bangla-sydney
bangla-sydney.com
News and views of Bangladeshi community in Australia













সোনালী যুগের শাহজাদা
ফওজিয়া সুলতানা নাজলী



“মুঘল এ আজম” ছবিতে দিলীপ কুমার
আম্মার কাছে সেই কিশোরী বেলায় “আন”, “বাবুল”, “আন্দাজ”, “দাগ”, “দিদার” আর দিলীপ কুমারের গল্প শুনে এসেছি। যখন বড় হলাম, একদিন ফিল্ম ফেয়ার ভিডিও ক্লাবে যেয়ে জিজ্ঞেস করলাম দিলীপ কুমারের “আন্দাজ” ছবিটা পেতে পারি? দোকানের ছেলেটা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে ভিডিওটা খুঁজে দিলো। কার জন্য? বললাম আমি দেখবো। ছেলেটার যেন বিস্ময় কাটে না। কিন্তু আমার মন তো সেদিকে নাই। মন তো উড়ু উড়ু কখন বাসায় এসে দিলীপ কুমারকে দেখবো। সেই প্রথম আমার তাকে দেখা। চেহারা, ব্যক্তিত্ব, কণ্ঠস্বর সব কিছুতেই এক বিশেষ আভিজাত্য ঘিরে ছিল তাকে। আমি তাতে মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়লাম। ১৯৪৯ সালে মুক্তি পাওয়া সুপার হিট ত্রিভুজ প্রেমের ছবি “আন্দাজ”। আর এই ছবি থেকেই ট্রাজেডি কিং এর তকমা তার গায়ে লেগে যায়। সেই থেকেই আমার দিলীপ কুমারের ছবি দেখা শুরু।

ইউসুফ আলি খান পর্দায় হয়ে উঠলেন দিলীপ কুমার। রক্ষণশীল পরিবারে বড় হওয়া বাবাকে বড় বেশী ভয় পেতেন। ইউসুফ ছবিতে অভিনয় করবে জানলে বাবা আস্ত রাখবেন না। তিনি চাচ্ছিলেন চলচ্চিত্রে শক্ত অবস্থান গড়ে তারপর বাবাকে সাহস করে জানাবেন। আর তাই এই নাম বদল।

“দেবদাস” সেই কিশোরী বেলায় পড়া বই। যখন পিছন ফিরে তাকাই নিজেকে দেখি কিশোরী বেলায়, সেই কিশোরী কতবার যে “দেবদাস” পড়েছে আর কত যে তার চোখের জল ঝরেছে আর কত কত বার যে বালিশ ভিজিয়েছে তার হিসেব নাই। কষ্টে কত নিদ্রাহীন রাত তার কেটেছে।

সিনেমার পর্দায় সেই প্রমথেশ বড়ুয়া থেকে শুরু করে অনেক অভিনেতার দেবদাসের ভূমিকায় অভিনয় দেখেছি, কিন্তু দিলীপ কুমারের মতো কেউ নয়। যতবারই দেবদাস দিলীপ কুমারকে দেখেছি কদিন লেগেছে সেই কষ্ট থেকে নিজেকে বের করে আনতে। হিন্দিতে বহুবার দেবদাস রিমেক হয়েছে। কিন্তু দিলীপ কুমারকে অতিক্রম করতে পারেন নি কোন অভিনেতা। দেবদা’র জন্য পারুর যে আকুলতা তা এখনও হৃদয়কে নাড়া দেয়। পার্বতীর খোঁজে গরুর গাড়িতে আসা দেবদাসের অন্তরে যে দহন, তা দিলীপ কুমার যেভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তার আঁচ এখনো হৃদয়ে এসে লাগে।
“মশাল” ছবিতে দিলীপ কুমারের অভিনয় অবিস্মরণীয়। মশাল ছবির একটি সংলাপ তার অসামান্য অভিব্যক্তির কারণে হিন্দি ছবির ক্লাসিকে পরিণত হয়। ছবির একটি দৃশ্য এখনো স্মরণীয়। অসহায় দিলীপ কুমার মৃত্যুপথযাত্রী স্ত্রীকে হাসপাতালে নেয়ার জন্য বর্ষণমুখর এক রাতে একের পর এক গাড়ি থামাতে চেষ্টা করছেন কিন্তু একটা গাড়ীও থামছে না। সংলাপটি ছিল “এ ভাই গাড়ী রোকো”। চোখে এখনো পানি আসে।

“শক্তি” ছবিতে পুলিশ ইন্সপেক্টরের ভূমিকায় দিলীপ কুমার আর বিপথগামী পুত্র চরিত্রে অমিতাভ বচ্চনের দুর্দান্ত অভিনয় দর্শকদের মুগ্ধতায় ভরিয়ে দেয়। এ ছবিতে দু’জনের সংলাপ প্রতি-সংলাপ আর অভিনয় দর্শকদের স্মৃতিতে আজো অম্লান। দিলীপ কুমারের সমসাময়িক প্রতিদ্বন্দ্বী শৈশবের বন্ধু রাজ কাপুর ছবিটা দেখে ফোনে বলেছিলেন “বন্ধু আজ রায় এসেছে, তুমিই সেরা শিল্পী”|

বলিউডের একশ বছরের ইতিহাসে “মুঘল এ আজম” অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছবি। মোঘল শাহজাদার আভিজাত্য, দৃঢ়তা, আবেগ প্রেম বেদনা সবকিছু সার্থক ভাবে তুলে ধরেছিলেন দিলীপ কুমার। তিনি যদি সারা জীবনে শুধু এই একটি ছবিতেই অভিনয় করতেন তাহলেও বলিউডে অমর হয়ে থাকতেন চিরকাল।

দিলীপ কুমার হিন্দি সিনেমায় অভিনয় শিল্পকে এক নতুন রূপ দিয়েছিলেন। কলেজে পড়ার সময় রাজ কাপুর আর দিলীপ কুমার সহপাঠী ছিলেন। রাজ কাপুর পার্সি মেয়েদের সংগে দুষ্টামি করতেন আর দিলীপ কুমার চুপ করে বসে থাকতেন, তাদের দিকে কমই তাকাতেন। কে জানতো এই ব্যক্তিই একদিন ভারতীয় সিনেমাকে নীরবতার ভাষা শেখাবেন যা অনেক বলিষ্ঠ সংলাপের চেয়েও বেশী শক্তিশালী হবে। বিখ্যাত গল্প লেখক সালিম বলেছেন, “দিলীপ কুমার যেসব চরিত্রে অভিনয় করতেন তার সুক্ষ বিষয় গুলো পর্দায় ফুটিয়ে তুলতেন এবং ইচ্ছাকৃত ভাবে নীরব হয়ে যেতেন এবং সেটাও দর্শকের উপর গভীর ছাপ রেখে যেতো।”
মুঘল এ আজম মুভিতে পৃথ্বীরাজ কাপুরের চরিত্র ছিল খুবই প্রভাবশালী ও বলিষ্ঠ। কিন্তু দিলীপ কুমার তার কণ্ঠকে নিচু করে এমন অভিজাত ভাবে ও দৃঢ়তার সংগে সংলাপ ছুড়ে দিতেন যা দর্শকদের মনে রেখাপাত করেছিল।

মাসিক “উল্টোরথ” পত্রিকার সংগে আমার প্রথম পরিচয় হয় শৈশবে। মূলত চলচ্চিত্র বিষয়ক পত্রিকা হলেও এর বড় অংশ জুড়ে থাকতো গল্প উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনী সাক্ষাৎকার, রম্যরচনা আর মেল-ব্যাগ। আম্মা বাসায় কাঁচের আলমারিতে প্রতিটি তাকে সারি সারি বই সাজিয়ে রাখতেন। সেই একটি তাকে “উল্টোরথ” পত্রিকা প্রথম চোখে পড়ে। এই পত্রিকা আমার বহু ঝিমধরা দুপুরের অবকাশ রাঙিয়ে তুলেছিল। চলচ্চিত্র-সাংবাদিকরা অনেক আকর্ষণীয় করে স্টুডিওর এক স্বপ্নময় আবহাওয়া ফুটিয়ে তুলতেন। সেখানেই আমি হিন্দি ছবির জনপ্রিয় নায়ক নায়িকাদের সংগে পরিচিত হই। বৈজন্তিমালা, নার্গিস, মধুবালা, মিনা কুমারী, রাজ কাপুর, ওয়াহিদা রেহমান, গুরু দত্ত ও আরো অনেকের সংগে। উল্টোরথে চিত্রতারকাদের ছবিগুলো ছিল অতি সবুজ বা অতি বেগুনী। এই রংই হয়তো ব্যবহৃত হতো সেই সময়। আর সেই উল্টোরথ এর পাতায় প্রথম দেখি দিলীপ কুমারকে। দেখে যার পর নাই মুগ্ধ হই। আর সেখানেই পড়ি মধুবালা-দিলীপ কুমারের প্রেমকাহিনী।

অনেক ছবিতে নার্গিসের সাথে জুটি ছিল দিলীপ কুমারের। কিন্তু মধুবালার সংগে তার জুটি বেশী জনপ্রিয় হয়েছিল এবং তারা দু’জন একে-অপরের প্রেমে পড়েছিলেন। আত্মজীবনীতে দিলীপ কুমার বলেন “মধুবালা ছিলেন অত্যন্ত প্রাণবন্ত ও উচ্ছল। আমার মতো সংকোচ বোধ করা কারো সাথে কথা বলতেও তার কোন সমস্যা হতো না।” কিন্তু মধুবালার বাবার কারণে তাদের প্রেমের গল্প বেশিদূর এগোয়নি। বি আর চোপড়ার “নয়াদৌড়” সিনেমা নিয়ে আইনগত সমস্যার উদ্ভব হলে মধুবালার বাবা আর দিলীপ কুমারের মধ্যে তিক্ততা তৈরি হয়। পরে যা আদালতে গিয়ে সমঝোতায় পৌছায়।

মধুবালার ছোট বোন মাধুর ভূষণ স্মরণ করেন যে “এরপর দিলীপ কুমার মধুবালাকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। মধুবালা বলেন যে আমি তোমাকে বিয়ে করবো কিন্তু তোমাকে বাবার কাছে যেয়ে ক্ষমা চাইতে হবে। দিলীপ তা মানতে রাজি হননি। তিনি এও বলেছিলেন দিলীপ বাড়িতে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরুক কিন্তু তাতেও রাজী হননি দিলীপ এবং তাদের সম্পর্ক ভেঙ্গে যায়।”
তাদের দুজনার সম্পর্ক এতোটাই কঠিন হয়ে পড়ে যে মুঘল এ আজম সিনেমায় অভিনয়ের সময় তারা একে অপরের সংগে কথা পর্যন্ত বলতেন না। অথচ ছবির পর্দায় তাদের উপস্থাপনা আজও মানুষকে এক অমর প্রেমের গল্পে ভাসিয়ে নিয়ে যায় পলকে। যেভাবে প্রতিটি ফ্রেমে সেলিম আনারকলি সম্পর্কের ভাঙ্গন ধরা দিয়েছিল, বাস্তবেও ঠিক সেই পরিণতি ঘটেছিল দিলীপ কুমার ও মধুবালা সম্পর্কে। তাদের জীবনের সেরা অভিনয় উপহার দেন এই ছবিতেই।

পরবর্তীতে মধুবালা গায়ক কিশোর কুমারকে আর দিলীপ কুমার অভিনেত্রী সায়রা বানুকে বিয়ে করেন। যখন মধুবালা অসুস্থ হয়ে পড়েন তখন ইচ্ছে প্রকাশ করেন তিনি একবার দিলীপ কুমারের সংগে দেখা করতে চান। আর দিলীপ কুমার যখন তার সংগে দেখা করতে গেলেন তখন অসুস্থতার কারণে মধুবালা খুবই শীর্ণ এবং দুর্বল। দিলীপ কুমারকে দেখে এক সময়ের প্রাণবন্ত সেই মধুবালার ঠোটে যে হাসি ফুটে উঠেছিল তা ছিল খুব ফ্যাকাশে। মধুবালা দিলীপ কুমারের চোখের দিকে তাকালেন আর বললেন “আমার প্রিন্স তার প্রিন্সেসকে পেয়েছে। আমি খুবই আনন্দিত”। ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি মধুবালা মারা যান। তখন তার বয়স ছিল মাত্র ৩৬!

অনেক ছবিতে দিলীপ কুমার চরিত্রের প্রয়োজনে মারা গেছেন, এমন চরিত্রে অভিনয়ে মৃত্যুর বাস্তবিক ও গ্রহণযোগ্য করে ফুটিয়ে তুলতে অনবদ্য অভিনয় করেছেন। এমন সময় ছিলো যখন প্রতি দুটি ছবির একটিতে তিনি এমন চরিত্রে অভিনয় করেছেন।
দিলীপ কুমার বিবিসিকে বলেছেন, “একটা সময় ছিল যখন মৃত্যুর দৃশ্য করতে গিয়ে আমি ডিপ্রেসড হয়ে যেতাম। বিষণ্ণতা কমাতে আমাকে চিকিৎসা নিতে হয়েছিল। চিকিৎসক আমাকে ট্রাজেডি বাদ দিয়ে কিছু কমেডি সিনেমায় অভিনয় করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। লন্ডন থেকে বিষণ্ণতার চিকিৎসা নিয়ে ফেরার পর আমি ‘কোহিনূর’, ‘আজাদ’, ‘রাম অর শ্যাম’ সিনেমায় অভিনয় করেছিলাম যেগুলোতে কিছুটা কমিক উপাদান ছিলো।”

৯৮ বছর বয়সে শেষ হলো দিলীপ কুমারের পথচলা। অনেকদিন ধরেই মৃত্যুর সংগে লড়ছিলেন জেনেও তার মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। শৈশবের সমস্ত মুগ্ধতা নিয়ে তিনি আজও থমকে আছেন চির তারুণ্যে। অনেক আলোকিত নির্মাণ রেখে গেলেন তিনি। সত্যজিৎ রায় দিলীপ কুমারের অভিনয় ক্ষমতায় মুগ্ধ হয়ে বলেছিলেন “মেথড এ্যাক্টর”। চরিত্রের সংগে মিশে যেতে পারতেন সহজেই।

শৈশবের সেই সোনালী জগত থেকে চলেছি অনেক দূরে, আজও মনে করতে পারি আমার সেই স্মৃতি, দিলীপ কুমারকে প্রথম দেখার অনুভূতি। অনন্তের পথে উড়ে গেছেন সোনালী যুগের শাহজাদা। তিনি চলে গেলেন আমার শৈশব ও কৈশোর বেলার মোহময় মুগ্ধ দৃষ্টির ভালোলাগাকে নিয়ে। দূরের আকাশে হারিয়ে যাওয়া দিলীপ কুমারের প্রতি অনেক শ্রদ্ধা।



ফওজিয়া সুলতানা নাজলী, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া





Share on Facebook               Home Page             Published on: 18-Jul-2021

Coming Events:
বৃষ্টির সম্ভাবনার কারণে মেলার তারিখ ১ দিন পিছিয়ে ২১ এপ্রিল ২০২৪ (রবিবার) করা হয়েছে......




A day full of activities, games and fun.







Lakemba Blacktown Mascot
Minto Money raised so far





Lakemba Blacktown Mascot
Minto Money raised so far



Blacktown Lakemba Mascot
Minto Money raised so far







Blacktown Lakemba Mascot
Minto Money raised so far