অনেক বছর আগের কথা। তখন ক্লাস সেভেন কিংবা এইটে পড়ি। স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা শেষে নানা বাড়ি বেড়াতে গিয়েছি। আমার অন্যান্য আরও খালাতো আর মামাতো ভাইয়েরাও এসেছে। শিমুল ভাইও এসেছেন। তিনি ঐ বছর ঢাকায় কলেজে ভর্তি হয়েছেন। আমরা সবাই সারাদিন শিমুল ভাইয়ের পেছনে ঘুর ঘুর করি। উনি ভালো গান করেন। অবাক করা জাদু দেখান। যখন তখন আমদের এটা সেটা খাবার কিনে দেন। এক কথায় অল্পদিনের মধ্যেই আমরা সবাই তার ভক্ত হয়ে গেলাম।
এভাবেই ছুটির দিনগুলো খুব আনন্দে কেটে যাচ্ছিল। আমরা একদিন সবাই মিলে শিমুল ভাইকে চেপে ধরলাম ভূত দেখাবার জন্য। তিনি অনেকক্ষণ চিন্তা করে অবশেষে আমাদের ভূত দেখাতে রাজী হলেন। তবে উনি ঢাকা ফিরে যাওয়ার রাতে ভূত নামাবেন বলে কথা দিলেন। আমাদের অপেক্ষার প্রহর যেন আর শেষ হয় না।
অবশেষে সপ্তাহ ঘুরে শিমুল ভাইয়ের ঢাকা ফেরার সময় হয়ে গেল। আমরা সারাদিন ধরে শিমুল ভাইয়ের সাথে ভুতের জন্য বাতাসা, জিলাপি, আতর ইত্যাদি কিনলাম। রাতে খাওয়া দাওয়ার পর আমরা সবাই নানাদের বাংলা ঘরে হাজীর হলাম। প্রথমে শিমুল ভাই একা বাতাসা, জিলাপি ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র সহ ঘরে ঢুকল। বাতি নিভিয়ে কি কি সব মন্ত্র তন্ত্র পড়ে পুরা বাংলা ঘর বন্ধন দিয়ে ফেললো। তারপর শিমুল ভাইয়ের কথামতো কোন শব্দ না করে একে একে লাইন দিয়ে ঘরে ঢুকলাম। শিমুল ভাই আমদের সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল, তোমাদের অনুরোধে আজ আমি এই ঘরে ভূত নামাবো। এই কাজটা অনেক কঠিন, ভয়ের আর অনেক বছরের সাধনার কাজ। তোমরা যারা ভয় পাচ্ছ তারা দয়া করে এখনও ঘর থেকে চলে যেতে পারো। এই কথা শোনার পরে আমাদের সবার আক্কেল গুড়ুম। ঘরের ভেতরটা পুরা অন্ধকার থাকায় আমরা কেউ কারও মুখ দেখতে পাচ্ছিলাম না। কিন্তু আমাদের সবার শিরদাঁড়ায় একটা প্রবল ভয়ের স্রোত অনুভব করলাম। তিনি আমদের নিয়ম কানুন এবং করনীয় বিষয়গুলি বুঝিয়ে বললেন, আমরা তার কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করব বলে আশ্বস্ত করলাম। শিমুল ভাই তার সামনে একটা মাটির হাঁড়িতে ধুপ জ্বালিয়ে বিড় বিড় করে মন্ত্র পড়তে লাগলেন। তারপর তিনি একটি মাটির বড় সড় পাত্র আমাদের দিয়ে তার বিশেষভাবে তৈরি করা তেলটি মেখে নিতে বললেন। শিমুল ভাই সবাইকে সাবধান করে বললেন, সুগন্ধি মাখা তেলটা সবাইকে মুখে ও হাতে পায়ে ভালোভাবে মেখে নিতে হবে। তা না হলে বিশেষ ক্ষতি হতে পারে। আমরা তার কথামতো সবাই সারা মুখে আর হাতে পায়ে ডলে ডলে সুগন্ধি তেল মেখে নিলাম। শিমুল ভাই ততক্ষণে মন্ত্র পড়া শুরু করেছেন। বাইরে কাছাকাছি কোথাও গাছের ডাল পালা ভাঙ্গার বিকট শব্দ হল। তখন শিমুল ভাই আবার বললেন, বাইরে গাছের ডালপালা ভেঙ্গে ভূত আসছে। কিছুক্ষণের মধ্যে তোমরা সবাই ঘরের দরজা খোলার আওয়াজ পাবে। তখন ভূত বাবাজি দরজা খুলে ঘরে ঢুকবে। ভূত বাবাজি ঘরে ঢুকে কিছুক্ষণ চুপ চাপ থেকে তারপর তোমাদের সাথে কথা বলা শুরু করবে। তোমরা ততক্ষণ খুব শান্ত আর মাথা নিচু করে থাকবে। তারপর প্রতিটি কথার উত্তর খুব আদবের সাথে দিবে। তা না হলে ভূত বাবাজি আবার রাগ করে তোমাদের ঘাড় মটকে দিতে পারে।
একটু পরেই দড়াম করে দরজা খুলে গেল। ভূত বাবাজি ভেতরে ঢুকল। আমরা সবাই নিঃশ্বাস বন্ধ আর মাথা নিচু করে বসে আছি। বেশ অনেকক্ষণ পার হয়ে গেল। ভূত বাবাজির কোন সারা শব্দ নেই। আমাদের মধ্যে থেকে কেউ একজন শিমুল ভাইয়ের নাম ধরে ডাকল। তারপরেও কোন সাড়া পাওয়া গেল না। ভয় হল ভূত বাবাজি না আবার ভুল মন্ত্র পড়ার কারণে শিমুল ভাইকে তুলে নিয়ে গেল।
এমন সময় বাইরে বড় মামার গলার আওয়াজ পেলাম। তোরা সবাই বাংলা ঘরের দরজা খুলে রেখেই ঘুমিয়ে পড়েছিস। তিনি ঘরে ঢুকে লাইট জ্বালিয়ে আমাদের সবার জড়সড় হয়ে বসে থাকা আর সারা মুখে কয়লার কালো কালি মাখা দেখে বিস্ময়ে তাজ্জব বনে গেলেন। আমারা সবাই ধাতস্থ হয়ে সব ঘটনা তাকে খুলে বললাম। বড়মামা সব শুনে হাসিতে ফেটে পড়লেন। আর বলতে লাগলেন শিমুল আজ তোদের ভালো বোকা বানিয়েছে। কই ঐ গাধাটা কই বলে তিনি বাড়ীর ভেতরে শিমুল ভাইকে খুঁজতে চলে গেলেন। ভেতর বাড়িতে পৌছতেই আমাদের দেখে মামী খালারা হেসে কুটি কুটি। আমরা আয়নায় কয়লার গুঁড়ার সাথে তেলের পেস্ট যে যার চেহারা দেখে শিমুল ভাইয়ের ভূত দেখানোর নামে আমাদের বোকা বানানোর পরিকল্পনাটা পরিষ্কার হয়ে গেল। আমরা সবাই একজোট হয়ে শিমুল ভাইকে খুঁজতে বের হলাম। বাড়ীর কোথাও তাকে খুঁজে না পেয়ে অবশেষে আমরা তার তালাবন্ধ রুমের সামনে এসে দাঁড়ালাম। আমাদের সবার রাগত: ভঙ্গি দেখে ছোট খালা ফিক করে হেসে ফেলে বলে উঠলো, শিমুল আজ রাতের গাড়ীতে ঢাকা চলে গেছে।
নাইম আবদুল্লাহ, লেখক, সাংবাদিক - সিডনি
|