আমার মাদার্স ডে! ডা. নাহিদ সাইমা অনেকক্ষণ খুঁজলাম আম্মার একটা ছবি; এত্তগুলো এলবাম, সিডি, ডিজিটাল ফটো ফ্রেম এর মেমরি কার্ড, নাহ - কোথাও নেই!
ফেইসবুক খুললেই সবার মার ছবি; মনে হোলো - আচ্ছা দেখিতো!!! কিন্তু নাহ - পঁচিশ বছর কি খুব বেশি সময়? কই চোখ বন্ধ করে হাত বাড়ালেই তো এখনো ফিল করতে পারি সেই উঁচু তিলটা, ঠোটের পাশে - গায়ের ঘ্রাণ টাও তো পাই !!!
আম্মা স্কুল ছুটির দিনে দুপুরে গোসল করে নামাজ পড়ত। আমরা চার ভাই বোন গোল হয়ে বিছানার চার দিকে বসে থাকতাম। আম্মার শরীর ভালো থাকত না। পা ব্যথা করতো। আমরা টার্ন নিয়ে নিয়ে আম্মার পা টিপে দিতাম।
এখন বুঝি ভিটামিন ডি এর অভাব। muscle cramping . তখন বাংলাদেশের ডাক্তার রা ওষুধের পর ওষুধ দিয়ে আম্মাকে নির্জীব করে রাখতো। আম্মা বলতো - আল্লাহ যেন কখনো আমাকে তোমাদের বোঝা না বানায়।
আম্মা খুব রবীন্দ্রনাথ পছন্দ করতো। শেষের কবিতা পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা মুখস্থ বলতে পারতো। শেষের কবিতা পড়ে কলেজ এ থাকতেই ঠিক করেছিলো বিয়ের পরে মেয়ে হলে নাম রাখবে "মিতা "।
আম্মা কবিতা লিখতো। আম্মার একটা ডায়রি ছিলো বাধানো। সেখানে প্রথমেই আমাকে নিয়ে লেখা একটা কবিতা -
আমার অনেক সাধের মিতি এলো আমার অঙ্গনে আজ লয়ে চাদের তিথি সোনা দানা কোথায় পাবো দুঃখিনী মার বালা তাই তাহারে সাজাই আমি গাঁথি ফুলের মালা।
আরো অনেক ছিলো। আমি এখনো এক নিঃশ্বাসে সবটুকু বলতে পারি -
আমার তিন ছেলের মধ্যে সবচেয়ে ছোটো চার বছরের এশান এর এবারই প্রথম বুঝে শুনে mother's day প্রিপারেশন নেওয়া। আমাদের কোনোই ভূমিকা নেই এখানে। ও এবছর early childhood centre এ যাচ্ছে। গত সপ্তাহে একদিন ফিরে আসতেই দেখি খুশীতে ওর চোখ চক চক করছে। উত্তেজনা লুকাতে পারছে না।
"মাম - আই হ্যাভ এ সিক্রেট। আই কান্ট টেল ইউ টিল নেক্সট উইক"। আমি ওর গাল টা টিপে দিলাম - "মার কাছে আবার সিক্রেট কিসের রে বুড়া !!" "মাম ..মিস টোল্ড আস হাউ টু পেইন্ট এন্ড প্রিন্ট আওয়ার হ্যান্ড টু মেক এ কার্ড, বাট ইটস এ সিক্রেট!!!!"
ওর কথা অর্ধেক শোনার আগেই আমি রান্নাঘরে রাইস কুকারে চাল ধুয়ে দিয়ে ডিপ ফ্রিজ থেকে চিকেন থাই ফিলেট বের করে পানিতে ভিজিয়ে ক্লিনিক এর কাপড় চেঞ্জ করতে বেডরুমে যাই। নামাজ শেষ করে রান্না করতে করতেই নাব্হান ইউনিভার্সিটি থেকে এসে "মাম ফুড... মাম ফুড..." করতে করতে ঢুকবে।
তারেক এশান কে গোসল দিয়ে মসজিদে এশা পড়তে যাওয়ার জন্য রেডি। শায়ান "মাস্টার শেফ "অন করে কিচেনে ঢুকবে আর বের হবে। "মাম হাঙ্গরি... কখন হবে ফুড..."
আমার হাত আর ঘড়ির কাটার সাথে সারা জীবনের কমপিটিশন !!!
এশানের সারা দিনের গল্প শোনার জন্য আমার হাত আরো জোরে চলে ..."আব্বু তুমি বলতে থাকো - আমি এখনি আসছি" যতক্ষণে আমি রেডি ..ততক্ষণে ও বেচারা গভীর ঘুমে !!
আমি রেগুলার vit D খাই। আমার পায়ে কখনো muscle cramp হয় না। কিন্তু ব্যাক পেইন হয়। ডেন্টিস্ট দের রাজরোগ। আমি যে ব্যস্ত ডেন্টিস্ট। ননস্টপ রোগী দেখি তার প্রমাণ। ডিস্ক একটু মুভ করবেই। তার জন্য ফিজিও আছে, ম্যাসাজ আছে, পেইন কিলার আছে।
আমিও আল্লাহ কে বলি - আল্লাহ বাচ্চা গুলোকে ঠিকমতো মানুষ করার তৌফিক দিও। আমি যেন কারো বোঝা না হই।
এশান মাঝে মাঝে দৌড় দিয়ে আসে। হাগ দেয়। মাম - ইউ নো হাউ মাচ আই লাভ ইউ? কতো বাবা ?? আপ টু দা স্কাই!!!! বলতে বলতে খিলখিল করে হাসে। আমার আনন্দে বুক ভরে যায়; চোখে পানি আসে...
আচ্ছা আম্মা কে যে এতো ভালবাসতাম আমরা চারটা ভাইবোন। আমাদের পৃথিবীটাই ছিলো আমাদের বিছানায় শুয়ে থাকা মা - একদিনও কি আম্মাকে বলেছি -
আম্মা তোমাকে কতো ভালবাসি বলতো??? .....আপটু দা স্কাই !!!!!
নাবহান পড়তে পড়তে ছুটে আসে মাঝে মাঝে। মাম ডায়বেটিস এর সব মিলে যাচ্ছে। আমারও থার্স্টি লাগে - বাথরুম যেতে হয়! আমি হাসি - দূর বোকা! আমাদেরও ওরকম মনে হতো পড়ার সময় - সবার হয় - এতো সহজ ডাক্তার হওয়া?? আয় আমরা কফি খাই একসাথে - একটু ব্রেক নে। ও বলে...আমি বানাই ?? ভারী তো আমার কফি বানানো। ব্ল্যাক কফি। শুধু গরম পানি মেশানো। কিন্তু খুশিতে আমার গলা বন্ধ হয়ে আসে ....আমার ছেলে ...
শায়ান কে নিয়ে মাঝে মাঝে শপ এ যাই বা টেনিস খেলার মাঠে ড্রপ করি ..ইচ্ছা করে রাস্তা ভুল করি। বলি ... বাবা ..কোথায় যে আবার আসলাম ..কিছুই তো চিনিনা ..ভয় লাগে তো .. ও ব্যস্ত হয়ে মোবাইল এ জিপিএস দেখে .." উফ মাম ..ইফ আই ওয়াজ নট হিয়ার ..তুমি এখনো একটা বেবি.. ডোন্ট ওয়ারী..আমি দেখছি .." ......আমি হাসি ..কেনো যে এতো খুশি লাগে ! আমার ছেলে যে তাই ?
আম্মার হাঁটুতে ব্যথা ..খুলনা থেকে ঢাকা। যাওয়ার সময় বাসে উঠতে পারতো না ঠিকমত ..মেজদাকে বলতো ...হাতটা একটু ধর বাবা ... আমার ছয় ফুট লম্বা মেজদা কোনো উত্তরের আগেই চট করে আম্মাকে কোলে করে বাসের একদম সিটে আর আমার স্কুল টিচার মা লজ্জায় আর ছেলের গর্বে লাল ...
ছোটো বেলায় নানু বাড়ি গেলে সবসময় আমাদের হাতে দিদু কিছু টাকা গুজে দিতো ...মেজদা একবার সেই টাকা দিয়ে আম্মার জন্য প্রেজেন্ট কিনতে যেয়ে বাজেট এ না পেরে একটা ব্লাউজ কিনে এনে হাজির! আমরা সবাই ওকে নিয়ে হেসে গড়াগড়ি। মার চোখে খুশির পানি।
কালকে সবাই মিলে ব্রেকফাস্ট করলাম বেডে। নাবহান স্পেশাল এগ টোস্ট করেছে। ব্রেড এর মাঝখানে গোল করে কেটে ডিম দিয়ে কিছু একটা নতুন বানানোর চেষ্টা। শায়ান প্যানকেকে নাটেলা দিয়ে স্মাইলি ফেস বানিয়েছে। এশান ওর বাবার সাথে বারবিকিউ.. চিকেন কাবাব ..উইংস ..সসেজ ...
দুপুরে সবাই মিলে পানির পাড়ে S ydney হারবার ব্রিজ এর নিচে সী ফুড রেস্টুরেন্ট। বিকালে ইশতিয়াকের ডর্মে যেয়ে ওকে বন্ধু সহ পিকআপ করে বাংলাদেশী রেস্টুরেন্ট এ কাচ্চি বিরিয়ানি। ভুনা খিচুড়ি, নেহারি, ভুড়ি, পরোটা, হালীম, বোরহানি, লাচ্ছি - শেষে আবার পানের মিষ্টি মশলা।
আমার টিন এজার ছেলে পকেট থেকে টাকা বের করলো! ওর টিউশনি করে আয় করা টাকা মাস এর পর মাস ধরে জমানো! ভাবি কোনো কি প্রয়োজন আছে এই "mother's day" র ??? আমাদের তো সারা বছরই মাদার্স ডে। এটা নাকি তাদের কালচার যাদের ছেলে মেয়েরা সারা বছর মার খোজ রাখে না শুধু একদিন লোক দেখানো সেলিব্রেসন করে! তাই কি ?? ......কি জানি ....
আমি খুব সাধারণ মা। আমার মায়ের মতোই। আমার কাছে ভালবাসার প্রয়োজন এর কোনো শেষ নেই। আরো যদি হয় সেটা বাচ্চা কাচ্চা গুলোর ভালবাসা। ভালবাসার প্রকাশের ধারা যেমন হোক, যখন হোক, প্রতিদিন হোক, প্রতি মুহূর্তের হোক। একদিন একটু অন্য ভাবে হোক, একটু উচ্ছল হোক, একটু অতিরিক্ত হোক, লাগামছাড়া হোক -
এই মুহূর্ত টাই তো সত্যি - কোথায় চলে যাব আমরা। শুধু এই একসাথে কাটানো সময় গুলো থাকবে। স্মৃতিতে - ভালবাসায় -
অতি সাধারণ আমি। সন্তানের কোনো ভালবাসার প্রকাশ ই আমার কাছে আধিক্য মনে হয় না। আমার ছোট্ট ছেলেটা যখন ছুটে এসে জড়িয় ধরে বলে - "মাম ...সারপ্রাইজ !!!! আই নো ইউ লাইক পিঙ্ক - আই মেড দিস অল বাই মাই সেলফ - জাস্ট ফর ইউ - বেস্ট মাম ইন দা হোল ওয়াইড ওয়ার্ল্ড !!!"
হাতের আঙ্গুলের ছাপ দেওয়া গোলাপি রঙের কার্ড। খুললেই ফোল্ড করা কাগজে লেখা - Love You This Much- ফোল্ড যতো খুলতে থাকবে ভালবাসা ততো বাড়তে থাকবে!
আরেকটা গোলাপি রঙ করা কাঠের চুড়ি - তাতে কাঁচা হাতে লাগানো প্লাস্টিক এর চুমকি। বাসায় আনতে আনতেই যার দুইটা খুলে গেছে - খুশিতে আনন্দে আমি চোখে দেখতে পারিনা - নিঃশ্বাস আটকে যায় - চোখে পানি নিয়েই আমি চুড়ি পরতে বসি এশান কে চুমু খাই - বলি, বাবারে এতো সুন্দর চুড়ি তো আমি কোনদিন ই পরিনি !! চোখে পানি নিয়েই আমি ভাবতে বসি, আম্মাকে কোনদিন বলা হোলো না - বলতো মা - তোমাকে কতো ভালবাসি ??
দুই হাত পিছনে নিয়ে সমস্ত পৃথিবীটাকে হাতের মুঠোয় ভরে - দেখো মা, দিস মাচ I love you this much !!! I love you upto the sky .......
Rabbir hum huma Kama ranbbai ani sagira
|