bangla-sydney
bangla-sydney.com
News and views of Bangladeshi community in Australia












সুন্দর ফন্টের জন্য SolaimanLipi ডাউনলোড করে নিন...

তোমাদের কথা
নাইম আবদুল্লাহ


রবিবার সকাল বেলা। কাগজ কলম নিয়ে লেখার টেবিলে বসেছি। কি নিয়ে লিখব ভাবতে ভাবতে তন্দ্রার মতো এলো। মাথাটা টেবিলে কাগজের উপর রাখলাম। আধো ঘুম আর তন্দ্রায় দেখলাম সাত আট বছরের ফুটফুটে একটি মেয়ে দরজা ঠেলে আমার টেবিলের দিকে আসছে। ভুল বললাম একটি নয় সমবয়সী দু’টি মেয়ে। আমি বিনয়ে গলে গিয়ে বললাম

মামনিরা কি মনে করে?

ওদের একজন বলে উঠলো, মামনি বলছ কেন? তুমি কি আমাদেরকে চেনো? অন্যজন পাশ থেকে বলে উঠলো, এই ডাকটাও অসহ্য লাগে। আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললাম, আচ্ছা যাও, খালামনি ডাকটা কেমন? প্রথম জন তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল, এই ডাকটা চলতে পারে। অন্যজনও মাথা দুলিয়ে সায় দিল।

আমি বুঝে গেলাম ওদের সাথে মেপে আর হিসেব কষে কথা বলতে হবে। পাশের সোফা দেখিয়ে বললাম, খালামনিরা বসেন।

ওরা আপত্তির সুরে বলল, আমরা তোমার এখানে বসতে আসিনি। তোমাকে কিছু কথা শোনাতে এসেছি। আমি দম নিয়ে বললাম, কি বিষয়ে? ওরা আবারও বিরক্ত হয়ে বলল, তুমি আমাদের সাথে বড়দের মতো করে কথা বলছ কেন?

আমি কিছুটা চুপসে গিয়ে বললাম, আচ্ছা আমারই ভুল হয়ে গেছে।
প্রথম মেয়েটি বলল আমার নাম শোভা। পাশ থেকে অন্যজন বলল আমি নোভা।

শোভা বলতে শুরু করলো, তুমি যে কি সব ছাই ভস্ম লেখো না কিছুই বুঝতে পারি না। কারণ ওই সব লেখায় তুমি ছোটদের নিয়ে, তাদের সুখ দুঃখের কথা নিয়ে কিছু লেখো না। আমি মাথা নিচু করে ফেললাম।

নোভা বলল, আমি বাবাকে নিয়ে আলাদা থাকি। বাবা সারাদিন কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকে। আমি সারাদিন একা একা বুয়ার কাছে থাকি। বাবা গভীর রাতে ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফেরে। মা বেশ কিছুদিন আগে আমাদের ছেড়ে চলে গেছে।

আমি বললাম, কেন কেন?
প্রশ্নটা করেই মনে হোল আবার একটা বোকামি করে ফেললাম। এখনি হয়ত আবার বকুনি খেতে হবে।

নোভা আমার দিকে তাকিয়ে সরাসরি বলল, তার আমি কি জানি। আমি কি মা, যে তোমাকে উত্তরটা বলতে পারবো।

তারপর শোভা বলল, আমি মায়ের সাথে থাকি। মা একটি স্কুলে পড়ায়। সারাদিন স্কুল শেষে বাসায় এসে খাতা দেখে। বাবা আমাদের সাথে থাকে না কিন্তু সে মাঝে মাঝে আমাকে দেখার জন্য স্কুল গেটে দাড়িয়ে থাকে। আমার ভাল লাগে না।

আমার মুখ থেকে কথা সরছে না। আমি আসামির কাঠগড়ায় দাড়িয়ে আছি। উকিলদের জেরার সামনে পড়েছি। আমি ঘামতে শুরু করলাম।

এই ছেলেমেয়েরা মমতা স্নেহ আর ভালবাসা থেকে বঞ্চিত। আমরা বাবা মায়েরা একে অন্যের উপর দোষ চাপিয়ে খালাস। আমাদের মধ্যে বনিবনা না হলে কি করবো? আলাদা থাকা ছাড়া অথবা অন্য প্রেমিক প্রেমিকার হাত ধরে চলে যাওয়া ছাড়া আর উপায় কি? কিন্তু আমরা ক’জনে ভেবে দেখেছি এই ছোট মেয়ে দুটি যে সময় পার করছে সেই সময় যদি আমরাও ছোটবেলায় পার করতাম তাহলে আমাদের আজকের অনুভূতিটা কেমন হতো? আমাদের আজকের এই আয় উপার্জন কাদের জন্য? সেই ছেলেমেয়েরাই যদি মা-বাবার স্নেহ ভালবাসা থেকে বঞ্চিত হয় তাহলে আমাদের বেঁচে থাকার সার্থকতা কোথায়? এই ছেলেমেয়েরা দুঃখ কষ্টকে আগলে ধরে বড় হয়ে কি আমাদের তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করবে না?

ভুক্ত ভোগীরা হয়তো বলবেন - ভায়া, জ্ঞান দেওয়া যত সহজ বাস্তব ঠিক তত কঠিন। আমাদের অবস্থানে থাকলে বুঝতে কত ধানে কত চাল। কিন্তু একটা ভাঙ্গা সংসারের ছেলেমেয়েরা কি কখনো পরিপূর্ণভাবে বেড়ে উঠতে পারে? এই ফুটফুটে বাচ্চা দুটির কি দোষ? তারা কি নিজের ইচ্ছায় এই পৃথিবীতে এসেছে? তাদের চাঁদ মুখের দিকে তাকিয়েও কি আমরা বাবা-মায়েরা একটু সংযত হতে পারি না?

অল্পবয়সে বাবা অথবা মার স্নেহ থেকে বঞ্চিত ছেলেমেয়েরা সমাজের প্রতি এক ধরনের হতাশা আর ক্ষোভ নিয়ে বেড়ে উঠছে। তারপর তারা যখন পূর্ণ বয়স্ক হচ্ছে তখন অতীতের বাবা-মায়ের স্মৃতি স্মরণ করে নিজেরাও চারিপাশের অন্যদের বিশ্বাস করতে পারছে না। ফলে সমাজে ধীরে ধীরে অবিশ্বাসের বীজ ছড়িয়ে পড়ছে।

একটা পরিবারের ভেতর ভালো লাগা, মন্দ লাগা এসব থাকবেই। সংসারকে টিকিয়ে রাখতে গেলে নারী পুরুষ সবাইকেই ছাড় দিতে হবে। এটা বংশ পরম্পরায় হয়ে আসছে। আমাদের বাবা-মায়ের মধ্যে কি বিবেকের কিংবা আত্ম সম্মানের সংঘাত ছিল না? তারা তো মানিয়ে নিয়ে এক ছাদের নিচে থেকে আমাদের মানুষ আর বড় করেছে। তাহলে আমাদের বেলায় এমনটা হচ্ছে কেন? শিক্ষা মানুষকে বিবেকবান আর সচেতন করে গড়ে তোলে। তাহলে আমরা শিক্ষার মুখোশ পরে এ কোন ভাঙ্গনের খেলায় মেতে উঠেছি?

আমরা সবাই সচেতন আর বিবেকবান বলে বড়াই করি। কিন্তু নিজেদের ঘর ভেঙ্গে প্রথমেই আমাদের বাচ্চাদের বঞ্চিত আর বিতাড়িত করছি। আর তারপর তা ছড়িয়ে দিচ্ছি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মধ্যে। এই ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে যখন আমাদের দিকে করুণা আর ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকাবে তখন আমাদের অথর্বের মতো বেঁচে থাকার কি কোন অর্থ থাকবে?

হঠাৎ ছেলের ধাক্কায় আমার তন্দ্রা উবে গেল। সে অবাক হয়ে বলল, বাবা তোমার চোখ ভেজা কেন? এমন করে এদিক ওদিক কি খুঁজছো? তুমি কি ঘুমের মধ্যে ভয়ের স্বপ্ন দেখে কেঁদেছো?

সে চোখ মুছতে টিস্যু পেপার এগিয়ে দিল। আমি তাকে জড়িয়ে ধরলাম। তারপরও অবচেতন মনে শোভা নোভাকে খুঁজতে লাগলাম। ওদের সাথে বাস্তবেও আমার দেখা হয়? কিন্তু আমি ওদের কিছু বলার সুযোগ দেইনা, এড়িয়ে যাই। তাইতো ওরা স্বপ্নে দল বেঁধে এসেছে। আমি ওদের কথার কোন উত্তর দিতে পারিনি। আর ওরা আমার কাছ থেকে কোন উত্তর পাবে এই আশায় ভর করেও আসেনি। এরা আমাদের সমাজের চারপাশে অবহেলিতের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ওদের দীর্ঘশ্বাসে চারিদিক ভারী হয়ে আছে।






Share on Facebook               Home Page             Published on: 12-Jun-2014

Coming Events: