তুমি যে তোমারই তুলনা ফওজিয়া সুলতানা নাজলী
তাঁর মৃত্যু সংবাদটি এক মুহূর্তে স্তব্ধ করে দিয়েছিল আমাকে। অনেকক্ষণ, অনেক অনেকক্ষণ বসে ছিলাম। পাখির ডাক ফুলের গন্ধ শিশিরের নরম হাল্কা সুবাস সব ছাপিয়ে তাঁর গানের মাঝে ডুবে গেলাম। যদিও জানতাম তিনি চলে যাবেন, তবুও ক্ষীণ একটা আশা ছিল অলৌকিক ভাবে আরো কিছুদিন হয়ত থাকবেন আমাদের মাঝে।
এন্ড্রু কিশোরের মৃত্যু সংবাদটি আমাকে ভীষণভাবে কষ্ট দিল, কেন? তাকে তো সেভাবে চিনতাম না। একই ইউনিভার্সিটিতে পড়েছি বলে কি?
অনেক দিন ধরেই তাঁর অসুস্থতার কথা শুনছিলাম। এন্ড্রু কিশোরের মৃত্যুর সংবাদে যেন আঘাত লাগলো আমার তারুণ্যের মধুর দিনগুলোর মাঝখানে। পিছন ফিরে ফিরে দেখছি কত স্মৃতি এক সঙ্গে ভিড় করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। স্মৃতি তো কখনো পুরনো হয় না। সম্ভবত আমার শোনা তাঁর প্রথম গান 'ওগো বিদেশিনী তোমার চেরি ফুল দাও আমার শিউলি নাও দুজনে প্রেমে হই ঋণী'। যে গানটি আমার মন কে মুগ্ধতায় ভরিয়ে দিয়েছিল। গানটি মনের মাঝে বারবার গুঞ্জরিত হতো।
মনে পরে টিভিতে ছায়াছন্দ নামের সিনেমার গানের জনপ্রিয় অনুষ্ঠানটি দেখতাম তুমুল আনন্দ নিয়ে। তখন তো বিনোদন বলতে সেসবই ছিল। নয়নের আলো ছবিতে নায়ক জাফর ইকবালের প্লে ব্যাকে এন্ড্রু কিশোর জয় করে নিলেন আমাদের মতো অসংখ্য তরুণ তরুণীর মন:
‘আমার বুকের মধ্যখানে মন যেখানে হৃদয় যেখানে সেখানে তোমাকে আমি রেখেছি কতনা যতনে’।
তিনি জড়িয়ে গেলেন আমার ভালো লাগায়, বন্ধুদের আড্ডায়, আর উদাস বিকেলের সঙ্গে। ছায়াছন্দ অনুষ্ঠান মানেই এন্ড্রু কিশোরের গান। আর রেডিওতে অনুরোধের আসরে সিনেমার গানের জন্য অনুরোধে তাঁরই কণ্ঠ। তিনি হয়ে উঠলেন প্লেব্যাক এর অঘোষিত সম্রাট।
তাঁর গাওয়া অসম্ভব মিষ্টি একটি প্রেমের গান রুনা লায়লার সংগে সৈয়দ শামসুল হকের রচনা আর আলম খানের সুরে:
“চাঁদের সাথে আমি দেবো না তোমার তুলনা নদীর সাথে আমি দেবো না তোমার তুলনা তুমি চাঁদ হতে যদি দূরেই চলে যেতে তুমি নদী হতে যদি দূরেই চলে যেতে সেকথা যেন ভুলো না তুমি যে তোমারই তুলনা”।
গানটি বুকের ভিতর জায়গা করে নিল। হৃদয়টা ঝুমঝুমিয়ে বেজে উঠতো। তাঁর কণ্ঠে যেমন ছিল দরদ তেমনি ছিল গ্লামার। তিনি তাঁর গান দিয়ে কয়েকটি প্রজন্মের কৈশোর এবং তারুণ্যকে রাঙিয়ে দিয়েছিলেন। আমাদের সবার মাঝেই হয়তো সময়ের এক বিশেষ অনুভূতি স্থির হয়ে থাকে। হয়তো সেই অনুভূতি থেকে বের হয়ে আসতে পারি না। এন্ড্রু কিশোরের গান সেই রকম একটা অনুভূতি, যা আমদের তারুণ্যের সোনালী সময়কে ভালোবাসায় সিক্ত করেছিল। সেই সময় রেডিওতে আমাদের প্রায় দুপুর এন্ড্রু কিশোরের গানে গানময় হয়ে উঠতো।
এন্ড্রু কিশোরের চলে যাবার সংবাদ আমাকে যেন মনে করিয়ে দিল, আমার তারুণ্যবেলার কথা। কবেই চলে গেছে সেইসব দিন। চলে গেলেন এন্ড্রু কিশোর। আমাদের তারুণ্যের গল্প ফুরিয়ে গেলো। আমাদের তারুণ্যে ভরা অনুভূতি এবং ভালোলাগা শিল্পীকে হারিয়ে ফেললাম।
“আমাদের গেছে যে দিন একেবারেই কি গেছে কিছুই কি নেই বাকী”।
কিন্তু স্মৃতি তো আছে তাকে তো কেউ কেড়ে নিতে পারে না। আমাদের জীবনের মধুরতম দিনগুলোর সঙ্গে তাঁর গান নিয়ে চিরদিন অবিচ্ছেদ্য ভাবে রয়ে যাবেন এন্ড্রু কিশোর। “হায়রে মানুষ রঙ্গিন ফানুস দম ফুরাইলে ঠুস!” এই সত্যটি মন মানতে চায় না। এই গানের গীতিকার সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক গানটির সুরকার আলম খানকে বলেছিলেন “যাকে দিয়ে এই গানটি গাওয়াবেন তিনি অমর হয়ে রইবেন” এবং এই গানটিই তাকে প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ভূষিত করেছিল!
২০১৩ সালে এন্ড্রু কিশোর সিডনি এলেন অনেক আনন্দ নিয়ে গান শুনতে গেলাম, সেই সুখ জাগানিয়া গান গাইতে শুরু করলেন মনে হলো আমার হৃদয় এখনো তেমনি আছে, আমার হৃদয় ঠিক যেমনটি ছিল। আমার হাজবেন্ড জুলুর কাছে তাঁর অনেক গল্প শুনেছি। তারা রাজশাহী শহরের একই পাড়ায় বড় হয়েছে। অনুষ্ঠান শেষে দেখা করতে গেলে জুলুকে দেখে 'জুলু জুলু' করে ডেকে পরম আন্তরিকতায় জড়িয়ে ধরেছিলেন। ভালো লেগেছিল তাঁর এই আন্তরিকতা।
শেষ দিনটি যেন রাজশাহীর সূর্যালোকে আলোকিত থাকতে পারেন সেটাই ছিল তাঁর শেষ ইচ্ছে। এই প্রিয় শহরে তাঁর জীবনের গল্প শেষ হয়ে গেল। এতটাই ভালোবাসতেন প্রিয় জন্মস্থানকে। অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী ছেলে-মেয়েকে দেখার অপেক্ষায় আছেন রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজের হিমাগারে পরম মমতায় দুচোখভরে তাদের দেখে মিলিয়ে যাবেন আকাশের সেই দুরের তারার দেশে। তাঁর গান নেশায় বুদ হয়ে শুনছি, চোখের কোনা দুটো কেন যেন ভিজে এলো। অনেক ভালো থাকবেন এন্ড্রু কিশোর।
ফওজিয়া সুলতানা নাজলী, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া
|