ময়মনসিংহ-বাসী’র বনভোজন

মমতা চৌধুরী:প্রবাসে জন্মভূমি থেকে আগত যে কেউ ই যেন বড় সজন। আর তারা যদি হন নিজের হোম টাউনের কাছাকাছি কেউ, তাহলে কোথায় যেন একটা একাত্মতা খুঁজে ফিরি আমরা সবাই। তাদের কথার ভাষায়, কণ্ঠস্বরে, উচ্চারণে কোথায় যেন বাজে “চিনি তারে চিনি” আমারই স্মৃতির ওপার থেকে ভেসে আসা যেন একটা মধুর ঝংকার। কোন এক নিমন্ত্রণের আসরে খুব ক্যাজুয়েলী ডা. লাভলী রহমান এবং আমি কথা বলছিলাম, সিডনীর চারিদিকে কত শত সমিতি, সংগঠন – প্রায়ই শুনি “চাঁটগাইয়া মেজবানের হাঁকডাক”, অথচ একসময়ের বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ (এমন কি ছোটবেলায় শুনেছি পৃথিবীর সর্ববৃহৎ!) জেলা থেকে আগত “ময়মনসিংঙ্গাদের” নিজস্ব কোন প্ল্যাটফর্ম নেই একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হয়ে নিজেদের ভাষায়, স্বরে নিজেদের কৃষ্টি কালচার নিয়ে আলোচনা করার, অন্যের মাঝে এই অঞ্চলের খাবার, গান, কাব্য সাহিত্যের কথা ছড়িয়ে দিতে, কিংবা নিছক আনন্দের মেতে উঠার! লাভলী রহমান এরপর থেকে অমিত উৎসাহ আর প্রাণোম্মদনা নিয়ে ময়মনসিংহ-বাসীদের একত্র করার প্রয়াসে নামলেন। ২০১৮র বছর শেষে উনার বাসায় অনুষ্ঠিত হলো “ময়মনসিংহ-বাসীদের” প্রথম আলোচনা অনুষ্ঠান। গঠিত হয় ময়মনসিংহ-বাসী সংগঠন এবং এর কার্যকারী কমিটি। পরিচালনা কমিটির সিদ্ধান্তে প্রথম মিলন মেলার সময় নির্ধারণ করা হলো ২৪শে মার্চ ২০১৯ ।
এর মাঝে পদ্মা যমুনায় অনেক স্রোত বয়ে গেল – ক্যাঙ্গারুর দেশে রৌদ্রের দাহে পুড়ে গেল কত বনাঞ্চল, আবার নূতন বছর আসলো সিডনী হারবারের আলোকমালায় সেজে হাজার আতশবাজির ঝলকানিতে। আর হাটি হাটি পা পা করে ডা. লাভলী, খসরু ভাই, ভাবী, রুমেল, নিম্মি, নোমান সাহেব সহ আরো অনেকের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় হেমন্তের প্রারম্ভে সিডনীর চিপিং নর্টনের ব্ল্যাক মাসকট পার্কে ময়মনসিংহ-বাসীর পিকনিক উদযাপিত হলো । আয়োজন আর মানুষের সমারোহ ছিল অপ্রত্যাশিত রকমের ভাল। আনন্দ মেলা শুরু হলো ময়মনসিংহের মুখরোচক পিঠা, সিঙ্গারা, ঝালমুড়ি আর চায়ের সহযোগে। এর পর ছিল খেলাধুলার আয়োজন। অদম্য উত্সাহে প্রতিযোগিতা চললো মজার মজার খেলার - কখনো নারী পুরুষের দলে বিভক্ত হয়ে, কখনো তরুণদের সাথে দড়ি টানাটানির শক্তি পরীক্ষায়, কখনো মিউজিক্যাল চেয়ার খেলার গানের তালে তালে নিজের আসন সংরক্ষণের প্রতিযোগিতায়। এর মাঝে আবার ক’জন গিটারের সহযোগে গান গেয়ে ভরে রাখছিল সুন্দর এক ভোরবেলা, কখনো ভাটিয়ালী, বাউলে, কখনো দেশাত্মবোধক, আধুনিক, কিংবা নজরুল রবির গানে গানে। দুপুরের মাঝে সরগরম হয়ে উঠলো এই সম্মিলন। মন প্রাণ ভরে উঠছিল, ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল আমায় নিজের দেশের মধুর ভাষার কথোপকথনের সম্মিলিত কণ্ঠস্বর। এর মাঝে সুস্বাদু লাঞ্চ সার্ভ করা হলো – ডা. লাভলী নিজ হাতে প্লেট তুলে দিয়ে সবাইকে আপ্যায়ন করলেন, মাঝে মাঝে অন্যান্য ভাই-ভাবী, ভাই-বোনেরাও একে অন্যকে আপ্যায়ন করলেন, এ যেন “আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে”। লাভলী ভাবীর কন্যা এশার একান্ত সহযোগিতা প্রতিটি কাজে অনেকের মত আমাকেও আগামী প্রজন্মের তাদের শেকড়ের প্রতি মমত্ববোধের জাগরুক হয়ে ধরা পড়ল। খাবারের পর চললো সকালের খেলাধুলা প্রতিযোগিতার পুরষ্কার বিতরণ – “বিজয়ী” আর “হারা” সবাই পেল পুরষ্কার – এমন কি উপস্থিত সবাই। বাচ্চারা পেল হাত ভর্তি চকলেট। এর মাঝে কবিতা, গানে, পুথি পড়ায় সবাইকে মুগ্ধ করে রাখলো ক’জনে – ডা. লাভলীর কবিতার সাথে বাদল ভাইয়ের বলিষ্ঠ কণ্ঠ “জাগো বাহে –” যেন প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল উত্তর বঙ্গের মাঠ ঘাট পেড়িয়ে এই প্রশান্ত-পাড়ের নগরীতে। সবশেষে ময়মনসিংহের মিষ্টি মানুষগুলো নানান মিষ্টি আর চায়ের আয়োজনে মিষ্টিমুখ করে মনে প্রাণে আরো মিষ্টি সজ্জন হয়ে আবারো দেখা হবে অচিরেই এই প্রতিশ্রুতিতে ডা. লাভলী রহমান পিকনিক এর সমাপ্তি টানলেন।
মহুয়া মলুয়ার দেশের মানুষ মোরা, নকশী কাঁথার মাঠ, সোজন বাদিয়ার ঘাট পাড়িয়ে
হেঁটেছি পৃথিবীর পথে পথে,
ঘর বেধেছি মোরা নীল সাগর ঘেরা এই লাল মাটির ধূসর শ্যামল দেশে এসো মোর ময়মনসিংহ-বাসী ভাই বোন
থাকি মোরা প্রাণে প্রাণে মিশে।


|