ফিফা বিশ্বকাপ ২০১৮ ফওজিয়া সুলতানা নাজলী
গোল-গোল--গোল---- আর এটা যদি হয় বিপক্ষ দলের গোলপোস্টে তাহলে তো আনন্দ উল্লাস আর খুশির বন্যা বয়ে যায়। “আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে”।
সেই ছোটবেলার স্মৃতি বার বার মনে পড়ছে যখন ফুটবল খেলা দেখতাম টিভির পর্দায়। আমার প্রিয় দল ছিল আবাহনী আর বড় দুই ভায়ের ছিল মোহামেডান। আজ যখন পিছন ফিরে ফিরে আমাকে দেখি, দেখতে পাই আমার দুই চোখ পানিতে টলমল করছে আবাহনী হেরে গেছে। ভাইরা মৃদু মৃদু হাসছে। আর প্রজাপতির মতো নেচে নেচে আনন্দ করছি কারণ আবাহনী জিতে গেছে। কি মধুর ছিল সেই ছেলেবেলা!! কোথায় আজ তা হারিয়ে গেলো! “তবে কি ছেলেবেলা অনেক দূরে ফেলে এসেছি” । আবার যখন বিশ্বকাপের আসর বসেছে তখন টিভির সামনে বন্ধুদের নিয়ে দল বেঁধে বসতাম সংগে থাকত চানাচুর আর বাদাম ভাজা। মনে পড়ে যায় কত শত অনুভূতি, খুনসুটি, ভালোলাগা, কান্না পাওয়া চোখের জলে একাকার হয়ে যাওয়া স্মৃতি! এখনো মনে জ্বল জ্বল করে ভাসে যখন পেনাল্টি শুটঅফ হতো দুই হাত দিয়ে চোখ ঢেকে রাখতাম। যদি প্রিয় দলটি গোল দিতে না পারে! সে এক অদ্ভুত উত্তেজনা। প্রিয় দলটি জিতে গেলে সেকি আনন্দ। আজো মনে আছে সুখময়তায় ভরে যাওয়া মনটির কথা। আর মাঠে সেকি উল্লাস উপস্থিত দর্শকদের উন্মাদনা সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। আর আড়চোখে বার বার বন্ধুদের দেখা যাদের দল হেরে গেছে, লুকোচ্ছে চোখের কোলের জমা অশ্রু। ‘যেদিন যায় সে দিন কি আর ফিরিয়ে আনা যায়’। আজ বিশ্বকাপ ফুটবলের মনমাতানো আসর শুরু হতে যাচ্ছে। রাশিয়া স্বাগতিক দেশ। মস্কোর লুঝনিকি স্টেডিয়ামে জাঁকজমক আর বর্ণাঢ্য উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর, স্বাগতিক রাশিয়া আর সৌদি আরব মুখোমুখি হবে উদ্বোধনী ম্যাচে। তারপর থেকে লেখা শুরু হবে জয় আর পরাজয়ের কাহিনী। এই আসরে ৩২টা দল অংশগ্রহণ করছে। ১৪ই জুন থেকে ১৫ই জুলাই চলবে এই গতিময় এবং এই ছন্দময় খেলা। কিন্তু কি অবাক ব্যাপার এক সময়ের তারকা সমৃদ্ধ চারবার বিশ্বকাপ জয়ী ইতালি দল এই খেলায় খেলতে পারছে না। কারণ তারা কোয়ালিফাই করতে পারে নাই। “রাজা যায় রাজা আসে”। আজ থেকে আগামী একমাস ফুটবল প্রেমিকরা এক অদ্ভুত উন্মাদনায় মেতে থাকবে। বিশ্বকাপে মাতামাতি যেমন হবে প্রিয় দল নিয়ে তেমনি হবে আবার প্রিয় খেলোয়াড়কে নিয়েও। ভালো খেলা আর খেলা জেতা এক কথা নয়। সবচেয়ে বড় কথা হলো সব দলকে খেলতে হবে বিশ্বশক্তির সংগে। খেলা শেষে কত গল্প লেখা হবে, কত কথা বলা হবে, শুধু লেখা হবে না বল ধরতে না পারা গোল কিপারের মনের অনুভূতি!। আহারে!! এই খেলা চলাকালীন বাংলাদেশের মানুষ হয়ে যায় দুইভাগে বিভক্ত। আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিল। প্রিয় দলের জন্য বাড়ী গাড়ী এমনকি মানুষ তার শরীর পর্যন্ত ঢেকে ফেলে তার প্রিয় দলের পতাকায়। ভালোবাসা বুঝি একেই বলে। কি জানি। বিশ্বকাপটি সংগে নিয়ে পৃথিবীর ৯০টি দেশ ভ্রমণ করেছে ফিফার অন্যতম পার্টনার কোকা-কোলা। এই কাপটি বাংলাদেশে বেড়াতে এসেছিল ২০১৩ সালের ১৭ ডিসেম্বর। যে কাপ নিয়ে এতকিছু সেই কাপটির সংগে দাঁড়িয়ে কতজন ছবি তুলছেন। সেই সৌভাগ্যবানরা নিশ্চয়ই মাঝে মধ্যে অবাক হয়ে বিশ্বকাপ এর সংগে তাদের নিজের ছবির দিকে তাকিয়ে থাকেন! কি অপূর্ব সেই স্মৃতি!
এখন একটু ইতিহাসের পাতা খুলে দেখি-- ১৯৩০ সালে এই বিশ্বকাপ ফুটবলের পথ চলা শুরু। উরুগুয়ে! ওরাই তো ফুটবল বিশ্বের প্রথম বিশ্বকাপের আয়োজক। এবং সবচেয়ে বড় কথা রাজধানী মন্টিভিডিওতে এস্তাদিও সেন্তেনারিও স্টেডিয়ামে আর্জেন্টিনাকে ৪-২ গোলে হারিয়ে উরুগুয়ে পেয়েছিল প্রথম বিশ্বকাপ ট্রফিটি। সেই ট্রফিটির নাম ছিল জুলে রিমে ট্রফি।
প্রথম বিশ্বকাপ আয়োজনকারী ফিফা প্রেসিডেন্ট জুলে রিমের নামে এটির নামকরণ করা হয়। ১৯৭০ সালে ব্রাজিল তৃতীয় বারের মতো বিশ্বকাপ জিতলে তাদেরকে স্থায়ীভাবে দিয়ে দেয়া হয় কাপটি। ১৯৮৩ সালে সেই ট্রফিটি আবার চুরিও হয়ে যায়, আর উদ্ধার করা যায় নাই। ১৯৭০ সালের পর আরেকটি নতুন ট্রফি তৈরি করা হয় যা ফিফা বিশ্বকাপ ট্রফি নামে পরিচিত। এই ট্রফিটি আর কাউকে স্থায়ীভাবে দেয়া হয় না। বিশ্বকাপ জয়ী দল পরবর্তী বিশ্বকাপ পর্যন্ত ট্রফিটি তাদের কাছে রাখতে পারে। এরপর তাদেরকে সোনার প্রলেপ দেয়া একটি রেপ্লিকা দেয়া হয়।
জুলে রিমে ট্রফি হাতে কিংবদন্তী খেলোয়াড় পেলে বিশ্বকাপ ফুটবলের রয়েছে বর্ণিল ঐতিহ্য। ১৯৭০ সালের বিশ্বকাপের কিংবদন্তি পেলে আর ব্রাজিলের দৃষ্টিনন্দন ফুটবল শৈলী, সারা পৃথিবীর মানুষের মনে দাগ কেটে গিয়েছিল এবং সেই দলের আক্রমণ-ভাগকে সর্বকালের সেরা বলে আখ্যায়িত করা হয় এখনো পর্যন্ত।
আর্জেন্টিনার ফুটবলের কথা বললেই ম্যারাডোনা নামটি মুখে চলে আসে। যেন সমার্থক। কত ফুটবল খেলোয়াড়রা এসেছে কিন্তু ঐ নামটি ছাপিয়ে যাওয়ার মতো কেউ আসেনি। ১৯৮৬'র বিশ্বকাপে তারই এক গোলকে বলা হয় “ঈশ্বরের হাত” দিয়ে করেছিলেন গোলটি। যে গোল মাথা না হাত দিয়ে করা হয়েছিল, সেটা খুঁজে পেতেই বিশেষজ্ঞদের লেগেছিল বছরের পর বছর। শেষ পর্যন্ত তিনি নিজেই স্বীকার করে বিষটির ইতি টেনেছেন। তবে বলার সময় উল্লেখ করেছেন ওটা তার নয়, ছিল “ঈশ্বরের হাত”! ১৯৮৬ সালে ম্যারাডোনার ফুটবলের ট্যাকল আর ড্রিবলের অসাধারণ শৈল্পিক কারুকাজ তাকে সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে প্রিয় করে তোলে।
বিশ্বকাপ এর ইতিহাসে সবচেয়ে দ্রুততম সময়ের গোল হয় মাত্র ১১ সেকেন্ডে। ২০০২ সালে তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচে তুরস্কের স্ট্রাইকার হাকান সুকুর এই গোলটি করে হতভম্ব করে দিয়েছিল প্রতিপক্ষ দক্ষিণ কোরিয়ার খেলোয়াড়দের। ১৯৯৪ সালে রাশিয়ার সালেংকো, ক্যামেরুনের বিপক্ষে এক ম্যাচে ৫ গোল করেন। এক ম্যাচে এটাই এখনো পর্যন্ত বিশ্বকাপ এর সর্বোচ্চ গোল। আবার কিছু দুঃখজনক ঘটনাও আছে। ১৯৯৪ সালে কলম্বিয়ার খেলোয়াড় আন্দ্রস এস্কোবার যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আত্মঘাতী এক গোল করে কলম্বিয়াকে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে দেয় এবং এর ১০ দিন পরে তাকে হত্যা করা হয়। ১৯৯০ সালে চিলি আর ব্রাজিলের মধ্যকার খেলায়, চিলির গোলরক্ষক রোজাস্ক তার গ্লাভসের মধ্যে রাখা ব্লেড দিয়ে নিজেই আহত হন। এটা ধরা পড়ার পর চিলিকে ১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপ থেকে বাতিল করা হয়। আর রোজাস্ককে ১২ বছরের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের কারণে ১৯৪২ এবং ১৯৪৬ এই ২টি বছর ছাড়া, প্রত্যেক আসরেই কে হবে চ্যাম্পিয়ন এ নিয়ে ফুটবল প্রেমীদের মধ্যে চলে মাতম। যেদিন যে ভালো খেলবে সেই দলই জিতবে, তারকা খেলোয়াড়, কাপের ঐশ্বর্য কিছুই না। নক আউট পর্বে যে কোন দলের সমাধি রচনা হতে পারে! জয় সূচক গোল দিয়েই প্রমাণ করতে হবে “আমরাই সেরা”। ১৫ জুলাই বিশ্বকাপের শিরোপা হাতে নিয়ে উল্লাসে মেতে উঠবে শুধু একটি দেশের খেলোয়াড়রা। তার আগে ৩২টি দল প্রাণপণ লড়াই করবে ঐ ট্রফিটির জন্য। তাদের কারও মুখে থাকবে হাসি, আর কারও চোখে অশ্রু। বিশ্বকাপ ফাইনালের স্নায়ুস্প্র্শী উত্তেজনা আর অপেক্ষা-আগ্রহে কাঁপছে ফুটবল প্রেমী সারা বিশ্বের মানুষ। খেলাটা যেন উপভোগ্য আর দৃষ্টি নন্দন হয় এটাই সবার কাম্য। ফুটবলের ছন্দময় সৌন্দর্য মাঠে থেকে উপভোগ না করলেও দূরে থেকেও মনেপ্রাণে সংগে আছে বিশ্বের সব দেশের ফুটবল প্রেমীরা। সবাইকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে বলেই এর নাম “গ্রেটেষ্ট শো অন দা আর্থ।”
সুন্দর ফুটবলের পসরা সাজিয়ে ৩২ টা দল তাদের ছন্দময় খেলা দেখিয়ে ফুটবল প্রেমীদের আনন্দ দিবে এই প্রত্যাশা করি। যেন পায়ে পায়ে বুনে দেয় ফুটবলের সুষমা। যে আমি এক সময় প্রিয় দলের জয় পরাজয়ের আনন্দ বেদনার অনুভূতিতে বিশ্বকাপের পুরো সময়টা অতিবাহিত করতাম, আজ সেই আমি আমার দুই সন্তানের প্রিয় দলের জয়ে আনন্দিত হই আর পরাজয়ে ব্যথিত হই। আর তাই ওদের প্রিয় দলকে সমর্থন করি, ভাগাভাগি করে নেই হাসি-কান্নাকে। সব দলের জন্য শুভকামনা। স্বাগতম ২১তম বিশ্বকাপ ২০১৮।
ফওজিয়া সুলতানা নাজলী, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া
|