সীমার মাঝে অসীম তুমি ফওজিয়া সুলতানা নাজলী
ছোটবেলায় মার কাছে শেখা “মেঘের কোলে রোদ হেসেছে বাদল গেছে টুটি / আজ আমাদের ছুটি ও ভাই আজ আমাদের ছুটি...”। শৈশবে মনের উপর দিয়ে কত কিছু ভেসে চলে যায়, যার চিহ্ন পরে খুঁজে পাওয়া যায় না, আবার অনেক কিছু অন্তরের গভীরে স্থায়ী হয়ে থকে। তেমনি এই কবিতাটি শেখার ক্ষণটি আজও আমার মনে আছে এখনও চোখ বন্ধ করে দেখতে পাই আম্মার কোলে বসে কবিতাটি শিখছি। এই কবিতাটির মতো শৈশবে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন আমার কাছে মিষ্টি স্নিগ্ধতা। কিশোরী-বেলায় তার উজ্জ্বলতার কাছে এসে তাকে একটু একটু করে চিনতে শুরু করেছি।
কবি গুরুর কাছ থেকেই পাখীর ডাক শুনতে শিখেছি। তার লেখা পড়ে নিজেকে জাগিয়ে তোলার প্রেরণা খুঁজে পেয়েছি। বনের পাখীর মতো মনের আনন্দে ডানা মেলে উড়তে শিখেছি। রবীন্দ্রনাথের অনেক ভক্তের মতো আমিও তার মুগ্ধ ভক্ত। আমার মনটা ঘুরতো তার গান কবিতার জগতে। মনে মনে তার উপস্থিতির সৌরভে আমোদিত প্রজাপতির মতো পাখা মেলে হাওয়ায় ঘুরে বেড়াতাম। বড় হতে হতে পড়ে পড়ে জেনেছি তিনি জীবনে বারে বারে পেয়েছেন মৃত্যু শোক আর অপমান । অসম্ভব এক রকমের বিষণ্ণতা ছড়িয়ে গিয়েছিল বুকের মাঝে। কিন্তু কি অদ্ভুত! জীবনকে তিনি বিরামহীন করে তুলেছিলেন লেখার অবিশ্রান্ত ফোয়ারা ঝরিয়ে।
রবীন্দ্রনাথকে আমি শুধু কোন বিশেষ দিনেই স্মরণ করিনা জীবনের এমন কোন দিন নাই যেদিন তাকে আমার মনে পড়ে না। মনের সবরকম অনুভূতিতে তিনি উপস্থিত। কখন তার লেখা মনকে শান্ত রাখে, কখনো মনকে শক্তি দেয় আবার কখনো মনের আনন্দকে আরও দ্বিগুণ বাড়িয়ে দেয়। চারপাশের জীবনের কালিমা আর যন্ত্রণা মুছে যায় তার কবিতায়। তার গান আমাদের প্রাণের ভাষা, নির্জনতার সঙ্গী। তার গান চিরবিস্ময় যা পুরাতন হয়েও চিরনতুন। যা অন্তরকে আলোকিত করে, যার প্রতি আকর্ষণ অনিঃশেষ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আজ নেই। কিন্তু ভাষার মাঝে নিজেকে এমন করে বেঁধে রেখেছেন যে মনে হয় এই তো তিনি। তিনি নিজে যা দেখতেন অন্যকে তাই দেখাবার চেষ্টা করতেন। তার দেখার ভঙ্গিই ছিল অন্য রকমের, যা আমাদের সাধারণ মানুষের নাগালের বাহিরে। তার লেখনী কখনো হাস্যরসে, কখনো গম্ভীর মাধুর্যে, কখনো ছন্দের হিল্লোলে আমাদের প্রাণকে আলোড়িত করে তুলে। মনের ক্লান্তি তার গানের সুরে ডুব দিয়ে স্নিগ্ধ হয়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনের দ্বিতীয়ার্ধের বেশীরভাগ সময় কেটেছে শান্তিনিকেতনে। তিনি গ্রাম ও শহর-জীবনের বিচ্ছেদ ভাবনায় কাতর হয়ে, দেশীয় শিল্প সংস্কৃতি বাঁচানোর তাগিদে শান্তিনিকেতন ও শ্রীনিকেতন গড়েছিলেন। কলেজে পড়ার সময় প্রমথনাথ বিশীর শান্তিনিকেতনের উপর লেখা 'পুরানো সেই দিনের কথা' বইটা পড়েছিলাম। সেই সময় থেকে শান্তিনিকেতনে যাওয়ার ইচ্ছেটা মনের কোনায় উকি দিতে শুরু করেছিল। সময় বহমান নদীর মতো, বহে গেছে তার আপন গতিতে। শান্তিনিকেতনে আমার আর যাওয়া হয় নাই। কিন্তু যখন গেলাম পরপর দুবছর গেলাম। বোলপুর স্টেশনে শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেস ট্রেনটা এসে থামলো। মনটা আনন্দে নেচে উঠলো। যে আনন্দ 'ছড়িয়ে গেল সবখানে সবখানে'। অপেক্ষমাণ গাড়ীতে উঠলাম। অনুভূতিটা যেন কেমন সত্যিই আমি এসেছি আমার স্বপ্ন-পুরিতে! পরেরদিন সুন্দর সকালবেলায় শান্তিনিকেতনে আসলাম। আমার চোখের কোণায় কেমন কেমন যেন করতে লাগলো। সেটা কি আনন্দ অশ্রু! মনে হলো দু’হাত বাড়িয়ে শান্তিনিকেতন যেন আলিঙ্গন করে নিল আমাকে।' নীল দিগন্তে ঐ ফুলের আগুন লাগলো লাগলো'। আশ্চর্য সুখে আমার মন ভরে রয়েছে যেন 'আনন্দ সাগরে' ভাসছিলাম।
ছাতিম-তলায় সেই পাথরের ফলকের কাছে এসে দাঁড়ালাম যেখানে লেখা আছে 'তিনি আমার প্রাণের আরাম, মনের আনন্দ, আত্মার শান্তি'। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ঈশ্বরকে বলেছিলেন! কোন মানুষ কি এমন হয়! কি জানি!
কবিগুরু যার নাম ‘অণিমা’ থেকে কণিকা রেখেছিলেন, যার গানে মুগ্ধ হয়ে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ডাকতেন 'আকবরী মোহর' সেই কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় এর বোনের ছেলে প্রিয়ম মুখোপাধ্যায়। সবার প্রিয় 'পম'। তিনি আমাদের সংগে শান্তিনিকেতন ঘুরে বেড়িয়েছেন। আমার কৌতূহলই মনের কৌতূহল মিটিয়েছেন।
শান্তিনিকেতন ভ্রমণের সময় বারবার মনে আসছিল কবিগুরু লিখেছিলেন 'যখন রব না আমি মর্ত্য কায়ায় তখন স্মরিতে যদি হয় মন, তবে তুমি এসো হেথা নিভৃত ছায়ায়, যেথা এই চৈত্রের শালবন'।
নন্দলাল, রাম কিংকরের দেয়ালচিত্র, মুরাল দেখে যার পর নাই বিস্মিত হয়েছি। কবিগুরুর প্রিয় উত্তরায়ণ ঘুরে দেখা রোমাঞ্চকর এক অনুভূতি। প্রতিটি মূহুর্ত অনুভব করছিলাম তার পদচারণা। বার বার মনে হচ্ছিল এই বুঝি তিনি এ বাড়ি থেকে তার আরেক বাড়ীতে যাচ্ছেন। আমার কল্পনায় তাকে উদ্ভাসিত হতে দেখলাম। 'কোথায় তিনি?' 'তোমার গীতি জাগালো স্মৃতি / নয়ন ছলছল ছলিয়া'! সেদিন সারা বেলা শান্তিনিকেতন আমার খুব আনন্দে কেটেছিল। এ যেন নিজেকে বিলীন করে দেয়ার মতো মনোমুগ্ধকর অভিজ্ঞতা।
কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় পমকে সন্তান-তুল্য ভালোবাসতেন। পম কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাসা দেখাতে নিয়ে গেলেন। শান্তিনিকেতনে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ীর নাম 'আনন্দধারা'। দেয়াল জুড়ে কণিকার বিভিন্ন বয়সের অসামান্য ছবি। পলকহীন দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে থেকেছি তার ছবির দিকে। বার বার মনে হচ্ছিল এই বাসায় এক সময় কতো মানুষের আনাগোনা ছিল আর কণিকা হয়ত গাইতো 'আনন্দধারা বহিছে ভুবনে....'। কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কন্ঠমাধুর্য ছিল। কিন্তু তাছাড়াও কিছু ছিল। তার গলায় ভালবাসা ছিল। যে গান তিনি গাইছেন তার প্রতি ভালবাসা। সেই গানের স্রষ্টার প্রতি ভালবাসা। তার কণ্ঠে আমার অসম্ভব একটি প্রিয় গান 'দূরে কোথায় দূরে দূরে, আমার মন বেড়ায় গো ঘুরে ঘুরে...'। গানটি আমাকে বিস্তীর্ণ মাঠ পেরিয়ে কোন সুদূরে নিয়ে যায়। অপূর্ব আবেশে মনটা ভরিয়ে দেয়।
পমদের বাসায় আমাদের নিমন্ত্রণ ছিল। পমের মা বীথিকা মুখোপাধ্যায় যাকে রুনুদি ডেকেছিলাম। বাবা নবকুমার মুখোপাধ্যায় নবদা। যিনি কবি গুরুর স্নেহাস্পর্শ পেয়েছিলেন। তাদের বাসার খোলা বারান্দায় বসে অনেক গল্প করেছিলাম। আমার মনের এদিক ওদিক যত কৌতূহল ছিল তাদের স্নেহাস্পর্শ দিয়ে আমায় তা বলেছেন। সেদিন ছিল জ্যোৎস্না রাত। আলোছায়ার মায়াতে পূর্ণ ছিল চারিদিক। 'এই ক্ষণটুকু হয়ে থাক সেই চিরক্ষণ'। রুনুদি বলছিলেন কবে আবার আসবো? পম বার বার বলছিল একবার পৌষ-মেলায় যেতে। এক শান্ত স্নিগ্ধ পরিবেশে গল্পকারের মতো আমাদের সংগে তারা গল্প করে গেছেন। যত গল্প ছিল 'ঐ' একজনকে নিয়েই তো! যা কখনো ফুরাবার নয়...।
“গানের ভিতর দিয়ে যখন দেখি ভুবনখানি, তখন তারে চিনি আমি তখন তারে জানি।”
ফওজিয়া সুলতানা নাজলী, সিডনি
|