bangla-sydney













বিদায় ফুটবল-সম্রাট পেলে!
আনিসুর রহমান নান্টু


চির দিনের মত বিদায় নিলেন ফুটবল-সম্রাট পেলে (১৯৪০-২০২২)। ৮২ বৎসর বয়সে মরণ-ব্যাধি ক্যান্সারের কাছে হেরে গেলেন তিনি। রেখে গেলেন তাঁর জাদুকরী মহিমা যা চির দিন জীবিত থাকবে। ফুটবল বিশ্বে আরো বহু নতুন তারকার আবির্ভাব হবে কিন্তু পেলে চির দিন হয়ে থাকবেন সর্বকালের সর্বযুগের সেরা। বহু দিন থেকে তিনি ক্যান্সারে ভুগছিলেন এবং এর সাথে লড়তে লড়তে শেষ পর্যন্ত গতকাল ২৯ শে ডিসেম্বর শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছেন তিনি।

ব্রাজিলের সাও পাওলো শহরের একটি দারিদ্র-পীড়িত বস্তিতে ১৯৪০ সালে তাঁর জন্ম। আসল নাম এডসন অরিন্টাস ডো নাসিমান্টো; ডাক নাম ডিকো। ছোট বেলায় মোজা মুড়িয়ে বল বানিয়ে কিংবা জাম্বুরা দিয়ে রাস্তায় ফুটবল খেলতেন তিনি। ঠিক খেলতেন না, খেলার পাশাপাশি জাদুকরী সব মুহূর্তের জন্ম দিতেন ওই অল্প বয়সেই। একটা ফুটবল কিনে দেওয়ার সামর্থ্য ছিল না পরিবারের। তাঁর প্রতিভা দেখে স্থানীয় একটা ক্লাব তাদের জুনিয়ার দলে তাকে খেলতে নেয়। সে সময়ে বয়স ভিত্তিক দুটি দলে ঐ ক্লাবের হয়ে ছোট ডিকো খেলতো। একটি দলের সে গোলকিপার এবং আরেকটি দলে সে স্ট্রাইকার। বছর শেষে দেখা গেল, গোলকিপার হিসেবে সে সেরা গোলকিপার এবং স্ট্রাইকার হিসেবেও সে সেরা স্ট্রাইকার। সর্বোচ্চ গোল দাতা।

সে সময় তার খেলা দেখে, কেউ একজন তাকে পেলে বলে সম্বোধন করে। পেলে ডাক শুনে ছোট ডিকো খুবই রেগে যায়। কাছে এসে বলে আমার নাম ডিকো, পেলে নয়। এর পর শুরু তাকে উত্যক্ত করা। বিশেষ করে প্রতিপক্ষ যখন দেখলো ডিকোকে আটকানো যাচ্ছে না, তখন মাঠের বাহির থেকে তাকে পেলে পেলে বলে চিৎকার করে রাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হোত। পেলে বলে ডাকার জন্য সে একবার তার স্কুলের কয়েক বন্ধুকে মারধোর করে এবং এর জন্য তাকে শাস্তি দেওয়া হয়। তাকে বোঝানো হয়, সে যত রেগে যাবে তত বেশি তাকে সবাই পেলে বলে ডাকবে, তাই তাকে এটা উপেক্ষা করতে হবে, তানা হোলে সে বেশি দূর যেতে পারবে না। এরপর সে উপেক্ষা করা শিখলো এবং কালক্রমে তার আসল নাম হারিয়ে গিয়ে পেলে নামে পরিচিত হয়ে গেল বিশ্বময়।

১৫ বছর বয়সে সেই ছেলেটিই সান্তোসের মূল দলের হয়ে খেলে গোলের বন্যা বহিয়েছেন। ১৬ বছর বয়সেই সুযোগ পেয়েছেন ব্রাজিলের জাতীয় দলে। আর ১৭ বছর বয়সে ১৯৫৮ সালে ৪ ম্যাচে ৬ গোল করে ব্রাজিলকে জিতিয়েছেন বিশ্বকাপ। তিনিই বিশ্বকাপজয়ী সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড়! কিন্তু সেটা কেবলই পেলের শুরু।

১৯৫৮ বিশ্বকাপের আগে পেলে চোট পেয়েছিলেন। তাঁর সতীর্থরাই চাপাচাপি করে পেলেকে সুইডেন বিশ্বকাপে নিয়ে যান। সেই বিশ্বকাপে পেলে ৬টি গোল করেন। ফাইনালে জোরা গোল করেছিলেন। ম্যাচ শেষে আনন্দের আতিশয্যে মূর্ছা গিয়েছিলেন ১৭ বছর বয়সী পেলে। জ্ঞান ফেরার পর প্রতিপক্ষ (সুইডেন) দলের খেলোয়াড় সিগভার্দ পার্লিং পেলেকে বলেছিলেন, ‘তোমার দ্বিতীয় গোল দেখে আমার তালি দিতে ইচ্ছে করছিল।’

১৯৬২ বিশ্বকাপে পেলে চোটের কারণে দুই ম্যাচের বেশি খেলতে পারেননি। সেবার ব্রাজিলকে জেতালেন গারিঞ্চা। ১৯৬৬ এর বিশ্বকাপেও কড়া ট্যাকলের শিকার হয়ে পেলে বিদায় নিলেন প্রথম রাউন্ড থেকে। ব্রাজিলও বিদায় নেয় তাঁর সঙ্গে। এই চোটের কারণেই ১৯৭০ বিশ্বকাপে পেলের খেলার কথাই ছিল না। কিন্তু এই বিশ্বকাপেই ‘গোল অব দ্য সেঞ্চুরি’র পাসটি ছিল তাঁর পা থেকেই। ‘শতাব্দীর সেরা ফুটবলার’-এর সিগনেচার পাস ছিল সেটি। ইতালির বিপক্ষে সেই ফাইনাল ৪-১ গোলে জিতেছিল ব্রাজিল। এই ম্যাচে পেলেকে মার্ক করার দায়িত্ব ছিল ইতালির ডিফেন্ডার তারচিসিও বারজিনিচের ওপর। তিনি বলেছিলেন, ‘ফাইনালের আগে আমি নিজেকে বার বার বুঝিয়েছিলাম, পেলে আমাদের মতোই রক্তমাংসের মানুষ। আমি ভুল ভেবেছিলাম।’

এবার পেলে সম্পর্কে কিছু ফুটবল বোদ্ধাদের বক্তব্য:

১)‘আমি শৈশব থেকেই পেলের ভক্ত। পরে পেলে ও ম্যারাডোনার দ্বৈরথ সামনে আসল। তবে আমার জন্য পেলেই সেরা।’
- সর্বকালের সেরা কোচদের একজন স্যার আলেক্স ফার্গুসন

২) ‘পেলে সর্বকালের সেরা খেলোয়াড়। তিনি দীর্ঘ ২০ বছর ধরে রাজত্ব করেছিলেন। বাকি সবাই- ডিয়েগো ম্যারাডোনা, ইয়োহান ক্রুইফ, মিশেল প্লাতিনি সবাই তাঁর নিচে। পেলের সঙ্গে তুলনা করার মতো কেউ নেই।’
- সর্বকালের অন্যতম সেরা খেলোয়াড়ের একজন ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার।

৩) ‘ইতিহাসের সেরা খেলোয়াড় হলেন ডি স্টেফানো। আমি পেলেকে কোনো শ্রেণিতে হিসেবে দেখতে চাই না। তিনি সে সবের ঊর্ধ্বে।’
- হাঙ্গেরির কিংবদন্তি ফুটবলার ফেরেঙ্ক পুসকাস।

৪) ‘আমার মাঝেমধ্যে মনে হয়, ফুটবল আবিষ্কারই হয়েছে এই জাদুকরী খেলোয়াড়টির জন্য।’
- ইংলিশ কিংবদন্তি ববি চার্লটন

বর্তমানে সকল ফুটবল খেলোয়াড়দের খেলার ফুটেজ সহজে পাওয়া যায় বিভিন্ন মিডিয়ার কল্যাণে। ঐ সময়ে এই সব ফুটেজ অনেক কষ্ট করে জোগাড় করতে হোত। এরপর শুরু হোল গোপনে পেলের খেলার ফুটেজ সংগ্রহ করা যাতে তাকে আটকাবার কৌশল উদ্ভাবন করা যায়। এই ঘটনা প্রকাশ পাওয়ার পর ব্রাজিলের ফুটবলারদের মাঝে হাসির রোল পড়ে যায়। তারা বললো এটা করে কোন লাভ হবে না কারণ পেলে এমন একজন খেলোয়াড় যে একবার যে কৌশল ব্যবহার করে, সে কৌশল দ্বিতীয়বার ব্যবহার করে না। সে ছিল বাঁহাতি বা নেটা বা বাইয়া কিন্তু তার দুই পারের দক্ষতা ছিল প্রায় একই মানের।

বর্তমান যুগের মেসি এবং কিছু দিন আগের মারাডোনার খেলায় ধরনটা প্রতিপক্ষ বুঝতে পারে কারণ তারা জানে এই দুই খেলোয়াড় বা পায়ে খেলবে। বাম পায়ের জন্য সুবিধা জনক জায়গা দিয়ে বল নিয়ে যাবে, তাই সাথে সাথে রক্ষণ কৌশল পরিবর্তন করে ফেলার সুযোগ আছে কিন্তু পেলের ক্ষেত্রে সেই সুযোগ ছিল না কারণ সে ডান বাম দুই পায়েই খেলতে পারতো।

পেলের সাথে বাকি সব খেলোয়াড়ের গুণগত একটা বৈশিষ্ঠের পার্থক্য সবার চোখে পড়বে, সেটা হোল খেলা এবং বল নিয়ন্ত্রণের উপরে তার দাপট। এই দাপট বা শক্তি বা পাওয়ার তখনই করা সম্ভব যখন এই নিয়ন্ত্রণ মাত্রা সর্বোচ্চ পর্যায়ে চলে যায়। মাত্র দুই জন ফুটবলারের মাঝে এই দাপটের কিছুটা ঝলক দেখা গেছে পরবর্তীতে; তারা হলেন মারাডোনা এবং ব্রাজিলের রোনালদো ডি লিমা কিন্তু তাদের মাত্রা পেলের মত ছিল না।

পেলেই একমাত্র খেলোয়াড় যিনি গোলকিপার থেকে শুরু করে প্রত্যেক পজিশনে খেলতে পারতেন। তাঁর মত এখনো কেউ নেই। দৌড়ে এবং জিমনাস্টিকে তার অলিম্পিকে পদক পাওয়ার মত যোগ্যতা ছিল। ১৯৬০ সালে তার ১০০ মিটার দৌড়ের সময় ছিল ১১ সেকেন্ড, ১৯৬০ সালের অলিম্পিকে ১ম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় সময়ে ছিল ১০.২ থেকে ১০.৩ সেকেন্ড। ফুটবলার না হলে তিনি অবশ্যই অলিম্পিকে দৌড় বা জিমনাস্টিকে স্বর্ণ পদক পেতেন। শুধু খেলোয়াড়ই নন পেলে একজন গায়কও ছিলেন। গিটার বাজিয়ে গান করতেন তিনি।


পেলে বেশ কয়েকটা সিনেমায় অভিনয়ও করেছিলেন। ২য় বিশ্বযুদ্ধে জার্মান বাহিনীর হাতে বন্দিদের কাহিনী নিয়ে নির্মিত Escape to Victory ছবিতে সিলভেস্টার স্ট্যালোন এর সাথে অভিনয় করেছিলেন তিনি।

পেলের কীর্তি ইতিহাস হয়ে থাকবে সর্ব যুগে। তাঁর মত অসাধারণ ফুটবলার উজ্জ্বল হয়ে থাকবে সবার মননে। তিনি যদি আধুনিক যুগের ট্রেনিং সাপোর্ট পেতেন তাহলে ফুটবলের রেকর্ড কোথায় যেত তা কল্পনা করা কঠিন। সত্য কথা বলতে পেলে একজনই ছিলেন, শুধু একজনই!





আনিসুর রহমান নান্টু, সিডনি






Share on Facebook               Home Page             Published on: 31-Dec-2022

Coming Events: