নাভার হোমওয়ার্ক তাহরিমা চৌধুরী নাভা
(নাভা নামের ছোট মেয়েটিকে হোমওয়ার্ক দেওয়া হল ভ্রমণকাহিনী লিখতে; তা থেকেই এ মজার লেখাটির জন্ম)
আমি নাভা। আমি আমার পরিবারের সবার সাথে আমার প্রথম বিদেশ ভ্রমণের দিনগুলোর কথা ভাবছি। দিনটা ছিল ২রা মার্চ। এইদিনে আমরা বাংলাদেশ থেকে সিঙ্গাপুরে যাওয়ার জন্য সব গুছিয়ে নিয়ে তৈরি হই। আমার সাথে বাবা-মা, বড়ম্মা (আমাদের বড় চাচীকে আমরা বড়ম্মা ডাকি) ছিল । আমাদের সঙ্গে নিয়ে সিঙ্গাপুরে বেড়াতে গিয়েছিল আমার অঞ্জনকাক্কু, শম্পাচাচী আর আমার চাচাতো বোন ইলারা চৌধুরী দানী। অঞ্জনকাক্কুরা অনেক দূরের দেশ আমেরিকায় থাকে। অঞ্জনকাক্কু সেই দেশে ইউনিভার্সিটির শিক্ষক। ওরা ওখান থেকে এসে আমাদের নিয়ে চললো।
আমরা এয়ারপোর্টে পৌঁছালাম সন্ধ্যা ছয়টায়। মজার ব্যাপার ঢাকা এয়ারপোর্টে খালুর (আমার তানিয়া খালার বর) সাথে দেখা। খালু যাচ্ছে লন্ডন ডাক্তারি বিষয়ে কি যেন একটা বড়সড় পরীক্ষা দিতে। তানিয়া খালা ও খালু দুজনেই ডাক্তার। ওরা কেন আরও পড়ে, আরও পরীক্ষা দিতে চায় ভেবে পাইনা। বড়কথা খালু আমাদের সবাইকে এয়ারপোর্টে খাওয়ালেন। খাওয়া শেষে আমরা খালুকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় দিলাম।
এবার আমরা একটা বড় জায়গায় ঢুকলাম। এটাকে বলে প্যাসেঞ্জার লাউঞ্জ। এখান থেকে আমি আর দানী কাচের জানালা দিয়ে বাইরে বড় বড় কয়েকটা এয়ারক্রাফট দেখলাম। কিছু সময় পর আমাদের ডাকলো পে¬নে উঠার জন্য। আমরা সারি বেঁধে একটা টানেলের মত দেখতে লম্বা রাস্তা দিয়ে হেঁটে পে¬নে উঠলাম। পে¬নের এয়ার হোষ্টেজ আমাদের Welcome জানিয়ে সিট দেখিয়ে দিল। আমি, দানী তিন নাম্বার সারিতে বাবার সাথে বসলাম। আমি ও দানী অনেক গল্প করলাম। তবে দানীর বার বার ঘুম পেয়ে যাচ্ছিল। প্রায় চার ঘণ্টা লাগলো সিঙ্গাপুর পৌঁছাতে। আমরা Changi Airportএ নেমেছিলাম। এয়ারপোর্টটা বিশাল বড় আর অনেক সুন্দর। আমরা সেখানে কয়েকটা জায়গায় কিছু ছবি তুললাম।
তারপর মামনিকে (আমার বাবার বোন যাকে আমরা সব বাচ্চারা মামনি ডাকি) আনতে তিন নম্বর টার্মিনালে যাই। অনেকটা সময় লাগলো ওখানে যেতে। মামনি আসলো অস্ট্রেলিয়া থেকে। সবাই মিলে হৈচৈ আনন্দ করতে করতে বড় দুই ট্যাক্সি ক্যাবে করে হোটেলে পৌঁছালাম। আমরা অর্চার্ড রোডে Orchard Hotelএ ছিলাম। হোটেলে ঢুকেই বসার জায়গাটা খুব সুন্দর। দানীর আবার ঘুম পাচ্ছিল। পাবেইতো ও আমেরিকা থেকেও লং জার্নি করে এসেছে। আমি এর মাঝে চারপাশ ভাল করে দেখতে থাকলাম। জায়গাটা দেখার মতোই। মাঝখানে চারটা পিলার। পিলারের চারদিকে চারটি ঘড়ি। চার ঘড়িতে পৃথিবীর চার জায়গার সময় দেখাচ্ছে Singapore, New York, Tokyo, London। চার পিলারের মাঝে বিরাট টবে বিরল প্রজাতির একরাশ ফুল। বিরল প্রজাতি বলছি কারণ আমি এর নাম জানি না। পরে জেনেছি এই ফুলকে সিঙ্গাপুর অর্কিড বলে।
হোটেলে ঢুকার বারান্দায় অর্কিডের পাশে বড়ম্মা। বড়ম্মা অর্কিড খুব ভালবাসে। আমি ও দানী বাবা-মার সাথে অর্কিডের সামনে দাড়িয়ে।
সবাই পিলারের চারপাশে রাখা আসনে বসে যখন গল্প করছে তখন অঞ্জনকাক্কু তিন রুমের তিনটা চাবি নিয়ে ফিরে আসলো। চাবি মানে তিনটা কার্ড। কার্ডগুলোতে এক একটা রুমের নম্বর লেখা আছে। আমরা চারতলাতে রুম পেয়েছিলাম। আমাদের বড় কাফেলার সবাই লিফটে উঠলাম। আমাদের ভ্রমণকারী এই দলকে অস্ট্রেলিয়ার ফুপা নাম দিয়েছিল কাফেলা। অঞ্জুকাক্কু মাঝে মাঝে ডাকছিল ‘কাফেলা রেডি’ শুনলেই আমরা সবাই হেসে উঠছিলাম। এবার লিফটে উঠেই ৪নং বোতাম টিপলাম। লিফ্টতো নড়েনা, তার দরজাও বন্ধ হচ্ছেনা। কি ব্যাপার? ঢাকায়তো আমাদের বাসায় বোতাম টিপলেই লিফট উঠা-নামা করতে পারে। তখন এক ফরেনার উঠলেন। উনি বললেন একটা কার্ড লিফটের নম্বরগুলোর উপর ছুঁয়ে নিয়ে তারপর ফোর্থ ফ্লোরের বোতাম টিপতে হবে। তাতেই কাজ হল। চারতলায় পৌঁছেই যে যার রুমে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়লাম। গিয়েই আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ দেখি মা ডাকছে ‘নাভা উঠো নাস্তা খেতে যাব এবার’। ধড়মড় উঠে বসলাম। এবার বুঝলাম আমরা আছি সিঙ্গাপুরে। হাতমুখ ধুয়ে তৈরি হয়ে আবার লিফট চড়ে নীচে নামলাম।
হোটেলের নীচতলায় ওই হোটেলের নিজস্ব রেস্টুরেন্টে আমরা সবাই মিলে নাস্তা খেলাম।
দানী, আমি, শম্পাচাচী ও মামনি আমরা নিলাম প্যানকেক। এরসাথে আমি-দানী নিলাম হট্ চকোলেট, মামনি শম্পাচাচী নিল কাপাচিনো। বাবা-কাক্কু, বড়ম্মা-মা অন্যকিছু অর্ডার করেছিল।
নাস্তা খাওয়ার পর অঞ্জনকাক্কু ঘুরে বেড়ানোর সব জায়গা ম্যাপ দেখে ঠিক করলো। তারপর ওখানে এসকারসনের ডেস্কে গিয়ে টিকিট সব কেটে আনলো, এতে অনেকটা সময় লাগলো। সেদিন দুপুরে আমরা চারপাশে ঘুরেফিরে দেখলাম। রাস্তা ও চারপাশের সব বিল্ডিং খুব পরিচ্ছন্ন ও গাছপালা ভর্তি। আইল্যান্ডগুলোতেও বিরাট বিরাট সব গাছ। গাছ দেখে বাবা বারবার বলছিল দেখতো আমাদের দেশে গাছ কেটে ফেলে; এমন কি আইল্যান্ডের গাছও বড় হতে দেয় না’। একটু পরপর ঝিরিঝিরি বৃষ্টি নামে আবার বেশীক্ষণ থাকেও না। ওই বৃষ্টির পানি গাছপালার ধুলাবালি সব ধুয়ে দেয় তাতেই পাতাগুলো বৃষ্টির পরে আরও সবুজ চকচকে হয়ে উঠে। বাবা আবার বললো ‘গাছগাছালি আছে বলেই বৃষ্টি হয় ধুলাবালি দুর করে দেয়, গাছ ছায়া দেয়, আমাদের দেশে আমরা গাছের মূল্য জানিনা, যত্নও নেইনা।
দুপুরে ফাস্টফুড খেয়ে রেস্ট নিয়ে আবার বেরুলাম। আন্ডারগ্রাউন্ড ট্রেন চড়ার কথা সবাই বললো। পরদিন থেকে এসকারসন শুরু হবে। টুরিস্ট বাসে আমাদের নিয়ে যাবে। ট্রেনে চড়তে হলে আজকেই তা করতে হবে। হোটেলের রিসেপশন থেকে পরামর্শ দিল এই সময়ের মাঝে মোস্তফা সেন্টার থেকে ট্রেনে ঘুরে আসা যাবে। আমরা তাই গেলাম। ফেরার পথে রাতের খাবার আমরা খেলাম ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে। সিজলিং ভেজিটেবল্ উইথ চিজ সবার মজা লেগেছিল। বাবার ভাত খেতে ইচ্ছা করছিল তাই বিরিয়ানির অর্ডারও করলো। তবে খাবার এতো কিছু ছিল শেষে বিরিয়ানি কেউই ধরলোনা। অঞ্জনকাক্কু আর মামণি বললো ওদের ওখানে (মানে আমেরিকায় ও অস্ট্রেলিয়ায়) রেস্টুরেন্টে বিরিয়ানিতে এতো মসলা দেয় যে মনে হয় তরকারী দিয়ে মাখিয়ে ভাত দিয়েছে। আমাদের দেশে ফখরুদ্দিনের বিরিয়ানি খুব ভাল আর খুব মজা। তার-পরদিন থেকে আমাদের বেড়ানো শুরু হল।
প্রথমেই গেলাম Jurong Bird Park দেখতে। ওই পার্কে কত রকম পাখি দেখেছি বলে শেষ করতে পারবোনা। নানা জাতের ও নানা আকারের সুন্দর সুন্দর কত যে পাখি। তার মাঝে বেশীরভাগ Toucan, Hornbill আরও ছিল Singapurian Magpie, Spoonbill কমলা রংএর Flemingo । বড় বড় কিছু পাখিও ছিল। এক জায়গায় নীল রঙের Royal Roomble আর চড়ুইপাখি আমাদের কাছাকাছি উড়ছে, ঘুরছে। মনে হচ্ছিল পোষা। ওমা খেয়াল করে সবাই দেখলাম মাথার অনেক উপর দিয়ে খুব সূক্ষ্ম এক জাল বা নেট দিয়ে ওই পুরো জায়গাটা ঘেরা। আমরা নিজেরাই তখন এক খাঁচার মাঝে।
Night Safari তে এরপর ছিল এসকারসন। রাতের বেলা ছিল ওই ভ্রমণ। আমরা RMG লেখা বাসে করে গিয়েছিলাম। আমাদের প্রত্যেককে RMG লেখা গোলমতো স্টীকার জামায় লাগিয়ে নিতে হয়েছিল।। আমাদের গাইডের নাম ছিল সুজান। ওর হাতে একটি দণ্ড তার মাথাতে একটি ছোট্ট টেডিবেয়ার দণ্ড ঝাপটে ধরে বসা। আসলে ওটি ছিল টর্চের মতো লাইট আঁকড়ে বসা টেডি। আমরা লাইট দেখে অন্ধকারে গাইডকে ফলো করছিলাম। অনেক ভয়ংকর প্রাণী খোলামেলা ঘুরে বেড়াচ্ছিল। সাদা সিংহ দেখেতো আমরা অবাক। ভয়ও করছিল। গাইড বললো যে রাস্তা ধরে আমরা দু’দিক খোলা গাড়ীতে যাচ্ছি তার দু’পাশে তারের বেড়া। সেই তারের বেড়া ইলেক্ট্রিফাইড করা যার ফলে পশুরা এদিকে আসেই না। আমি ভাবছিলাম পশুরা জানলো কিভাবে যে তারের বেড়া ইলেক্ট্রিফাইড কাছে আসলেই কারেন্টের শক লাগবে। খুব অদ্ভুত ব্যাপারতো!
এরপর আমরা Creature of the Night Show দেখলাম। মাগো মা কি ভয়ংকর কাণ্ড। আলো নিভলো একেবারে ঘোর অন্ধকার সব। আলো জ্বলে উঠতেই সামনের মাটির মঞ্চে বিরাট এক সাপ একলোকের শরীর পেঁচিয়ে তার কাঁধের উপর দিয়ে উঁকি দিচ্ছিল। তারপর নাইট সাফারিতে দেখলাম Thumbuaker Performance । তারা আগুনের মশাল হাতে নিয়ে নাচলো। মশাল থেকে আকাশে আগুনের হল্কা ফু দিয়ে উড়িয়ে দিচ্ছিলো। অনেক লোকের সাথে বসে আমরা দেখছিলাম আমাদের গায়ে এসে আগুনের আঁচ লাগছিল। ওদের মুখ থেকেও মশালের মতো আগুন জ্বলে উঠে আকাশে হল্কা ছড়াচ্ছিল।
এরপরের এসর্কাসন ছিল Sentosa Islandএ। দারুণ সুন্দর হয়েছিল ওটা। অনেক অনেক কিছু দেখা হয়েছিল। কেবল কার, রোপচেয়ারে করে শূন্যে চড়েছিলাম। ওমা সবকিছু বাংলায় লিখলে নদী আপু আর আনান ভাইয়া পড়বে কিভাবে? আমি ইংরেজিতেই লিখবো এবার বাকীটুকু। তবে মাদাম তুসোর মিউজিয়াম নিয়ে কিছু বলি। ওখানে গিয়ে শুধু মনে হচ্ছে আমি অনেক কিছু এখনও জানিনা, চিনিনা। মাদাম তুসোর ওই মিউজিয়ামে মমের তৈরি সবাইকে চিনিনি। গান্ধীজী, তেন্ডুলকার, নেলসন ম্যান্ডেলা, সেরেনা উইলিয়ামকে চিনেছি, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকেও দেখলাম।
তবে মা আর বড়ম্মা খুব খুশী নিয়ে চায়ের টেবিলে বসা মোমের তৈরি একজন মহিলার সাথে ছবি তুললো। মহিলা কে জানতে চাইলাম। আমাকে বলা হল ‘তুমি চিনবেনা ইনি অড্রে হেপবার্ন, খুব গুণী মহিলা, বড় হলে জানবে ইনাকে’। তখন মনে হলো আমাকে আরও জানতে হবে, শিখতে হবে।
তাহরিমা চৌধুরী নাভা, ঢাকা |