bangla-sydney
bangla-sydney.com
News and views of Bangladeshi community in Australia












প্রিয় মামুন এবং হায়দার হোসেন ...
(২০০৯ সালের ২৫শে ফেব্রুয়ারীতে পিলখানায় আর্মি অফিসার হত্যাকান্ড স্মরনে)

১৯৭৩ সালের এক বিকেলে, মামুনের সাথে আমার প্রথম পরিচয়। আমরা তখন ৩৩৯ নম্বর এলিফেন্ট রোডে থাকি। হাসিখুশী মামুন ছিল, খুবই উইটি, ওরা থাকতো ৩২৯ নম্বরে। একদিনেই ও আমার ভাল বন্ধু হয়ে যায়! আমরা একসাথে টিচার্স ট্রেনিং কলেজ আর ঢাকা কলেজ এর মাঠে ফুটবল আর হকি খেলতাম, ঘুরে বেড়াতাম এলিফেন্ট রোড,নিউমার্কেট আর নীলক্ষেত এলাকায়। কুয়াশা আর দস্যূ বনহুর বই কিনতাম বলাকার সামনে থেকে; আর চলতো সমানে আড্ডা আর জোকস।

পরের বছর মামুন চলে যায়, ঝিনাইদাহ ক্যাডেট কলেজে এবং আমাদের বন্ধুত্তে কিছুটা ভাটা পরলেও, ওর ছুটির সময়ে আবার জমে উঠতো নন ষ্টপ আড্ডা আর জোকস! এর ই মধ্যে মামুন্রা চলে আসে আরো কাছে, দুই বাসা পরে ৩৩৭ নম্বরে। ৩৩৬ আসেন নতুন ভাড়াটিয়া, কর্নেল তাহের (অবসরপ্রাপ্ত), বীর উত্তম! তিনি ছিলেন ড্রেজার সংস্তার চেয়ারম্যান। সাধারনত নারায়নগঞ্জ এ থাকতেন। বাসায় প্রধানত থাক তো আমাদের চেয়ে পাচ ছয় বছরের বড়, উনার দুই ছোট ভাই, বাহার ও বেলাল। দুই বীর প্রতীক! ১৯৭৫ সালের ৭ ই নভেম্বর সকালে এই বাড়িটি ই হয়েছিলো বাংলাদেশের রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু! (১৯৭৫ এর পরে দেখি, মামুনের যে মামা আর্মিতে ছিলেন, তিনি আর্মির ডেপুটি চীফ হয়েছেন, নাম এইচ, এম এরশাদ! আর মামুন্দের আগের বাসা, ৩২৯ নম্বরে নতুন ভাড়াটিয়া হিসাবে আসেন; ৭৫ এর ৩রা নভেম্বরের অভ্যূথানের মূল চালিকা শক্তি কর্নেল শাফায়াত জামিল, বীর বিক্রম। যিনি ৪৬ ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেড কমান্ডার হিসাবে ৭৫ এর খুনীদের বিরূদ্ধে প্রথম থেকেই শক্ত অবস্তান গ্রহন করেন)।

১৯৭৮ সালের এক সকালে দেখি, তিন বন্ধু নিয়ে মামুন উপস্তিত! কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই বলল, দুষ্টামির জন্য কলেজ থেকে বের করে দিয়েছে, এখন ঢাকা কলেজে ভর্তি হয়েছে (যতদুর মনে পড়ে, মামুন ম্যাট্রিকে স্ট্যান্ড করেছিল)। নিজেদের বাসা থাকা সত্ত্বেও, থাকার জায়গা খূজ়ছে ঢাকা শহরে! আমি হতাশ হয়ে বললাম, ছোট বেলা থেকে এতো কুয়াশা, দস্যূ বনহুর আর মাসুদ রানা পরেও শেষ রক্ষা করতে পারলে না!! কী শিখলা জীবনে? (এরই মধ্যে, ক্লাস এইট নাইনেই আমারা দুই জনই নিজেদের আপগ্রেইড করেছি, কুয়াশা, বনহুর থেকে মাসুদ রানায় সুইচ করেছি)।

তার পর এইচ, এস, সি পাশ করে আমি ভর্তি হলাম বুয়েটে আর এক বছর পর মামুন চলে গেল আর্মিতে, এইটথ লং এ। আমাদের মধ্যে অন এন্ড অফ যোগাযোগ হতো। ৮০ র দশকের প্রথম দিকে ও থাকতো আমাদের বাসার পাশে অফিসার্স মেস বি তে। তখন প্রায়ই বাসায় আসতো লম্বা ফোন করতে, কথা বলতো ওর উড বি ওয়াইফ এর সাথে। আমাদের ফোনে লম্বা তার লাগানো হল, যাতে ও আমার রুমে ফোন এনে কথা বলতে পারে উইদাউট ডিস্টারবেন্স। সেই সব কত মজার স্মৃতি! ওর ব্যাবহারে কোন দি্ একবারের জন্য ও মনে হয় নাই যে, ওর আপন মামা, প্রেসিডেন্ট এরশাদ।

২০০৫ সালের ডিসেম্বর মাসে ষ্টাফ কলেজে মামুনের সাথে শেষ বারের মত দেখা হয়, ও তখন লেঃ কর্নেল, ষ্টাফ কলেজের সিনিয়র ইন্সট্রাক্টার, আগের মতই উইটি! অনেক বছর পরে, আবার সেই আড্ডা আর জোকস। এবার ওর অফিসে, কাজের ফাকে ফাকে আড্ডা বা আড্ডার ফাকে ফাকে কাজ়! ঢেকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে! ওর অফিস থেকে বিদায়ের সময় বললাম, মামুন আসি। ও স্বভাব সূলভ ভঙ্গিতে, হাসতে হাসতে বলল, এমন ভাবে বলছ যেন আর কোনোদিন দেখা হবে না!

২০০৯ সালের ২৫ শে ফেব্রুয়ারী, আমার বন্ধু, মামুনকে আরো অনেক আর্মি অফিসারের সাথে, নিরস্ত্র অবস্তায় নরপশুরা নির্মম ভাবে পিলখানায় বি ডি আর এ হত্যা করে। আরো হত্যা করে আমদের ইউ ল্যাব স্কুলের এক বছরের জুনিয়র আকিল কে। আকিল থাকতো এলিফেন্ট রোড সিগ্ন্যাল বাতির কাছে, মজুমদার হাউস এ। আমি এই মুহূর্তে আকিলের ভাল নাম মনে করতে পারছিনা, আকিল লেঃ কর্নেল পদে ছিল, সেই সময়। আর্মিতে মামুন কে সবাই চিনতো কর্নেল এলাহী বলে। ওর পুরো নাম, রহমান সফিক কুদরত এলাহী। রংপুরের সেক্টর কমান্ডার মামুনের কিছু দিনের মধ্যেই ব্রিগেডিয়ার হওয়ার কথা ছিল!

কিছুদিন আগে প্রত্যয়ে জাগরনে অনুষ্ঠানে হায়দার হোসেন ও সায়ান এর গান শুনছিলাম। গানের মাঝে মাঝে আসছিলো দর্শকদের ফোন। অনেক দর্শক অনুরোধ করছিলেন, হায়দার হোসেন এর বি ডি আর এর ঘটনার উপর লেখা ও গাওয়া, গান টির জন্য। অনষ্ঠানের একদম শেষে হায়দার হোসেন গাইলেন তার সেই হৃদয়স্পর্শী গানটি।

আমি চিৎকার করিয়া কাদিতে চাহিয়া
করিতে পারিনি চিৎকার
বুকের ব্যাথা বুকে চেপে
নিজেকে দিয়েছি ধিক্কার

বি ডি আর এর ঘটনার উপর এর চেয়ে আরও উপযুক্ত কোনো গান লেখা সম্ভব কি না তা আমার জানা নেই! তবে এর সাথে, লেডি ডায়ানার মৃত্যূর পর এল্টন জনের গাওয়া কান্ডেল ইন দ্য উইন্ড গানটির (নতুন করে পাওয়া জনপ্রিয়তা) অথবা এভিটার (ইভা পেরন) মৃত্যূর পর লেখা ডোন্ট ক্রাই ফর মি, আর্জেন্টিনা গান দুটির তূলনা করা যেতে পারে।

ধন্যবাদ, প্রিয় হায়দার হোসেন, এই অসাধারন গানটি সৃষ্টির জন্য। আমিও অনেক বছর ধরে আপনার মতো চিৎকার করে কাঁদিতে চাহিয়া, পারিনি করিতে চিৎকার। আপনার মতো আমিও, নিজেকে দিয়েছি ধিক্কার! আমরা নির্লজ্জ জাতি,আমাদের চামড়া গন্ডারের চেয়েও মোটা। আমরা নির্মমতায় আভস্ত্য। আমাদের দেশ সত্যিই এক অদ্ভুত দেশ। শাস্তি পাওয়া তো দূরের কথা, এই দেশে খুনীরা অতীতে পেয়েছে পুরস্কার! আর তাই, বার বার এই ধরনের নির্মমতার পুনরাবৃত্তি ঘটে আসছে এই দেশে; কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে, বি ডি আর এর ভিতরে।

মামুনের পরিবারের অনেকেই আমার খুব কাছের। ওর ছোট বোনের হাসব্যান্ড খোকন, আমার ছোট বেলার বন্ধু। ফোনে খোকনের সাথে কথা বলার সময় আমি বুঝতে পেরেছিলাম ওদের হৃদয়ের রক্তক্ষরন। তখন আমার চোখে ভাসছিলো, আমার বুয়েটের সহপাঠি ও রুমমেইট এ, এইচ, এম এহসানুজ্জামান (স্বপন) এর কথা। স্বপন, কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে ৩ রা নভেম্বর ১৯৭৫ সালে অন্য তিন জাতীয় নেতার সাথে নির্মম ভাবে নিহত, জাতীয় নেতা, এ, এইচ, এম কামরুজ্জামানের ছোট ছেলে।

কোন ইনডেমনিটি আইন এর বাধা ছিল না, জেল হত্যার মত বর্বর ও পৈশাচিক হত্যাকান্ডের বিচারের পথে। তারপরেও, অন্য তিন জাতীয় নেতা সহ, স্বপন এর বাবার হত্যাকারীদের বিচার হওয়াতো দুরের কথা, তাদেরকে পুরস্কৃত করা হয়েছিলো! তাদের কৃতকর্মের পুরস্কার হিসাবে দেওয়া হয়েছিল, রাষ্ট্রদূতের মতো সম্মানজনক ও লোভনীয় চাকুরী!! না; সত্যিই বড় নির্লজ্জ এই জাতি।

৭৫ ট্রাজেডির পর, শুধু মাত্র একজন সাহসী মানুষ, অধ্যাপক আবুল ফজল, প্রতিবাদ স্বরূপ লিখেন তার সেই বিখ্যাত গল্প, মৃতের আত্মহত্যা। যা তৎকালীন সরকার নিষিদ্ধ ঘোষনা করেন!! সেই কারনেই অধ্যাপক আবুল ফজল গল্পের এর বক্তব্য ব্যাপক জনসাধারনের কাছে পৌছায়নি। আর কবি নির্মলেন্দু গুনের সেই বিখ্যাত কবিতা, সেই রাতের কল্পকাহিনী বর্ননা করেছিল সেই রাতের নির্মমতাকে, যা শুধুমাত্র শিক্ষিত সমাজের একাংশের কাছে আবেদন রাখতে পেরেছিল। কিন্তু বড়ই অভাব ছিল একটি গানের, যা ব্যাপক জনগোষ্টীকে উদ্বুদ্ধ করতে পারতো বিচারের দাবীতে।

হায়দার হোসেন, আপনার এই গান, লং ওভার ডিউ। কতগুলি গান শুধু গান ই নয়, তার চেয়ে অনেক বেশী কিছু। আপনার গান আমাদের বিবেক কে শুধু নাড়া নয়, ঝাকুনি দিয়েছে আর আপনার বক্তব্য পৌছে গ্যাছে বা এখনো যাচ্ছে কোটি মানুষের কাছে। প্রত্যয়ে জাগরনে অনুষ্ঠানে আপনি বলেছেন, আপনি এই গানটা গাইতে চান না কারন বেশী ভালবাসা ক্ষোভ এবং সেই থেকে প্রতিহিংসার জন্ম দেয়।

প্রিয় হায়দার হোসেন, আমরা প্রতিহিংসা নয়, বিচার চাই। আপনার এই গান ব্যাপক জনগোষ্টীকে উদ্বুদ্ধ করবে বিচারের দাবীতে। এই হত্যাকান্ডের দ্রুত বিচার ও কঠোরতম শাস্তি কার্যকর করা হলে ভবিষ্যতে এই ধরনের হত্যাকান্ডের সম্ভাবনা অনেক কমে যাবে। আমরা সবাই জানি, ইনজাস্টিস এনি হোয়ার, ইজ আ থ্রেট টু জাস্টিস এভরি হোয়ার। কথাটা আমাদের দেশের জন্য খুব বেশী প্রযোজ্য। তাই আমাদের দেশে এই ধরনের নির্মমতা চিরকালের জন্য বন্ধ করতে হবে। আর বন্ধের জন্যই প্রয়োজন দ্রুত বিচার, কারন জাস্টিস ডিলেইড মিন্স জাস্টিস ডিনাইড।

আমরা খুব দ্রুত সব কিছু ভুলে যাই!! আমাদের ঝিমিয়ে পড়া বিবেক কে জাগাতে আপনার এই গান টনিকের মতো কাজ করে চলেছে। প্রিয় হায়দার হোসেন, আপনার কাছে এই অনুরোধ, যতদিন বি ডি আর হত্যাকান্ড সহ, এইধরনের অন্যসব নির্মম হত্যাকান্ডেরর দ্রুত বিচার না হয়, ততদিন অবশ্যই এই গানটা গাইতেই থাকবেন। আপনার এই গান, প্রতিবারই আমাদের মনে করিয়ে দেয় এই ধরনের বর্বরতার, নির্লজ্জতার, নির্মমতার চির অবসান হওয়া কত জরুরী।

নাজমুল আহসান শেখ, প্রকৌশলী, রাজনৈতিক বিশ্লেষক, ফেব্রুয়ারী ২০১০, সিডনী

victory1971@gmail.com





Share on Facebook               Home Page             Published on: 25-Feb-2010

Coming Events:



A day full of activities, games and fun.







Lakemba Blacktown Mascot
Minto Money raised so far





Lakemba Blacktown Mascot
Minto Money raised so far



Blacktown Lakemba Mascot
Minto Money raised so far







Blacktown Lakemba Mascot
Minto Money raised so far