bangla-sydney
bangla-sydney.com
News and views of Bangladeshi community in Australia












এই লিংক থেকে SolaimanLipi ডাউনলোড করে নিন



বুলবুলি নীরব নার্গিস বনে
ফওজিয়া সুলতানা নাজলী



সাধারণত নজরুলের জন্ম এবং মৃত্যু বার্ষিকীতে পত্রিকায় তাঁকে নিয়ে লেখা প্রকাশিত হয়। কিন্তু নজরুল আমার প্রতিদিনের জীবন যাপনের মাঝেই থাকেন। তারপরও নজরুলের জন্মদিনে তাঁকে নিয়ে আমার এই ক্ষুদ্র লেখার প্রয়াস।

১৩০৬ বাংলা সনের ১১ জ্যৈষ্ঠ এক ঝড়ের রাতে জন্ম নিয়ে “জ্যৈষ্ঠের ঝড়” হয়ে কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন মহাবিদ্রোহী, বিষণ্ণ, তীব্র রোমান্টিক আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম।

    “সুরে ও বাণীর মালা দিয়ে
    তুমি আমারে ছুঁইয়া ছিলে।”

    আর সবার মতো ছোট বেলায় শেখা
    “অ-মা! তোমার বাবার নাকে কে মেরেছে ল্যাং?
    খাঁদা নাকে নাচছে ন্যাদা নাক ড্যাংগা ড্যাং ড্যাং'।”

“খাঁদু দাদু” এই শিশুতোষ কবিতার মধ্য দিয়ে প্রথম চিনেছিলাম কবি নজরুলকে। তারপর আর সকল শিশুর মতো লিচুচোর, খুকি ও কাঠবিড়ালি, ঝিঙে ফুল, ভোর হোল দোর খোল পড়তে পড়তে মুখস্থ করতে করতে ভালবেসেছি তাঁকে। একটু একটু করে বড় হয়েছি আর সবার মত গেয়ে উঠেছি---

    “হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোনজন?
    কাণ্ডারি! বল, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা'র!”



কবি নজরুল আমাদের জাতীয় কবি। তাকে বাংলাদেশে নিয়ে আসা, তার জন্য স্থায়ী আবাস প্রদান করার প্রধান দায়িত্ব পালন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। ১৯৭২ সালের ২৪শে মে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে কবি সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে এলেন। কবি বাংলা দেশে আসার পর ইতিহাসের আরেক অধ্যায় শুরু হয়। এখানে তিনি পেলেন রাষ্ট্রীয় মর্যাদা অর্থাৎ তিনি যতদিন বেঁচে ছিলেন, ততদিন কবি-ভবনে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হতো। তার আগমন ও অবস্থানকালে অজস্র মানুষের পদভারে মুখরিত থাকতো ধানমন্ডির কবি-ভবন।

    “এসো প্রিয় মন রাঙায়ে
    ধীরে ধীরে ঘুম ভাঙায়ে
    মন মাধবী বন দুলায়ে, দুলায়ে
    মন রাঙায়ে।”

কবি নজরুল কিছু কিছু জিনিষ দেখলে ক্রুদ্ধ হতেন, বিরক্তিও প্রকাশ করতেন। তিনি চশমা চোখে মানুষকে সহ্য করতে পারতেন না। কিন্তু সম্ভবত একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন বঙ্গবন্ধু, প্রায় প্রত্যেকদিন তিনি কবিকে দেখতে যেতেন। যে মানুষ চশমা দেখলে ক্রুদ্ধ হন সেই ব্যক্তিই মোটা কাল ফ্রেমের চশমা পরা মানুষটির দিকে অপলক তাকিয়ে থাকতেন। কবি-পুত্র কাজী সব্যসাচী, পুত্রবধূ উমা কাজী বিস্ময় প্রকাশ করতেন কবির এই ব্যতিক্রমী আচরণ দেখে।

    “কত দিন দেখিনি তোমায়
    তবু মনে পরে তব মুখখানি।
    কতদিন তুমি নাই কাছে
    তবু হৃদয়ের তৃষা জেগে আছে।”

এক নজরুল গবেষক বলেছেন বিদ্রোহী কবিতার রচনার পর আর যদি তিনি সাহিত্য রচনা নাও করতেন, শুধু এই একটি কবিতার জন্য তিনি অমর হয়ে থাকতেন। এই কবিতাটি রচিত হয়েছিল ১৯২১ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহের এক রাত্রিতে। কবি কবিতাটি প্রথম পড়ে শোনান তার বন্ধু কমরেড মুজফফর আহমেদকে। “বিদ্রোহী” কবিতাটি রবীন্দ্রনাথকে পড়ে শোনানোর পরে তিনি নজরুলকে বুকে চেপে ধরেছিলেন। নজরুল বলেছেন, “বিদ্রোহ মানে কাউকে না মানা নয়, বিদ্রোহ মানে যেটা বুঝি না সেটাকে মাথা উঁচু করে 'বুঝি না' বলা।”

ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে কবি পথে নেমেছিলেন।“শির নেহারি আমারি নত শির ওই শিখর হিমাদ্রির!” এই দৃপ্ত ঘোষণা কেবল শাসকদেরই কাঁপিয়ে দেয়নি, পালাবদল ঘটিয়ে দিয়েছিল বাংলা কবিতারও। বাংলা কবিতায় তিনি এমন শব্দ ও ভাষা প্রয়োগ করেছিলেন যা আগে ব্যবহৃত হয়নি। তাঁর রচনায় তাঁর কবিতায় ব্যবহৃত হয়েছে আরবি ফার্সি শব্দও। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিশাল জগতের পাশে তিনি গড়ে তুলছিলেন তার নিজস্ব জগত। তাই কবিগুরু নজরুলের সদম্ভ অভ্যুদয়কে এই বলে স্বাগত জানিয়েছিলেন “আয় চলে আয় রে ধূমকেতু,/আধারে বাঁধ অগ্নিসেতু।” যেখানেই অন্যায়, অবিচার সেখানেই তিনি তার প্রতিবাদ করেছেন। অন্যদিকে মানুষের হৃদয়ের কোমল -মধুর সুকুমার অনুভূতিগুলো অতুলনীয় নান্দনিকতার সংগে তুলে এনেছিলেন তার গানে তার কাব্যে।

    “মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী, /আর হাতে রণ-তূর্য।”

প্রতিভা বসু কবি নজরুলের একজন প্রিয় ছাত্রী ছিলেন। তিনি তার “জীবনের জলছবি” বইতে নজরুলকে প্রথম দেখা বর্ণনা করেছেন এভাবে, “তখন তার বয়স বত্রিশ তেত্রিশ অথবা কিছু বেশী। যৌবন তার চোখে মুখে, সারাক্ষণ হাসিতে সমস্ত শরীরে নদীর স্রোতের মতো বহমান, বেগবান। মস্ত বড় বড় কালো টানা চোখ, এলোমেলো ঘন চুলের বাবরি, তীক্ষ্ণ নাসিকা, ঘষা তামার মতো রঙ, সহজ সরল অদাম্ভিক ব্যবহার, উদ্দাম হাসি, উচ্ছ্বাস প্রবণতা সবটা মিলিয়ে একটা ব্যক্তিত্ব বটে। আর ধুলায় লুটিয়ে পড়া গেরুয়া চাদর।”

কবির আর এক প্রিয় ছাত্রী সাবিত্রী ঘোষ। তিনি তার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, কবি তাঁর পাশে রাখা পান মুখে পুরে দিয়ে এক চুমুক চা পান করে নিয়ে হারমোনিয়ামে সুর তুলতেন। সাবিত্রী লক্ষ্য করলেন নজরুলের হাতের আঙ্গুলগুলো বিদ্যুতের মতো এপাশে ওপাশ করে সুরের অদৃশ্য রাণীকে যেন ডেকে আনছেন। গান গাইতে বসে এত ভাব বিভোর হয়ে পড়তেন যে পুরো শরীর তার নেচে উঠতো, বাবরির মতো চুলগুলো এপাশ ওপাশ করতে থাকতো। নজরুলের কণ্ঠ যে মধুর ছিল একথা বলবো না, কিন্তু গান পরিবেশন করার স্টাইল ছিল অনবদ্য। সুরের আদলে বাণীকে প্রকাশ করার ভঙ্গি ছিল অপূর্ব। এ স্মৃতি আমি ভুলিনি। ভুলবোনা কোনদিন।”

    “আমি চিরতরে দূরে চলে যাবো
    তবু আমারে দেবো না ভুলিতে!”


নজরুল গানে ও কবিতায় নারীকে রেখেছেন ফুলের সাজে। একবার তার কিছু বন্ধুরা মিলে গ্রামোফোন কোম্পানিতে তুখোড় আড্ডায় মেতেছিলেন। কার প্রিয়াকে কে কিভাবে সাজাবেন তাই নিয়ে চলছিল তুমুল আলোচনা। কেউ তার প্রিয়াকে সাজিয়েছেন সোনার হার দিয়ে, কেউবা দিতে চেয়েছিলেন হীরের ফুল। নজরুল তখন তার প্রিয়াকে সাজিয়ে দিলেন তারার ফুল দিয়ে। জন্ম নিল এই গানটি -

    “মোর প্রিয়া হবে এসো রাণী দেবো খোঁপায় তারার ফুল
    কর্ণে দোলাব তৃতীয়া তিথির চৈতী চাঁদের দুল।”

নজরুল আর কুমিল্লা যেন এক সূত্রে গাঁথা। এখানকার স্নিগ্ধ, শ্যামল পরিবেশে কবি তারুণ্যকে জয় করেছেন। কবির প্রেম, প্রণয়, লুকোচুরি, পরিণয় কাব্যচর্চা আর সাহিত্যের বর্ণিল অধ্যায় জুড়ে জড়িয়ে আছে কুমিল্লার নাম। দু’টি বিয়েও করেছেন তিনি এই কুমিল্লায়। কুমিল্লার বুক চিরে যে গোমতী নদী আজও প্রবাহমান তারই জলে তার প্রেম প্রেয়সী দিশারি বালিকা নার্গিসকে হারিয়ে চোখের জলে একাকার করে তুলছিলেন, আবার সেই একই গোমতীর তীরে কবির সাক্ষাৎ ঘটেছিল কবি-পত্নী প্রমীলা দেবীর সংগে।

    “পথের মাঝে চমকে কে গো
    থমকে যায় ওই শরম লতা।
    কত চুমা তার কলসী ঠোঁটে।
    উল্লাসে জল-উলসী উঠে।”

কবি তার প্রেয়সী ও পত্নী নার্গিসকে নিয়ে এই কবিতাটি লেখেন।

১৯২১ সালে কবি নজরুল ইসলাম তার বন্ধু আলী আকবর খনের সংগে দৌলতপুরে আসেন। সেখানে অবস্থান কালে কবি তার বন্ধুর বোনের মেয়ে সৈয়দা খাতুনের সংগে পরিচিত হন। কবি তার নাম পরিবর্তন করে রাখেন নার্গিস'। ওই বছরের ১৭ জুন তাদের বিয়ে ঠিক হয়। বিয়ের রাতেই কাউকে কিছু না বলে নজরুল কুমিল্লা শহরে চলে আসেন। কথিত আছে কাবিননামায় একটা শর্ত ছিল যে কবিকে দৌলতপুর গ্রামে এসে নার্গিস বেগমের সংগে বাস করতে হবে কিন্তু নার্গিস বেগমকে অন্য কোথাও কবি নিয়ে যেতে পারবেন না। এই শর্ত নজরুল ইসলামের পৌরুষে বেঁধেছিল। দৌলতপুরের মানুষ নজরুল নার্গিসের প্রেমকে অমর করে রাখতে কিছু কিছু জায়গার নামকরণ করেছেন “নার্গিস নজরুল।”

এরপর আর কখনো নার্গিসের সংগে কবির দেখা হয়নি কিংবা কবি দেখা করেননি। ওই বিয়ের তিন বছরের মধ্যে কবি কুমিল্লা শহরের প্রমীলা দেবীকে বিয়ে করেন।

    “তুমি হাতখানি যবে রাখো মোর হাতের 'পরে
    মোর কণ্ঠ হতে সুরের গঙ্গা ঝরে”।

কবি নজরুলের ডাক নাম ছিল দুখুমিয়া। নাম কি মানুষের জীবনকে কোন ভাবে প্রভাবিত করে? জানিনা। কিন্তু কবির নাম তার জীবনকে এক অসম্ভব ট্রাজেডিতে পরিণত করেছিল। কবে কখন কিভাবে তার রোগের প্রথম সূচনা হয়েছিল তা বলা কঠিন। কবি নিশ্চয় রোগের এই আগমনটা তাঁর শরীরে বুঝতে পেয়েছিলেন, সংগে সংগে যদি কোন চিকিৎসক এর নিকট যেতেন তা হলে হয়ত আমরা তাঁকে এভাবে হারাতাম না। আমাদের দুর্ভাগ্য যে, নজরুলের যখন বিজ্ঞানের আশ্রয় গ্রহণ করা উচিত ছিল তখন তিনি আশ্রয় নিয়েছিল আধ্যাত্মিকতার। ১৯৪২ সালের ৯জুলাই অল ইন্ডিয়া রেডিও স্টেশনে প্রোগ্রাম করতে গিয়ে কিছুই বলতে পারছিলেন না। তার জিহ্বা কেবল আড়ষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। তখনই রেডিওতে ঘোষণা করা হয় কবি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। প্রোগ্রামটি আর একদিন হবে। অল ইন্ডিয়া রেডিওতে যাওয়া সেদিনই ছিল কবির শেষ দিন।

    “এই কি গো শেষ গান
    বিরহ দিয়ে গেলে,
    মোর আরো কথা বাকি
    আরো প্রেম আরো গান।”

১৯৪২ সালে যখন রোগ সকলের চোখে প্রকাশ পেল তখন চিকিৎসা হয়েছিল। কিন্তু প্রাথমিক চিকিৎসা ছিল অত্যন্ত অপরিমিত ও অসম্পূর্ণ। সেই সময় তাকে ইউরোপে পাঠানো সম্ভব হয় নাই, বিশ্বযুদ্ধ চলছিল বলে ১৯৫৩ সালের মে মাসে তাকে ইউরোপ পাঠানো হয়। লন্ডনের বড় বড় ডাক্তার তার রোগ নির্ণয়ের চেষ্টা করেছেন। ভিয়েনা, জার্মানি ও লন্ডনের মস্তিষ্ক শল্যবিদ ডাক্তাররা রোগ নির্ণয় করে বলেন কবি পিকস ডিজিজ নামক মস্তিষ্কের রোগে ভুগছেন। এই রোগে মস্তিষ্কের সামনের ও পার্শ্ববর্তী অংশগুলি সংকুচিত হয়ে যায়। তারা বলেন কবির রোগ এতদূর অগ্রসর হয়েছে যে ভালো হওয়ার আর কোন আশা নেই।

    “তুমি আসিলে না হায়-
    তুমি আসিলে না,
    আশার সূর্য ডুবিল
    ডুবিল সাগর নীড়ে।”

নজরুলের কবিতা ও গানে যুগে যুগে বাংলার মানুষ অনুপ্রাণিত হয়েছে। বিশেষ করে ১৯৭১ সালের অগ্নিঝরা দিনগুলোতে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে প্রচারিত তার কবিতা ও দেশাত্মবোধক গান মানুষকে উজ্জীবিত করেছে, দিয়েছে শক্তি, যুগিয়েছে প্রেরণা।
কবি তার বিখ্যাত “প্রলয়োল্লাস” কবিতায় একস্থানে বলেছেন “ভেঙ্গে আবার গড়তে যে জানে সে চির সুন্দর/তোরা সব জয়ধ্বনি কর/ তোরা সব জয়ধ্বনি কর।” ভেঙ্গে গড়ে, নতুনের কেতন ওড়নোর বাণীই আজ সমাজের প্রতিটি স্তরে অনুরণিত হোক।

রঙ মনের কথা বলে। মানুষের অনুভূতি প্রকাশে রঙ একটি অসাধারণ আবেগময় শিল্প উপকরণ। মনের রঙ এর তুলির টানে চারিদিকে বড় বেশী রাঙ্গিয়ে দিতে চাইছে মনটা।
কবির আজ জন্মদিন। সেই উপলক্ষে আকাশে অনেক বড় চাঁদ উঠেছে। তারাগুলি জ্বল জ্বল করছে। চারিদিকে উৎসবের রঙ ছড়ানো হচ্ছে, লাল, নীল, সবুজ, হাজার রঙের বাতি। হই হুল্লোড়, উল্লাস আর আনন্দ। হাজারো রঙ এর বেলুন আকাশে উড়ছে। কবি ঐ দূর তারার দেশে, ফুলের জলসায় বসে নিশ্চয়ই তা উপভোগ করছেন। শুভ জন্মদিন প্রিয় কবি নজরুল।

    “আকাশে আজ ছড়িয়ে দিলাম প্রিয়
    আমার কথার ফুল গো, আমার গানের মালা গো
    কুড়িয়ে তুমি নিও, প্রিয় কুড়িয়ে তুমি নিও।”



ফওজিয়া সুলতানা নাজলী, সিডনি, আস্ট্রেলিয়া




Share on Facebook               Home Page             Published on: 21-May-2018

Coming Events: