“বাস্তববাদী হও, অসম্ভব কে দাবী কর”, চে গুয়েভারা ফওজিয়া সুলতানা নাজলী
আমার কিশোরী বয়সে ভাইদের মুখে চে গুয়েভারার নামটি শুনেছিলাম কিন্তু অতটা কৌতূহলী ছিলাম না নামটির প্রতি। তখন আমার চঞ্চল কিশোরী মন, এদিক, ওদিক, সেদিক। কখনো নিমাই ভট্টাচার্য, ফাল্গুনি মুখোপাধ্যায় বা নিহারঞ্জন গুপ্ত আর একটু করে করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আর মনোযোগী ছিলাম লিও সায়ার, এন্ডি গিবস এর রোমান্টিক গানের প্রতি। কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে এলাম। সে সময় শিক্ষক যখন ক্লাসে জিজ্ঞেস করতেন 'তোমার জীবনের আদর্শ কে?' অনেক ছেলেরাই বলতো চেগুয়েভারা। তখনও তেমন আগ্রহ দেখাই নাই নামটির প্রতি। চে’কে আমার চেনাই হতোনা, এভাবেই হয়তো নামটি অচেনা থেকে যেতো যদিনা আমার এক বন্ধু আমাকে চে’র উপর একটি বই উপহার না দিত! সেই থেকেই চে’র সংগে আমার পরিচয়।
আজ ৯ই অক্টোবর বিংশ শতাব্দীর কিংবদন্তী বিপ্লবী চে গুয়েভারার মৃত্যুবার্ষিকী। বলিভিয়ার প্রত্যন্ত গ্রাম লা হিগুয়েরাতে ১৯৬৭ সালের এই দিনে মাত্র ৩৯ বছর বয়সে চিরবিদায় নিলেন বিপ্লবের বরপুত্র চে গুয়েভারা। বলিভিয়ার সামরিক সরকার আর মার্কিন সিআইএ যৌথভাবে চে’কে বন্দি অবস্থায় বিচার না করে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিল। চে’র আদর্শ ছিল সমাজতন্ত্র। তিনি নিজের জীবনকে বিলিয়ে দিয়েছিলেন মানুষের কল্যাণের স্বার্থে। চে তার রচনার মধ্যে দিয়ে বলে গিয়েছেন 'আমরা যেন বিষয় কিংবা অর্থের প্রতি অনুরক্ত না হই। আমাদের অনুরাগ থাকা উচিত চেতনার প্রতি, আদর্শের প্রতি। ' আর্নেস্তো গেভারা দে লা সের্না ছিল চে'র আসল নাম।
১৪ই জুন ১৯২৮ সালে তার জন্ম আর্জেন্টিনায়। পেশায় ছিলেন একজন চিকিৎসক। পরবর্তীকালে এই চিকিৎসক পরিণত হন কিংবদন্তি বিপ্লবীতে। লাতিন আমেরিকা আর পৃথিবীর নিপীড়িত নিঃস্ব মানুষের জন্য চে’র জীবন সংগ্রাম শুরু হয়েছিল।
১৯৫৬ সালে মেক্সিকো থাকার সময় তিনি কিউবার নেতা ফিদেল কাস্ত্রের নেতৃত্বে বাতিস্তা শাসন উৎখাতে এক বড় ভূমিকা পালন করেছিলেন। কিউবা বিপ্লবে যিনি অসম সাহসী সংগঠক ও যোদ্ধা এবং তাত্ত্বিক নেতার ভূমিকা পালন করেছিলেন, তাকেই কিনা অন্যায়ভাবে হত্যা করা হলো বলিভিয়ায়। চে তার পেশা ছেড়ে দিয়ে জন্মভূমি আর্জেন্টিনা ত্যাগ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন “আমার জন্ম আর্জেন্টিনায় গুয়েতেমালায় বিপ্লবী হয়েছি, কিউবায় লড়েছি কিউবান হয়েছি। আমি একজন লাতিন আমেরিকান। আমি লাতিন আমেরিকার যে কোন দেশের জন্য প্রাণ ত্যাগে প্রস্তুত। বিনিময়ে আমার কিছুই চাওয়ার নেই”। বাবা মাকে তিনি চিঠি লিখেছিলেন “আমি পথে নেমেছি, অনেকেই হয়তো আমাকে আডভেঞ্চারার বলবে, আমি তাই, তবে একটা পার্থক্য আছে। আমি সেই ধরনের আডভেঞ্চারার, যে সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য জীবনের ঝুঁকি পর্যন্ত নিতে পারে।”
চে গুয়েভারা কবিতা ভালবাসতেন। তিনি অনেক কবিতা লিখেছেন। পাবলো নেরুদা ছিল তার প্রিয় কবি। তিনি সুন্দর কবিতা আবৃত্তি করতেন। দ্বিতীয় স্ত্রী আলিয়েদা মার্চ এর সংগে ছিল তার গভীর ভালবাসা। তারা পরস্পরের প্রতি গভীর ভাবে নির্ভরশীল এবং বিশ্বস্ত ছিলেন। শোবার ঘরে আলিয়েদা’র জন্য কবিতা পাঠ করতেন। যা তাকে গভীর আনন্দ দিত। হাভানা থেকে শেষবারের মতো চলে যাওয়ার আগে চে আলিয়েদা’র জন্য তার প্রিয় ভালবাসার কবিতাগুলো টেপ রেকর্ডারে স্বকণ্ঠে আবৃত্তি করে রেখে গিয়েছিলেন। তিনি মাত্র ২০ বছর বয়সে একটি কবিতা লিখেছিলেন নাম ছিল 'মৃত্যু' -
“মৃত্যু, হ্যাঁ, গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে বেয়নটের ফলায় ছিন্নভিন্ন হয়ে..... তা যদি না হয়, তো ডুবে মরা নয়। আমার নামকে ছাড়িয়ে যাবে আমার স্মৃতি, তা হলো লড়াই করা ও যুদ্ধ করে মরা।”
দুই দশক পরে কিভাবে বাস্তবে মিলে গিয়েছিল কুড়ি বছরের এক তরুণের আশ্চর্য ভাবনা। নিয়তির এক অদ্ভুত খেলা হয়েই যেন বলিভিয়ায় ক্ষমতায় এসেছেন আদিবাসী নেতা ইভো মোরালেস। যে বলিভিয়া একদিন নিরস্ত্র চে গুয়েভারাকে হত্যা করেছিল, সেই বলিভিয়ার প্রেসিডেন্ট এখন চে’র আদর্শ পথে চলেছেন। প্রতিনিয়ত সবাইকে মনে করিয়ে দিচ্ছেন রোগ দারিদ্রের বিপক্ষে চে’কে অনুসরণ করতে হবে।
চে’র হত্যাকারীরা একটা মানুষকে মেরে একটা আদর্শকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। কিন্তু তাই কি হয়েছে? কবির ভাষায় বলি, “তিনি মৃত তবু জীবিতের চেয়ে / অনেক সজীব এবং কান্তিমান”। তিনি হাজির হয়ে যান রাস্তায় রাস্তায়, মিছিলে আর স্লোগানে। কোন এক লেখায় পড়েছিলাম উনসত্তর থেকে একাত্তরের সেই দুঃসাহসিক দিনগুলোয় চে গুয়েভারা ছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামীদের কাছে উজ্জ্বল পতাকার মতো, সেই দিনগুলোয় চে’র লেখা গেরিলা যুদ্ধ বইটি মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে হাতে ঘুরেছে। কিউবার ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা প্রতিদিন তাদের স্কুল শুরু করে “আমরা চে এর মতো হবো” এই শপথ-বাক্য পাঠ করে। এসব দেশে এমন নেতৃত্বের উত্থান ঘটছে যারা চে’কে অনুভব করে। অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে লাতিন আমেরিকায় চে এখন অনেক বেশী প্রাসঙ্গিক, অনেক বেশী জাগ্রত।
চে কে যখন হত্যা করার আদেশ দেয়া হয়েছিল সেই আদেশ কার্যকর করা নিয়ে সমস্যা দেখা দিল। সাধারণ সৈনিকেরা কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না নিরস্ত্র চে’কে গুলি করতে। তখন বেছে নেয়া হয় মদ্যপ সৈনিক মারিও টেরান কে। ঘরে ঢুকে তিনি দেখতে পান চে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছেন। চে বুঝতে পারেন সৈনিকের উদ্দেশ্য। তিনি শান্তভাবে তাকে উঠে দাঁড়ানো পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলেন। চে কে জিজ্ঞেস করা হলো, “কি ভাবছ তুমি?” চে স্মিত হেসে জবাব দিলেন, “বিপ্লবের অবিনশ্বরতার কথা ভাবছিলাম।” সার্জেন্ট টেরেন চে’র দিকে না তাকিয়ে তার রাইফেল থেকে পর পর নয়টি গুলি করেন চে’র বুকে এবং বুকের পাশে। তারপর তাকে নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে। প্রত্যক্ষদর্শীর ভাষায় চে তখন আশ্চর্য জনক ভাবে জীবন্ত ছিলেন। চোখ দুটি শুধু খোলাই ছিল না অসম্ভব রকম সুন্দর লাগছিল। দু’টি ঠোটে লেগেছিল মর্মস্পর্শী হাসি। চে’র এই যিশুখ্রিস্ট সদৃশ ছবিই ছড়িয়ে পরেছিল বিশ্বের সর্বত্র এবং চে হয়ে যান এক কিংবদন্তি গেরিলা।
চে ঝরে গেছে চারিদিকে সৌরভ ছড়িয়ে। চে অমর, তার সাহসী জীবনে। চে মিশে আছে নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলায়।
আজকের দিনে কবি শামসুর রাহমানের কবিতায় চে’কে স্মরণ করি:
চে গুয়েভারার চোখ
যেখানেই যাই, অলিতে-গলিতে, গ্রন্থবিতানে, কাফেটারিয়ার ভিড়ে কী যেন তীব্র, অপ্রতিরোধ্য জ্বলজ্বল করে আমার সত্তা ঘিরে।
চুরুট রঙের সন্ধ্যায় মনে ভেসে ওঠে শুধু দূর বলিভিয়া-বন। ভাবি উচাটন বিশ শতকেও ঈশ্বরহীন সন্ত শহীদ হন।
সন্তের চোখ, শহীদের চোখ কে যেন দিয়েছে হৃদয়ে আমার সেঁটে, রক্তাপ্লুত একটি শরীর সকল সময় কী ঋজু যাচ্ছে হেঁটে।
আমার প্রহর হাঁটু মুড়ে বসে অবাধ জাগর তাঁর জীবনীর পাশে। কবিতায় ছুঁই হাত দুটি তাঁর, আত্মার ঘ্রাণ টেনে নিই নিঃশ্বাসে। তিনি মৃত তবু জীবিতের চেয়ে অনেক সজীব এবং কান্তিমান। ভবিষ্যতের জন্যে হেলায় দিয়েছেন ছুড়ে আপন বর্তমান।
ফওজিয়া সুলতানা নাজলী, সিডনি
|