হৃদয়ে বাসা বাঁধা দিনগুলি ফওজিয়া সুলতানা নাজলী
সবুজ আঙিনা, তাতে সারি সারি দেবদারু, শরতে শুভ্র কাশফুল আর তার মাঝে থেকে থেকে বসে আছে নানান রঙের অবকাঠামো। সেই সাথে শিক্ষার্থীদের আনাগোনা, বাতাসে ওড়া বাহারের ওড়না, সালোয়ার কামিজ আর বিচিত্র রঙের শাড়ির সংযোজনে এক অনন্য রূপে আত্মপ্রকাশ করে আমার প্রিয় পাঠশালা-রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
আমি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে কাটিয়েছি আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সময়। কখনো পাখীর ডাক আর বাতাস-পাতার শো শো শব্দের মাঝে কাশফুল সযত্নে চুলে গুঁজে মৌনতায় একাকী কাটিয়েছি। আবার কখনো বন্ধুদের সাথে গরম গরম শিঙ্গাড়ার সাথে আড্ডার উচ্ছ্বাস উপভোগ করেছি। বোঝার আগেই কেটে গেছে চার চারটি বছর। কত ঘটনা, কত উচ্ছ্বাস, মৌনতা, কত স্মৃতি- সে কি ভোলা যায়? পৃথিবীতে আরো বহু সুন্দর বিশ্ববিদ্যালয় আছে, আমি জানি। তবু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আমার সবচেয়ে প্রিয় পাঠশালা। এর ঘাস আমি ছুঁয়ে দেখেছি শত সহস্রবার, মাটির গন্ধ নিয়েছি আকণ্ঠ, আর ফেব্রুয়ারিতে ক, খ, গ শুভ্র তাঁতের শাড়ীতে আঙিনার ঘাসে মিশে উজ্জ্বল আকাশ দেখেছি। আর সবুজ আঙিনা ছুঁয়ে আসা পদ্মাপাড়ের বাতাসের ঘ্রাণ আজো লেগে আছে আমার সর্বাঙ্গে। তাই তো এ পাঠশালা আমার এতো প্রিয়।
আড়াল থেকে বড়দের বিশ্ববিদ্যালয়ের নিত্যদিনের অভিজ্ঞতার কথা শুনে শুনে কখন যে এ বিশ্ববিদ্যালয় আমার নিজের পাঠশালা হয়ে উঠেছে তা বুঝতে পারিনি। একাকী ভাবতাম, কবে সত্যিকার অর্থেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ চত্বর হয়ে উঠবে আমার বিচরণ ভূমি। সময় তো আর বসে থাকে না – তাই দেখতে দেখত একদিন হয়েই গেল। ভর্তি হলাম মনোবিজ্ঞানে। মন আছে এবং তা যে বেশ কঠিন, তা বুঝতাম। কিন্তু বিজ্ঞান? তাতে ভীষণ দুর্বল। এতো যুগ পরেও জানিনা না কেন মনোবিজ্ঞানে মনোযোগী হয়েছিলাম।
তখন জীবন ছিল আশ্চর্য সুন্দর। আমদের সদ্য তারুণ্যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছিল সে সময়ের এ গ্রহের সবচেয়ে প্রাণবন্ত দ্বীপ। ইচ্ছে করলেই আকাশে উড়ে যেতে পারতাম। এখনো মনে হয় আমাদের জীবনের মধুরতম সংগীত লেখা আছে ক্যাম্পাসের সকালের উজ্জ্বল আলোয়, দুপুরের উষ্ণতায় আর বিকেলের নরম আলোয়।
অনার্স পড়তে পড়তে আমার বিয়ে হয়ে যায়।স্বামীর কর্মস্থল ঢাকায়। অনার্স পাশ করে মাষ্টার ডিগ্রী করার সময়টা দ্রুত পার হতে থাকে, মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষার শেষ দিনে মনে এক মিশ্র অনুভূতির জন্ম নিল - একদিকে ঢাকায় নিজের স্বপ্নের সংসার শুরু করার আনন্দ আর অন্য দিকে প্রিয় ক্যাম্পাস মতিহার, প্রিয় বন্ধুদের ছেড়ে যাবার বেদনা, পৃথিবীটা এমনি একজনের প্রস্থান, অন্য জনের প্রবেশ। কবিগুরুর গানের মতো ‘তোমার হলো শুরু আমার হলো সারা, তোমায় আমায় মিলে এমনি বহে ধারা’।
সংসার, দেশ-বিদেশ, জীবনের চড়াই-উতরাই, তবু স্মৃতিতে আজও জমা হয়ে আছে কালজয়ী হয়ে আছে, হারিয়ে যাওয়া সেই সোনাঝরা দিনগুলি। এইতো সেদিন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বন্ধুরা মিলিত হলাম। তবে এবার আর আমার প্রিয় বিদ্যাপীঠের সবুজ চত্বরে নয়, জুমে। এবার আর আড়ালে না থেকে, একই সোনালী পর্দায়। সেই ফেলে আসা প্রথম তারুণ্যে। ভাবি, মনোবিজ্ঞানে নয়, প্রকৃত বিজ্ঞানের বদৌলতে।
আশ্চর্য! মনেই হয়নি মাঝে কেটে গিয়েছে অনেকগুলো বছর। চুলে দ্যাখা দিয়েছে রুপালি ঝিলিক।বন্ধুরাই পারে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে সেই সোনালী বেলায়। মিষ্টি দুষ্টামি ভরা চেনা মুখগুলো ফিরে ফিরে দেখি। বন্ধুদের স্মৃতিচারণে কতটুকু মনোযোগী ছিলাম, তা স্মরণে নেই, তবে স্মৃতির পেছনের স্মৃতিতে আচ্ছন্ন ছিলাম, তা অস্বীকার করতে পারবো না। ধীরে ধীরে মনটা কেমন যেন ভারী হয়ে ওঠে। একি আমার পাঠ মনোবিজ্ঞানের প্রভাব?
ফওজিয়া সুলতানা নাজলী, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া
|