অন্য-ভূমের সন্ধানে মোস্তফা আব্দুল্লাহ
১৯৭৭ সালটি ছিল আমার জীবনে বিশেষ ভাবে ঘটনা বহুল। প্রথমে চাকুরী চ্যুতি, তার পর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া এবং পরিশেষে অগত্যা অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমানো। সরকারী চাকুরী থেকে অব্যাহতি পাওয়ার পর অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে ভেবে আমার মাথার সাথে সাথে হাত পাও দিন দিন অবশ হয়ে যাচ্ছিল। অন্য কোন চাকুরীর কোন সম্ভাবনাই দেখছি না, আর এদিকে জুন মাসের শেষ সপ্তাহে বিবাহের আয়োজন পুরো দমে এগিয়ে চলেছে!
কারো সাথে বসে যে মনের দুঃখে দুদণ্ড কাঁদবো তারও যে যো নাই। বহু দিনের বন্ধু কবির এর অফিসে গেলাম মতিঝিলে, পূর্বাণী হোটেলের পাশের ভবনে। এখানে বলে নেই, কবিরের আরেক নাম বাবু, যিনি কিনা সর্বদাই বেশভূষায় কেতাদুরস্ত একজন খাটি “বাবু”। বাবুকে আমার চাকুরী চ্যুতির কথা খুলে বলে ওর খোজ খবরে কোন কাজকর্মের হদিস আছে কিনা জানতে চাইলে ও তো হেসেই খুন। সদ্য বিদেশ ফেরত ১ম শ্রেণীর সরকারী কর্মকর্তা কিনা ওর কাছে এসেছে একটা চাকরীর খোঁজে! বেশ কিছু কাঠখড় পুড়িয়ে ওকে বোঝাতে সমর্থ হলাম যে এটা আমার কোন রসিকতা নয় – জীবন মরণ সমস্যা। ও নিয়ে গেল আমাকে, পাশেই একটা রেস্তরায়, লাঞ্চ খাওয়াতে। ভাবটা এমন যে ওখানে বসে খেতে খেতে কোন একটা বুদ্ধি আসবেই। বুদ্ধি অবশ্য একটা আসলো – অস্ট্রেলিয়া চলে গেলে কেমন হয়? বাবু শুনেছে অস্ট্রেলিয়া নাকি বাংলাদেশ থেকে অ-নে-ক লোকজন নিচ্ছে।
লাঞ্চ শেষে গেলাম পূর্বাণী হোটেলের পাঁচ তালায় তদানীন্তন অস্ট্রেলিয়ান হাই কমিশন এর অফিসে। খোজ করেই দেখিনা, কি ধরনের লোক নিচ্ছে, গায়ে গতরে খেটে খাওয়ার লোকজন খুঁজলে তো আর আমার কোন চান্স নাই। তখনকার দিনে হাই কমিশনের রিসেপসনে গিয়ে কোন কিছু জানতে চাওয়া বা কারো সাথে দেখা করা নিয়ে তেমন কোন কড়াকড়ি ছিল না। অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার বিষয়ে জানতে এসেছি শুনে এক অল্প বয়স্ক মহিলা আমাকে ডেকে নিয়ে একটা মিটিং রুমে বসিয়ে আমার বিষয়ে দু একটা প্রশ্ন করার পর একটা ফরম আর গোটা দুয়েক চটি বই দিয়ে বলে দিল বইগুলি পড়ে দেখতে। বই গুলিতে অস্ট্রেলিয়া ও সেখানকার জীবন যাত্রার ওপর আলোকপাত করা আছে। বইগুলি দেখে যদি মনে হয় যে আমি সেখানে গিয়ে বসবাস করতে ইচ্ছুক, তাহলে ফরমটা পূরণ করে দিয়ে যেতে পারি। দেশে কোন একটা কাজের কোনরকম আশা ভরসা না পেয়ে সপ্তাহ খানেক পরে দরখাস্তটা পূরণ করে জমা দিয়ে এলাম। কোন ধরনের ফি এর বালাই ছিল না – হলে ভালো, না হলে আর আমার করারই বা কি আছে। গাঁটের পয়সা তো আর যাচ্ছে না? পরের কয়েক সপ্তাহ বিয়ে শাদী নিয়ে এমন মসগুল ছিলাম যে এদিকটার কথা বেমালুম ভুলতে চলেছিলাম – হাজার হোক নিজের বিয়ে বলে কথা। জীবনের অন্য অন্য ক্ষেত্রের ন্যায় এবারেও আমার সামনের বন্ধ দরজাটা খুলে গেল অচিরেই। দরখাস্ত জমা দেয়ার পাঁচ ছয় সপ্তাহ পর ডাক পড়ল হাই কমিশন থেকে দেখা করার জন্য। পূর্বোক্ত মহিলাই আমার সাক্ষাৎকার নিলেন – খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করলেন আমার দরখাস্ত মঞ্জুর হলে আমি যাব কিনা। কালক্ষেপণ না করে বলে দিলাম, নিশ্চয়ই। যদিও তখনো মনের মধ্যে ঘুরছিল যে এর মাঝে যদি ভাল কিছুর একটা বন্দবস্ত হয়, তখন ভেবে দেখা যাবে। মাস দুয়েক পর আমার দরখাস্ত মঞ্জুরের চিঠি এল। সদ্য বিবাহিত অশ্রুসিক্ত নব বধূর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ১৯৭৭ এর সেপ্টেম্বর মাসে সিডনী চলে এলাম। তিনিও বিরহ বেদনায় কাতর হয়ে ছয় মাসের মাথায়ই আমার সঙ্গ নিলেন। সিডনী এয়ারপোর্টে নেমে ম্যাসকট দিয়ে ঢোকার সময় রাস্তার দুপাশের বিলেতি কায়দার পুরনো নিষ্প্রভ বৈচিত্র্যহীন বাড়িঘরগুলো দেখে নূতন দেশে আসার উৎসাহটা প্রথমে কিছুটা ধাক্কা খেয়েছিল। সে ভুল অবশ্যই অল্প সময়ের মাঝেই ভেঙে যায় – এই শহরের সৌন্দর্য, মনভোলানো বনরাজীর ভিতর দিয়ে আঁকানো বাঁকানো উঁচু নিচু পথ ঘাট, সবুজের ফাকে ফাকে বাড়ি ঘড়, সীমাহীন সমুদ্র সৈকত ও অপূর্ব নৈসর্গিক শোভা দেখে। বার বার “অদৃষ্টের হস্তক্ষেপ” এর কাছে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেছি এই “অন্য-ভূমে” আসার সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য। এই “অন্য-ভূম” যে কখন মনের অজান্তেই “নিজভূম” হয়ে উঠল, তা বুঝেও উঠতে পারলাম না! সুসময় সত্যিকার অর্থেই খুব তাড়াতাড়ি পাড় হয়ে যায়।
সোমবার সকালে এসে পৌঁছালে, প্রয়াত ডঃ মোকলেসুর রহমান ও আলম ভাই আমাকে ও আরেক সহযাত্রী প্রয়াত শাহাদাৎ আলিকে সপরিবারে এয়ারপোর্ট থেকে উঠিয়ে, আমাকে রেন্ডউইকে আলম ভাইয়ের বাসায় আর শাহাদাতকে রহমান ভাই নিজের বাসায় থাকার বন্দোবস্ত করেন। রহমান ভাইয়ের মনটা ছিল আকাশের মত উদার। কারো কোন সাহায্য বা প্রয়োজনে তিনি ছিলেন সদা প্রস্তুত। নিজের সময় ও অর্থ ব্যয় করে কতজনকেই না কত ভাবে সাহায্য সহযোগিতা করেছেন, বিশেষ করে যারা সবে মাত্র এ দেশে এসেছে। আরও অনেকেই যেমন আলমগির ভাই, সালাউদ্দিন ভাই, মোমেন ভুঁইয়া ভাই, প্রয়াত শহিদুর রহমান ভাই, প্রয়াত খান ভাই, ঝুনু ভাই আরও অনেকেই যাদের সবার নাম এখানে উল্লেখ করা গেল না – সব সময়ই হাসি মুখে এগিয়ে এসেছেন একে অন্যের প্রয়োজনে।
পর দিন সকালে আলম ভাই অফিসে যাওয়ার পথে আমাকে সিডনির সেন্টার-পয়েন্ট এর সামনে পৌঁছে দিলেন চাকুরী খোজার এক রিক্রুটমেন্ট এজেন্সির সাথে কথা বলার জন্য। সেখানকার এক মহিলা নিজের আরেক নাম “স্টোরি রাইটার” বা গল্প-লেখিকা বলে পরিচয় দিয়ে, আমার বায়ো-ডাটা নূতন করে ঘষে মেজে তৈয়ার করে, জানলার ধারে দাড়িয়ে অদূরেই কেন্ট স্ট্রীটে একটা বিল্ডিং দেখিয়ে বলল যে ওইখানে “আর্নট বিস্কিট” এর হেড অফিসে চলে যাও। ইন্টার্ভিউর জন্য বেরোতে যাচ্ছি, সে সাথে একজনকে দিয়ে পাঠাল, আমি যদি ঠিক ঠাক মত পথ চিনে যেতে না পারি। আমার কিন্তু সেটা বিশ্বাস হয় নাই। আমার ধারনা, ওই বিল্ডিঙেই আরও অনেকগুলি রিক্রুটিং এজেন্সির অফিস, পাছে না আমি বেরিয়ে গিয়ে অন্য আর একটা অফিসে খোজ খবর শুরু করি, সেটাই সম্ভবতঃ কারণ!
ইন্টার্ভিউতে রফা হোল যে আগামী সোমবার থেকে কাজ শুরু করব। বেতন বাৎসরিক দশ হাজার ডলার। এখনকার ছেলে ছোকরারা বেতনের অঙ্ক শুনে হেসো না – তখনকার দিনে রেন্ডউইকের মত জায়গায় এক বেড রুমের একটা ফ্ল্যাট, যেটার বসার ঘড়ের জানালা দিয়ে অদূরেই কুজি বিচের সমুদ্রের ঢেউ দেখা যেত, তার সাপ্তাহিক ভাড়া ছিল মাত্র চল্লিশ ডলার! কপালের নাম গোপাল বলে কাজে লেগে গেলাম।
তখনকার দিনে বাংলাদেশী অভিবাসীরা বেশির ভাগই রেন্ডউইকেই থাকতো। প্রথমে এটা শুরু হয়েছিল ইউনিভার্সিটি অব নিউ সাউথ ওয়েলস এ পড়তে আসা বাংলাদেশী ছাত্রদের ঘিরে। তাদেরি পরিচয় সূত্র ধরে আসতে থাকা বাংলাদেশী অভিবাসীরা প্রথমে সেখানেই আস্থান গাড়তে থাকে। আশি সনের মাঝ থেকে আস্তে আস্তে বাংলাদেশীরা সরতে থাকে ইষ্ট-লেকস, হিলস-ডেল ও আরও দুরে পশ্চিমের সাবার্বগুলির দিকে। আমাদের দেশীয় তৈজসপত্র কোথায় পাওয়া যেতে পারে তার খোজ পেতে অনেক দিন সময় লেগেছে। ক্লিভল্যান্ড রোডে এক মাত্র হালাল মাংসের দোকান খুঁজে পেলাম দুই বৎসর পর যখন আমার মা এসেছিলেন আমাদের কাছে বেড়াতে। এই দেশে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে যদি অভিবাসীরা না আসতো তাহলে হয়ত এরা কোন দিনই জানতো না যে পোড়া মাংস আর সেদ্ধ আলু ছাড়া আরও বহু ধরেনেরই খাবার আছে!
হিজাব তো দুরের কথা, শাড়ী কামিজ পরা কাওকে চোখে পড়া দুষ্কর ছিল। দেশি বর্ণের কাওকে দেখলে একজন আর একজনের দিকে এগিয়ে যেত কুশলাদি জিজ্ঞেস করতে। এমন পরিবেশে হঠাৎ করেই আমাদের বর্ণ ও চেহারার একদল ১৬/১৭ বৎসর বয়সের যুবকদের দেখা গেল সিডনীর পূর্বাঞ্চলের পথে ঘাটে। নিশ্চিত ভাবে তা ছিল আমাদের জন্য খুবই একটা আনন্দদায়ক অনুভূতি। ৬০ জন করে পর পর দুই বৎসর প্রায় ১২০ জন বাঙ্গালী যুবক আসলো কোয়ান্টাসে বিমান রক্ষণাবেক্ষণের প্রশিক্ষণের জন্য। তাদের নিয়ে ছুটির দিনে বণ্ডাই ওভালে আলমগীর ভাইয়ের তত্ত্বাবধানে শুরু হয় নিয়মিত ক্রিকেট খেলা। মাঠের পাশ জুড়ে চলে দিন ভর পারিবারিক পিকনিক। সময় সময় সপরিবারে উপস্থিত হতেন ক্যানবেরা থেকে আগত তদানিন্তন হাইকমিশনার এয়ার ভাইস মার্শাল (অবঃ) এ কে খন্দকার, সিডনিস্থ ট্রেড কমিশনার প্রয়াত মেজর জেনারেল (অবঃ) এ এন এম নুরুজ্জামান ও ডেপুটি ট্রেড কমিশনার জনাব মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর।
তখনকার সময় এখনকার মত এতগুলি এসোসিয়েশন বা পরিষদ ছিল না। একটি মাত্র বাংলাদেশ এসোসিয়েশনকে ঘিরেই চলতো আমাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড। সংখ্যা স্বল্পতার কারণে নাটকে বা নাচের পার্টে পুরুষদেরকেই মাঝে মধ্যে শাড়ি জরিয়ে নারীর ভূমিকায় অভিনয় করতে হয়েছে। সময়ের সাথে সাথে বেড়েছে আমাদের জনসংখ্যা, সাথে সাথে বেড়েছে এসোসিয়েশন/পরিষদ এর সংখ্যা ও ধরন। আমরা খুবই “এসোসিয়েশন” প্রিয় জাতি, তা আমাদের সংখ্যা যতই হোক না কেন। অন্য কোন দেশের অভিবাসীদের বিদেশে এত বিভক্তি বা এসোসিয়েশন/পরিষদ আছে বলে আমার জানা নাই।
আমার ধারণা যে এটা সম্ভবত আমাদের ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগত পরিচয়-সঙ্কট এর বহিঃপ্রকাশ। শুরুতে যখন আমরা মাত্র গোটা কয়েক বাংলাদেশী এখানে এসেছিলাম, তখনকার নৈকট্যের সূত্রে একে অন্যের বর্তমান ও পূর্ব পরিচিতি ওয়াকিবহাল হওয়া খুবই সহজ ও সম্ভব ছিল। আমাদের জনসংখ্যা বাড়ার সাথে আমরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাস শুরু করি আর সাথে সাথে কাছ থেকে পরিচিত হওয়ার সুযোগ কমে আসে। এতে সম্ভবত কেও কেও নিজেকে শুধু মাত্র বাংলাদেশী হিসাবে পরিচয় দেয়ার পরিবর্তে অমুক লিগ, দল, পার্টি বা অন্য কিছুর সমর্থক/কর্মী পরিচিতির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার প্রয়াস পায়।
মোস্তফা আব্দুল্লাহ, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া
|