bangla-sydney
bangla-sydney.com
News and views of Bangladeshi community in Australia












এই লিংক থেকে SolaimanLipi ডাউনলোড করে নিন



সুরঞ্জনা...
ফওজিয়া সুলতানা নাজলী



সুরঞ্জনা, অইখানে যেওনাকো তুমি,
বোলোনাকো কথা ওই যুবকের সাথে;
ফিরে এসো সুরঞ্জনাঃ
নক্ষত্রের রুপালি আগুন ভরা রাতে;
ফিরে এসো এই মাঠে, ঢেউয়ে;
ফিরে এসো হৃদয়ে আমার;
দূর থেকে দূরে-আরো দূরে
যুবকের সাথে তুমি যেওনাকো আর।

আমার ছোটবোন সবে মাত্র স্কুলগন্ডি পেরিয়ে কলেজে জীবন শুরু করেছে আর তখন আমিও কলেজগন্ডি পেরিয়ে ভার্সিটির প্রথম দিনের ক্লাসের অপেক্ষায়। সেই সময় একদিন ও আমায় এসে বললো জানো- আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে একটি ছেলে “সুরঞ্জনা অইখানে...” কবিতাটি বলছিল। কার লেখা কবিতা তুমি জানো? জানি না তো, মনে হয় আম্মা জানেন। আম্মার কাছে জানলাম কবিতাটি জীবনানন্দ দাশের। দুই বোন বুকশেলফ থেকে “জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা” বইটি নিয়ে ঐ কবিতা “আকাশলীনা” পড়লাম। আর খুব মজা পেলাম। ভোরের অগণিত শিশিরের স্রোতধারার মতো মনটাকে ভিজিয়ে রেখেছিল অনেকক্ষণ। সেই প্রথম জীবনানন্দের কবিতাকে আমার ছুঁয়ে দেখা। আর রোমান্টিক কবি হিসাবে তিনি আমার মনে স্থান করে নেন। বার বার ডুব দেই তার কবিতার শব্দের বিন্যাসে।

“তোমায় আমি দেখেছিলাম ব'লে / তুমি আমার পদ্মপাতা হলে; / শিশির কণার মতন শূণ্যে ঘুরে / শুনেছিলাম পদ্মপত্র আছে অনেক দূরে / খুঁজে খুঁজে পেলাম তাকে শেষে।” কবিতাটি এক অপূর্ব সৌন্দর্যের স্নিগ্ধতায় আপ্লুত। যতবারই পড়েছি বাড়িয়ে দিয়েছে মুগ্ধতা। মন ছুঁয়ে ছুঁয়ে গেছে ভালোলাগায়।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন জীবনানন্দ দাশের কাব্য “চিত্ররূপময়”। বাংলার রূপ ও সৌন্দর্য কবিকে এমনভাবে আচ্ছন্ন করেছিল যে তিনি একজন চিত্রশিল্পীর মতো নিখুঁতভাবে নদী, ঘাস, ফুল ইত্যাদি তার কবিতায় চিত্রিত করেছেন।
বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ / খুঁজিতে যাই না আর: অন্ধকারে জেগে উঠে ডুমুরের গাছে / চেয়ে দেখি ছাতার মতন বড়ো পাতাটির নিচে ব'সে আছে /
ভোরের দোয়েল পাখি-।
ভালোবেসে তাকে আমরা বলি “রূপসী বাংলার কবি”। তার কবিতার চিত্রময়তা, যার সঙ্গে আমরা অনায়াসে ঘনিষ্ঠতা বোধ করি। এটি হয়তো জীবনানন্দ দাশ এর জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ।

“বনলতা সেন” কবিতাটি “বনলতা সেন” কাব্যগ্রন্থের একটি বিখ্যাত কবিতা। ১৮ লাইনের কবিতাটির উপমা চিত্রকলার মতো রেখা ও রঙে ভরপুর। যতবার কবিতাটি পড়ি মনের মাঝে ভেসে আসে এক অচেনা জগতের একটি উদাস করুণ প্রশান্ত সুর। এই কবিতাটি জীবনানন্দ দাশ অনেক যত্নে সুন্দর ও কালজয়ী করে তুলেছেন পাঠকের কাছে।

বনলতা সেন জীবনানন্দ দাশের রোমান্টিক গীতি কবিতা হিসাবে বেশী পরিচিত। আট দশক আগে কবি কবিতাটি লিখে রবীন্দ্র পরবর্তী বাংলা কবিতাকে আধুনিকতার স্বীকৃতি দান করেছিলেন। বিংশ শতাব্দীর কবিতাগুলির মধ্যে অন্যতম জনপ্রিয় এই কবিতাটি। জীবনানন্দ দাশের গবেষক ভুমেন্দ্র গুহ-র ভাষায়, “বনলতা সেন মোটেও প্রেমের কবিতা নয়, বনলতা সেন একটি প্রতীক। হাজার বছরের সভ্যতার ইতিহাসের নির্যাস বনলতা সেন কবিতায় মূর্ত হয়ে উঠেছে আর প্রাণ পেয়েছে।”

কবিতায় তিনি বলেছেন “আমারে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।...বলেছে সে, এতোদিন কোথায় ছিলেন? / পাখীর নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন”। কবি বনলতা সেনকে এক আশ্চর্য নান্দনিক সৌন্দর্যে সাজিয়ে তুলেছেন। অসাধারণ কাব্য সুষমায় উজ্জ্বল এই কবিতাটি।

জীবনানন্দ দাশের কবিতার সুর কেমন যেন বিষণ্ণ আর রঙটাও ধুসর এবং তা স্বত্বেও তার কবিতায় আমরা আমাদের ব্যক্তিগত জীবনের মিলের উৎস খুঁজে পাই। হয়তোবা সেইজন্য কবিতাগুলি আমাদের এতো আপন, এতো কাছের।

যতো দিন যাচ্ছে ততই কবি জীবনানন্দ দাশের প্রতিভার মূল্যায়ন হচ্ছে। তিনি আমাদের মাঝে আর নেই। চোখ ভিজে যায় যখন তার জীবনের লাঞ্ছনা আর দারিদ্রের কথা পড়ি। চার পাঁচশো টাকার জন্যও আকুল হয়ে চিঠি লিখেছেন তিনি “দয়া করে একটু ব্যবস্থা করুন”।

কিছুদিন আগে আমার ক’জনা বন্ধু জীবনানন্দের জন্মস্থান বরিশালে গিয়েছিল তার বাড়ি দেখার স্বপ্ন নিয়ে। ভেবেছিল কবির বাড়িটি সহজেই খুঁজে পাওয়া যাবে। কিন্তু অনেক খোঁজার পর “ধানসিঁড়ি” লেখা দু’টি স্তম্ভ তাদের চোখে পড়ে । যেটি কবি জীবনানন্দ দাশের বাড়ির মূল ফটক। তারা দেখতে পায় ভেতরে কিছু বাড়ি। দিনটি ছিল অনেক গরম। তবু তারা কজনা ছিল প্রাণের আনন্দে ভরপুর। বাড়িটি ঘুরে ঘুরে খুঁজছিল জীবনানন্দ দাশকে এবং তাদের খুব জানতেও ইচ্ছে করেছিল কোন ঘরে ‘মিলু’র জন্ম হয়েছিল আর কোন ঘরে কলকাতার বেথুন কলেজের ছাত্রী লাবণ্য দাশের সঙ্গে কবি বাসর পেতেছিলেন। তাদের এসব কৌতূহল ওখানকার বাসিন্দারা মিটাতে পারেন নাই। অযত্নে আর অবহেলায় অন্যের দখলে আজ স্মৃতি বিজড়িত কবির বাড়িটি। ঠিক কবি নিজেই যেমন লিখে গেছেন “নগ্ন নির্জন হাত” কবিতায়, “মনে পড়ে কোন এক বিলুপ্ত নগরীর কথা...আজ নেই, কোন একদিন ছিলো...”।

জীবনানন্দ দাশ ১৮৯৯ সালে ১৭ ফেব্রুয়ারি বরিশাল শহরে জন্মগ্রহণ করেন। আমাদের ছোটবেলার সুপরিচিত কবিতা ছিল “আদর্শ ছেলে”। “আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে / কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে”। কবিতাটি লিখেছিলেন জীবনানন্দ দাশের মা কুসুমকুমারী দাশ এবং কুসুমকুমারী দাশের ঘরেই ছিল সেই আদর্শ ছেলে। গম্ভীর স্বল্প-বাক জীবনানন্দ দাশ ছিলেন সত্যানন্দ দাশ ও কুসুমকুমারী দাশের জ্যৈষ্ঠ সন্তান। বাবা ছিলেন বরিশাল ব্রজমোহন স্কুলের প্রধান শিক্ষক এবং একজন নামকরা প্রাবন্ধিক। সেই স্কুল থেকেই জীবনানন্দ দাশ প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করেন। পরে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজিতে অনার্সসহ বি এ পাশ করেন আর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে এম এ ডিগ্রী নেন। শিক্ষাজীবনের স্তরগুলোতে নিজেকে মেধাবী রূপে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। যা হয়তো তাকে পরবর্তী সময়ে সাহিত্যজীবনে অধিষ্ঠিত করেছিল আধুনিক রূপে।

জীবিত থাকা অবস্থায় জীবনানন্দ দাশ অসাধারণ কবি হিসেবে পরিচিত থাকলেও তিনি খ্যাতি অর্জন করে উঠতে পারেননি। এর জন্য তার প্রচার বিমুখতাও দায়ী ছিল। বরং প্রচুর সমালোচনা তাকে অন্তর্মুখী এবং লেখার মান নিয়ে সন্দিহান করে তুলেছিল। তবে মৃত্যুর পর থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর শেষ ধাপে তিনি জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করেন এবং বাংলা সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় কবিতে পরিণত হন।

খুব বেশী অবহেলিত ছিলেন কবি। অনেকেই তার কাব্যকে ভালো করে উপলব্ধি করতে পারেননি। নানা ধরনের সমালোচনার আঘাতে তিনি জর্জরিত থাকতেন। জীবিতকালে তার দুটিমাত্র বই প্রকাশিত হয়েছিল এবং অনেক বই তিনি প্রকাশের উদ্যোগও নেননি। লিখে লিখে ট্রাঙ্কের ভেতর লুকিয়ে রাখতেন। বুদ্ধদেব বসু ও সঞ্জয় ভট্টাচার্য ছাড়া তার সময়ের কবি বা লেখকরা তার সঠিক মূল্যায়ন করেননি। কেউ তার পাশে দাঁড়াননি। কিন্তু সেদিন তার কবিতার গভীরতা ও প্রখরতা কয়েকজন তরুণকে স্পর্শ করেছিল। তার কবিতা তাদের বোধকে গভীর ভাবে নাড়া দিয়েছিল। তারা সেই সময় “ময়ূক” নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ করতেন। এই তরুণদের মধ্যে ভূমেন্দ্র গুহ’র নাম উল্লেখযোগ্য। জীবনানন্দের কবিতা পাবার আশায় তারা বারবার কবির কাছে গেছেন। তারা যেন কবিকে বুঝতে পেরেছিল। কবি জীবনানন্দ দাশ যেন তাদের কাছে ছিল সূর্যের মতো আরাধ্য। এই তরুণরা তার চারপাশে আবর্তিত হচ্ছিলেন। জীবনানন্দ দাশ যখন ১৯৫৪ সালে কলকাতার রাস্তায় ট্রামের আঘাতে গুরুতর আহত হন, হাসপাতালে নেয়া হলে এই তরুণ ছেলেরাই কবির জীবনের শেষকটি দিন সারাক্ষণ তার সেবা শশ্রুষার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন।

ভূমেন্দ্র গুহ সেই সময় কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিলেন। কবির মৃত্যুর পরে তার উপর দায়িত্ব পরে কবির ট্রাংকগুলি থেকে শ্রাদ্ধের জন্য তার একটি ছবি বের করবার। তখন তিনি দেখতে পান কবি ট্রাংকে তালা চাবি দিয়ে সযত্নে লুকিয়ে রেখেছেন হাজার হাজার কবিতা, গল্প, উপন্যাসে খাতা ও ডাইরি। এই সব শত শত রুলটানা এক্সারসাইজ খাতা খুঁজে খুঁজে পড়ে পড়ে জীবনানন্দের জড়ানো অস্পষ্ট হাতের লেখার প্রতিরোধ উপেক্ষা করে তিনি ভবিষ্যতের পাঠকদের জন্য তা প্রকাশনার ব্যবস্থা করে যান। যেন মহা কাল তার উপর এই দায়িত্ব দিয়েছিল। পরম আগ্রহে পরম মমতায় তিনি তার কাজটি করে গেছেন। মহাকালের গর্ভে যেন হারিয়ে না যায় কবির রচনা।

জীবনানন্দের পাণ্ডুলিপি মহামূল্যবান রত্নের মতো আগলে রেখেছিলেন ভুমেন্দ্র গুহ সারা জীবন। বাংলা ভাষার জনপ্রিয় কাব্যগ্রন্থ রূপসী বাংলা, সপ্তম কাব্য সংকলন, “বেলা অবেলা কালবেলা”, প্রথম প্রবন্ধসংকল: কবিতার কথা, সর্বপ্রথম প্রকাশিত উপন্যাস: মাল্যবান এর মূদ্রণযোগ্য পাণ্ডুলিপি সবই ভূমেদ্র গুহর হাতে হয়েছিল।

জীবনানন্দ দাশ ২০৬৬ কবিতা লিখে গেছেন। তার মধ্যে ১৬৬ কবিতা জীবদ্দশায় তিনি প্রকাশ অরে গেছেন। সবচেয়ে বড় কথা তার “ক্যাম্পে” কবিতা লেখার জন্য অশ্লীলতার দায়ে তাকে অভিযুক্ত হতে হয়েছে এবং তাকে চাকুরী হারাতে হয়েছে। একটি চাকরি পাবার আশায় মরিয়া হয়ে চেষ্টা করেও বিমুখ হয়েছেন। দারিদ্র এবং অনটন ছিল তার কর্মজীবনের ছায়াসংগী। কবির জীবন কেটেছে কঠোর সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে। বরিশাল বিএম কলেজে ১৫ বছর চাকরী করে কলকাতায় এসেছিলেন। তিনি স্থায়ী চাকুরী কিছুতেই পাননি। বার বার চাকুরী হারিয়েছেন। কেউ তাকে বোঝেননি। সেই সময়ের শিক্ষা সচিব কবি হুমায়ুন কবীরকে বারবার চিঠি লিখেছেন। একটি চিঠিতে লিখেছেন, “সবাইকে তো বলতে পারিনা, আপনাকে বলতে পারি। আমি সপরিবারে অনাহারে রয়েছি। আপনি আমার জন্য একটি চাকুরীর ব্যবস্থা করে দিন। একদিন আসবে যখন আমার সাহিত্য প্রতিভার মূল্যায়ন হবে। সেই সুদিন দেখে যাবার জন্য তখন হয়তো আমি বেঁচে থাকবো না।” জীবনানন্দ দাশের কোন চাকরী হয়নি দীর্ঘদিন।

১৯৫৪ সালের ১৪ অক্টোবর কলকাতার বালিগঞ্জে এক ট্রাম দুর্ঘটনায় জীবনানন্দ দাশ গুরুতর আহত হন। শরীর দলিত হয়ে যায়। ভেঙ্গে যায় কণ্ঠা, উরু এবং পাঁজরের হাড়। কাছের এক চায়ের দোকানের মালিক জীবনানন্দের চিৎকার শুনে ছুটে এসে তাকে উদ্ধার করেন। তাকে শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

জীবনানন্দের অবস্থা দিন দিন জটিল হতে থাকে। নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে পড়েন কবি। চিকিৎসক ও সেবিকাদের সকল প্রচেষ্টা বিফল করে দিয়ে ২২ অক্টোবর ১৯৫৪ সালে রাত্রি ১১টা ৩৫ মিনিটে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। আজ সেই ২২শে অক্টোবর। জীবনানন্দ দাশের গবেষক ভূমেন্দ্র গুহ মনে করেন, কবির বেঁচে থাকার জীবন স্পৃহা শূন্য হয়ে গিয়েছিল। মৃত্যুচিন্তা কবির মাথায় দানা বেঁধেছিল। তিনি প্রায় ট্রাম দুর্ঘটনায় মৃত্যুর কথা ভাবতেন, গত একশত বছরে কলকাতায় ট্রাম দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা মাত্র একটি। তিনি আর কেউ নন, কবি জীবনানন্দ দাশ।

“কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব কাঁঠাল ছায়ায়;
হয়তো বা হাঁস হবো - কিশোরীর- ঘুঙুর রহিবে লাল পায়
সারাদিন কেটে যাবে কলমির গন্ধভরা জলে ভেসে-ভেসে;
আবার আসিব আমি বাংলার নদী মাঠ ক্ষেত ভালোবেসে
জলঙ্গীর ঢেউয়ে ভেজা বাংলার এ সবুজ করুণ ডাংগায়”।


ফওজিয়া সুলতানা নাজলী, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া





Share on Facebook               Home Page             Published on: 20-Oct-2018

Coming Events:





A day full of activities, games and fun.







Blacktown Lakemba Mascot