bangla-sydney.com News and views of Bangladeshi community in Australia
ড. সেলিমকে যেমন দেখেছি মুশতাক খান
ড. সেলিমের সাথে আমার প্রথম পরিচয় ২০১১ সালের শেষের দিকে রাজশাহী ইউনিভারসিটি এ্যালুমনাই এ্যাসোসিয়েশন অব অস্ট্রেলিয়ার কার্যকরী পরিষদের মিটিংয়ে। সেদিনের মিটিংয়ের প্রধান আলোচনার বিষয় ছিলো সিডনি অলিম্পিক স্টেডিয়ামে আয়োজিত বৈশাখী মেলাতে একটা স্টল দেয়া যায় কিনা। যদি কিছু ফান্ড সংগ্রহ করা যায় তাহলে সেটা বিভিন্ন সেবা মূলক কাজে ব্যাবহার করা যেতে পারে। কিসের স্টল দেয়া হবে সেটা নিয়ে অনেকে অনেক ধরনের মতামত দিচ্ছিল। সেলিম অনেকক্ষণ চুপচাপ থাকার পর বলে উঠলো, একটা চা'য়ের স্টল দিলে কেমন হয়। সকলেই এক বাক্যে রাজী হয়ে গেল - চল চায়ের স্টলই দেই। কথাটা বলা যত সহজ আসলে চায়ের স্টলে হাজারো মানুষের জন্য চা বানানো অত সহজ ব্যাপার নয়। সাধারণ চা'য়ের পাশাপাশি মশলা চা'য়েরও প্রস্তাব দিল একজন। তখন স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠলো চা বানানোর দায়িত্বটা কে নেবে। সকলেই মুখ চাওয়াচাওয়ি শুরু করলো; এমন সময় সেলিম বলে উঠলো আরে এটা কোন ব্যাপারই না, আমি বানাবো। যে কথা সেই কাজ - সেলিম পোপলুকে নিয়ে সব ধরনের আয়োজন করতে লেগে পড়লো। কি কি জিনিস কিনতে হবে, কতখানি কিনতে হবে, কে কি দায়িত্বে থাকবে সবকিছু সব ঠিকঠাক করে ফেললো সেলিম।
মেলার দিন সকালে সেলিম তার দল নিয়ে চলে এলো অলিম্পিক পার্কের স্টলে পুরো প্রস্তুতি নিয়ে। সেদিন বেশ গরম পড়েছিল। সেলিম ও পোপলু দু'জনে মিলে আদা ছিলে পেস্ট বানালো, বড় পাতিলে দুধ জ্বাল দেয়া শুরু করলো। আগুনের তাপে সেলিম ঘেমে একাকার কিন্তু সে হার মানার মানুষ নয়। হাসি মুখে রাত সাড়ে নয়টা পর্যন্ত একটানা চা বানায়ে গেল পোপলুকে সাথে নিয়ে। স্টল বন্ধ হবার পর জমলো আড্ডা। কি অপূর্ব ব্যক্তিত্ব। ২০১৫ সালে টেম্পিতে আয়োজিত বৈশাখী মেলাতেও সেলিম একই দায়িত্ব নিয়েছিল।
২০১২ সালে ঠিক হলো রাজশাহী ইউনিভারসিটি এ্যালুমনাই এ্যাসোসিয়েশন থেকে কিছু পাঠ্য-পুস্তক পাঠানো হবে রাজশাহী ইউনিভারসিটি লাইব্রেরির জন্য। সেলিম কয়েকদিনের মধ্যেই অনেক বই যোগাড় করে ফেলে। আমি সেই বইগুলো শিপমেন্টের ব্যবস্থা করলাম। সেলিম রাজশাহী ইউনিভারসিটি কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করে কিন্তু ওদিক থেকে তেমন সাড়া না পাওয়ার জন্যে সেলিমের এই উদ্যোগটি আর বাস্তবায়িত হলো না।
গত কয়েক মাস আগে আমি আমার এক বন্ধুর বিবাহ বার্ষিকী অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম রকডেলের হাট-বাজার ফাংশন সেন্টারে। খাওয়া-দাওয়ার পর শুরু হয় নাচ-গানের পর্ব। অনেক সুন্দর সুন্দর গান হচ্ছিল - হঠাৎকরে সেলিম রুমের মাঝখানের ফাকা যায়গায় এসে নাচ শুরু করলো। কি সেই নাচ! দর্শকেরা বাজনার তালে তালে হাততালি দিতে থাকে। সেলিম একটার পর একটা নাচ করে সবাইকে হতবাক করে দেয়। কি চমৎকার সেই পরিবেশনা। মনে থাকার মত। তার অফুরন্ত প্রাণ-শক্তি দেখে সত্যি আশ্চর্য হয়েছিলাম সেদিন।
কে জানতো সেটাই ছিল সেলিমের সাথে আমার শেষ দেখা। গত ২১শে আগস্ট সকালে খবর পেলাম সেলিমের ম্যাসিভ হার্ট এ্যাটাক হয়েছে, কোমাতে আছে, ক্যাম্বেলটাউন হাসপাতালে আছে। সেদিন সকালে সেলিম তার মেয়েকে ডেকে একটা গ্যাস্ট্রিক পেইন এর ট্যাবলেট চায়। ট্যাবলেট নিয়ে এসে সে দেখে তারা বাবা মাটিতে পড়ে আছে, চোখ দু'টি স্থির। সেলিমের স্ত্রী শপিংয়ে গিয়েছিলেন। মেয়ে তার মাকে খবর দেয়, এ্যাম্বুলেন্স ডাকা হয়। প্যারামেডিকরা তিরিশ মিনিট ধরে চেষ্টা করেও পালস আনতে বার্থ হয়। ক্যাম্বেলটাউন হাসপাতালে আনার ঘণ্টা খানেক পরে ডাক্তাররা তার পালস আনতে সক্ষম হন। পরে তাকে লিভারপুল হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে তাকে লাইফ-সাপোর্ট দিয়ে আই সি ইউতে রাখা হয়। ডাক্তাররা অনেক চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। প্রায় দেড় ঘণ্টার মত তার হৃৎপিণ্ড অচল থাকার কারনে তার ব্রেইন, কিডনি ও লিভার নষ্ট হয়ে যায়।
গত ২৭ শে অগাস্ট ২০১৬ তারিখ রাতে তার লাইফ-সাপোর্ট সিস্টেম খুলে দেয়া হয় ঘণ্টা চারেক পরে, রাত আড়াইটার দিকে এই সুন্দর মানুষটা চলে গেলেন দুনিয়া থেকে। রেখে গেলেন তার স্ত্রী ও এক মেয়েকে। ২৮ তারিখ, রবিবার দুপুর ১২টা ৩০ মিনিটে স্থানীয় লাকেম্বা মসজিদে তার জানাজা সম্পন্ন হয়। পরে তাকে ক্যাম্বেলটাউনের ন্যারালিন সিমেটেরি তে কবর দেয়া হয়।
ভাবতেই অবাক লাগছে যে মানুষটার কোনো রকম শারীরিক অসুস্থতা ছিলোনা। না ছিল হাই কোলেস্টেরল, না হাই ব্লাড-প্রেশার না অন্য কিছু। তিনি নিয়মিত হাঁটতেন, জিমে যেতেন। হাসিখুশি একটা মানুষ কিভাবে এক মূহুর্তের মধ্যেই দুনিয়া ছেড়ে চলে গেল। এখনো আমার চোখে ভাসছে সেলিমের সেই নাচ!
ড. সেলিমের জন্ম সিরাজগঞ্জে। পরবর্তীতে তিনি রাজশাহীতে বসবাস করেন। তার ছাত্র-জীবন কেটেছে সেখানেই। ১৯৯৪ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। ২০০৪ সালে অস্ট্রেলিয়াতে আসেন ও ২০০৮ সালে ইউ ডাব্লিউ এস থেকে পি এইচ ডি করেন এবং সেখানেই তিনি ফাইন্যান্স এবং ইকনোমিক্স ডিপার্টমেন্টে শিক্ষকতা শুরু করেন। তিনি অল্প কথা ও বেশী কাজ করার থিওরিতে বিশ্বাস করতেন। তিনি এটা শুধু বিশ্বাসই করতেন না বাস্তবে করেও দেখিয়েছেন। এত সন্দর একজন বন্ধুকে হারানোটা যে কত কষ্টের তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না। ড. সেলিম চিরদিন আমাদের হৃদয়ে অমর হয়ে থাকবেন।
মুশতাক খান, সিডনি
Share on Facebook               Home Page             Published on: 1-Sep-2016