফিল্ড কাউন্সিলের ২২শে সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত নীতিনির্ধারণী সভা সর্বসম্মতিক্রমে তিনদিনব্যপী দশম বর্ষপূর্তি উদযাপন অনুষ্ঠানের প্রস্তাব অনুমোদন এবং অনুষ্ঠানের প্রয়োজনে ১৯ ও ২০ ফেব্রুয়ারি তারিখে টাউন হল ব্যবহারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এবং ২১শে ফেব্রুয়ারি এসফিল্ড পার্কে যথারীতি অনুষ্ঠিতব্য একুশে বইমেলাকে আরো অর্থবহ বহু ভাষাভাষী ভিত্তিক করার লক্ষে অন্যান্য ভাষাভাষীদের পক্ষ থেকে বুক স্টলের ব্যবস্থা করায় উৎসাহিত করা হবে।
প্রাথমিক পরিকল্পনার খসড়া রূপরেখায় রয়েছেঃ
- প্রথম দিনে (উনিশে ফেব্রুয়ারি, শুক্রবার)ঐতিহাসিক স্মৃতিসৌধের নকশা এবং একুশের চেতনার উজ্জীবিত করে অন্যান্য ভাষাভাষীকে মাতৃভাষা চর্চা ও সংরক্ষণে উৎসাহী করাকে প্রাধান্য দিয়ে আলোচনায় স্মৃতিসৌধ বাস্তবায়নের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত ব্যক্তিত্ব, স্থানীয় কমিউনিটি নেতৃবৃন্দ, শিক্ষাবিদ, গবেষক, নীতি নির্ধারক, প্রশাসক এবং বিশিষ্ট রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যক্তিত্ব আমন্ত্রিত হবেন।
- দ্বিতীয় দিনে(বিশে ফেব্রুয়ারি, শনিবার)মাতৃভাষা সমূহের প্রদর্শনী ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড এবং এসফিল্ড লাইব্রেরীতে প্রথম “একুশে কর্নার” উদ্বোধনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। এই দিনে স্থানীয় স্কুল এবং শনিবারে পরিচালিত ভাষাভিত্তিক স্কুল সমূহের ছাত্রছাত্রীদের সহযোগিতা ও অংশগ্রহণে মাতৃভাষা প্রদর্শনীসহ সংশ্লিষ্টদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং এসফিল্ড লাইব্রেরীতে প্রথম “একুশে কর্নার” উদ্বোধন। উল্লেখ্য, লাইব্রেরীতে “একুশে কর্নার” দর্শনটি “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্মৃতিসৌধ” প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি বাস্তবায়নের পরিকল্পনা থাকলেও তা বিভিন্ন জটিলতায় সফলতার মুখ দেখে নাই।
- তৃতীয় দিনে (একুশে ফেব্রুয়ারি, রবিবার) একুশে একাডেমীর নেতৃত্বে গতানুগতিক বইমেলায় অন্যান্য ভাষাভাষীদের বইয়ের স্টল অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে দিবসটির আন্তর্জাতিকতার নতুন আমেজ ও ভিন্ন ভাষাভাষীদের সমাগমের সামগ্রিক পদক্ষেপ গ্রহণ করার পরিকল্পনা রয়েছে।
প্রাক্তন উপ-প্রধানমন্ত্রী মাননীয় এন্থনি আলবেনিজি এমপি’র প্রতিশ্রুতিঃ
মনুমেন্ট প্রতিষ্ঠার দশম বর্ষপূর্তির অর্থবহ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সকল মাতৃভাষা চর্চা ও সংরক্ষণের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি সকল ভাষাভাষীসহ জাতীয় পর্যায়ে উত্তরণের একটি বিশেষ সুযোগ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন প্রাক্তন উপ-প্রধানমন্ত্রী মাননীয় এন্থনি আলবেনিজি এমপি। গত ২৯ সেপ্টেম্বর’১৫ তার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত পূর্ব নির্ধারিত সভায় তিনি এই অনুষ্ঠানকে সফল করার জন্য তাঁর পক্ষ থেকে সর্বাত্মক সহায়তার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করে অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হিসেবে মহামান্য গভর্নর জেনারেল অথবা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানানোর পরামর্শ দেন। তাছাড়াও তিনি মনুমেন্ট প্রতিষ্ঠার দশম বর্ষপূর্তির আগেই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসকে সরকারিভাবে সর্বত্র যথাযথ মর্যাদায় উদযাপনের লক্ষে নীতি নির্ধারণের বিষয়টি, এবং সকল লাইব্রেরীতে “একুশে কর্নার” প্রতিষ্ঠা কিভাবে করা যায় তার একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা আমাদেরকে অবহিত করার আশ্বাস প্রদান করেন। অধিকন্তু তিনি ক্যানবেরাস্থ জাতীয় লাইব্রেরীতে আসছে একুশে ফেব্রুয়ারি “একুশে কর্নার” প্রতিষ্ঠার সূচনা করা সহ ব্যাপক প্রচারণার মাধ্যমে বিষয়টি সংশ্লিষ্ট সকলের নজরে আনার সম্ভাব্যতা যাচাই করে দেখবেন বলে আমাদেরকে অবহিত করেন।
“একুশ” বাঙালির অহংকার। “একুশ” আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে বিশ্ববাসীর অধিকার। “আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্মৃতিসৌধ” প্রতিষ্ঠা “একুশে চেতনা”র বিশ্বায়নের প্রতীকী অঙ্গীকার। আসুন সবাই মিলে একযোগে মহান একুশের চেতনাকে কাজে লাগিয়ে ক্ষয়িষ্ণু সকল মাতৃভাষা রক্ষার পবিত্র দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসি।
নির্মল পাল, সিডনি
|