অদৃষ্টের হস্তক্ষেপ মোস্তফা আব্দুল্লাহ
আমাদের বিয়ের মাস তিনেক আগে, আমার তখনকার কর্মস্থল ব্যুরো অব স্ট্যাটিসটিকস এর চাকুরী থেকে ইস্তফা দেই। স্বভাবতই এটা আমার হবু শশুর বাড়ীর লোকজন এর জন্য “জামাই কি করে?”, এর উত্তর দেয়াটা একটা অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। শুনেছি আমার হবু স্ত্রীরও বন্ধু বান্ধবরাও নাকি এই বলে মশকরা করে যে; বিয়ে করার জন্য এতই খেপেছিস যে শেষ পর্যন্ত একটা বেকার ছেলের সাথে ঝুলে পড়েছিস। পরে শুনেছি সে নাকি “কবুল” বলতে অনেকক্ষণ কাল-ক্ষেপণ করেছিল – জানিনা, দ্বিতীয় বার ভেবে দেখছিল কিনা! যদিও তখনকার ওই বেকারত্বটা আমার নিজের ইচ্ছাতেই, তবে ওই চাকরীটাতে ঝুলে থাকলে, নূতন জামাই হিসাবে শশুর বাড়ীতে না গিয়ে অদূর ভবিষ্যতে আমাকে সরকার বাহাদুরের মেহমান হয়ে জেল-খানায় যে যেতে হতো, তা প্রায় নিশ্চিত।
আমেরিকা থেকে ফিরে এসে বাংলাদেশ সেক্রেটারিয়েট প্রাঙ্গণে ব্যুরো অব স্ট্যাটিসটিকস এর কম্পিউটার সেন্টারে কাজ শুরু করি বাংলাদেশ আদমশুমারির ডাটা এন্ট্রি সেন্টারের তত্ত্বাবধায়ক হিসাবে। ৩০টি ডাটা এন্ট্রি মেশিনে ৬০ জন অপারেটরের সকাল বিকাল কাজের তত্ত্বাবধান। অপারেটর রা সবাই স্বল্পমেয়াদী চুক্তি ভিত্তিক কর্মচারী। একটি আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থার অনুদানের টাকায় তারা সপ্তাহ-অন্তে হাতে নগদ বেতন পান। আমারই অধীনস্থ একজন ঊর্ধ্বতন প্রশাসনিক সহকারী, সাপ্তাহিক বেতন দেওয়া থেকে অন্য অন্য সব প্রশাসনিক কাজ কর্ম দেখা শোনা করতেন।
ডাটা এন্ট্রি অপারেটর দের মধ্যে একজন ছিল আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী। স্বভাবতই, সে আমার সামনে কিছুটা সংকোচ বোধ করত। একদিন অফিস শেষে তাকে ডেকে আমার সম্মুখে কোন কারণেই সংকোচ বোধ না করার অনুরোধ জানাই এবং বলি যে তার জন্য আমার দরজা সবসময়ই খোলা। তারপরও সে যথাযথ দূরত্ব বজায় রেখেই চলে। একদিন অফিস শেষে সেই আমাকে জানায় যে তাদেরকে যে সাপ্তাহিক বেতন দেয়া হয় তা দাতা সংস্থার অনুমোদিত অঙ্কের থেকে কম। রেজিস্টারে টাকার অঙ্কটা পেনসিলে লিখে তাদের সই নেয়া হয়। এ ব্যাপারে একজন প্রতিবাদ করলে তাকে চাকরি থেকে বহিষ্কার করে দেয়া হয়েছে।
ব্যাপারটা কোন ভাবেই মেনে নিতে পারছিলাম না – নিশ্চয়ই এর মাঝে দুরভিসন্ধি মূলক কিছু রয়েছে। দুই একজন নিকট সহকর্মীর সাথে কথা বলে তেমন কোন সাড়া পেলাম না। একজন শুভানুধ্যায়ী সাবধান করে দিলেন যাতে এ নিয়ে আমি আর নাড়াচাড়া না করি। কিন্তু তখন তো সেটা আমার মান সম্মানের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে – বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সহপাঠী, আমারই অধস্তন এক কর্মচারীর অনৈতিক কাজের কথা জানিয়ে গেল, আর আমি কিনা হাত গুটিয়ে বসে থাকবো?
সেই প্রশাসনিক সহকারীকে ডেকে আমার রুমে বেতন দেয়ার রেজিস্টারটি দিয়ে যেতে বলাতে সে প্রথমে কিছুটা বিব্রত হোলেও সামলে নিয়ে বেশ রুঢ় কন্ঠেই আমাকে জবাব দিল যে সেটা নিয়ে আমার মাথা ঘামানোর কোন দরকার নাই, এ ব্যাপারটা সে নিজেই দেখছে। তারপরও বেশ দৃঢ়তার সাথেই রেজিস্টারটি পাঠিয়ে দিতে বলাতে আমাকে কিছু না বলেই সে হন হন করে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। বোঝা গেল সে আমার কথা মানবে না – তাই বেতন দেয়ার পরবর্তী নির্দিষ্ট দিনে আমি সশরীরে সেখানে উপস্থিত হই। আমাকে দেখা মাত্র রেজিস্টার বইটি গুটিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় সে জানিয়ে গেল যে বিশেষ কারণে সেদিন আর বেতন দেওয়া হবে না!
রাগে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে আমি উপরস্থ কর্মকর্তার কাছে একটা কড়া চিঠি লিখি এবং উক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার জন্য জোরালো সুপারিশ করি। মাঝে দুই দিন পার হয়ে গেল – অফিসে কেমন জানি একটা থমথমে ভাব! অনেকের মধ্যেই যেন আমাকে এড়িয়ে চলার একটা প্রবণতা। তৃতীয় দিন সকালে অফিসে পৌঁছেই আমার রুমের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা পিয়নের কাছ থেকে সই করে চিঠি নিয়ে খুলে পড়ে দেখি যে আমাকে তাৎক্ষনিক ভাবে তেজগাঁয়ের এক পুরনো কাগজ ও মালপত্র রাখার গুদামে বদলী করা হয়েছে। বুঝতে বাকি রইল না যে আমার অধীনস্থ ঊর্ধ্বতন প্রশাসনিক সহকারীর হাত অনেক উঁচু পর্যন্ত প্রসারিত।
কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে আমার এক শুভানুধ্যায়ী ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে ধর্না দিলাম উপদেশের আশায়। তেমন আশাব্যঞ্জক কিছু না শুনতে পেলেও তার কাছ থেকেই জানতে পারি যে তেজগাঁয়ের গুদাম থেকে হার হামেশাই চুরি চামারি হয় এবং সেখানে কর্মরত যে কাওকেই সরকারী মালামাল চুরির দায়ে ফাঁসানো কোন বিষয়ই নয়। বুঝতে পারলাম আমি কাদের সাথে পাঞ্জা লড়তে গেছি। যেমন করেই হোক আমাকে সরকারী চাকুরী থেকে ইস্তফা দিতেই হবে। কিন্তু কেমন করে? যার কাছেই উপদেশ/সাহায্যের আশায় হাত বাড়াই, সেখান থেকেই ব্যর্থমনোরথ হয়ে ফিরে আসি – সরকারী চাকুরীতে নাকি ঢোকা যত না কঠিন, বেরোনো তার চেয়ে আরও শতগুণে বেশি কঠিন! “প্রতিটি অমঙ্গলের পেছনেই কিছু না কিছু মঙ্গল নিহিত থাকে” কথাটির ওপর আস্থা রেখে আশায় বুক বেধে উপায় খুঁজতে থাকি।
তখনকার প্রখ্যাত কন্সালটিং ফার্ম “সার্ম এসসিয়েটেস” এর কর্ণধার প্রয়াত জনাব সানাউল্লাহ শেখ এর সাথে আমার পরিচয় তার অফিসে স্বল্পকালীন চাকুরী ও তার সন্তানদের কিছু দিনের জন্য গৃহশিক্ষক হিসাবে। সেই সুবাদে তার সাথে দেখা করে আমার বিপন্ন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তার সাহায্য ভিক্ষা করি। তিনি কিছুক্ষণ ভেবে স্ট্যাটিসটিকস ডিভিশন এর সচিব মহোদয়কে টেলিফোন করে সৌজন্যমূলক আলাপরিচিতা শেষে আমার কথাটা পাড়েন। তিনি জানালেন যে তার নিজের একটা বিশেষ কাজের জন্য আমাকে তার বিশেষ প্রয়োজন, আর তাই সচিব মহোদয় যদি আমাকে ছেড়ে দিতে পারেন তবে তিনি বিশেষ ভাবে উপকৃত হবেন। টেলিফোনের ওপাশে কি কথা হোল আমার জানা নাই তবে টেলিফোন রেখে শেখ সাহেব আমাকে পরের দিন অফিসের শুরুতেই একটা পদত্যাগ পত্র নিয়ে সচিব মহোদয় এর সাথে দেখা করতে বললেন। তার কথা মত পরের দিন সচিব মহোদয় এর সাথে দেখা করার কদিন পরই আমার পদত্যাগ পত্রটি অনুমোদিত হয় আর আমিও রেহাই পেয়ে যাই।
জীবনে যখনি কোন কঠিন বাঁধার সম্মুখীন হয়েছি, জানিনা অদৃষ্টের হস্তক্ষেপের কিনা, সেখান থেকে যেভাবেই হোক উৎরে যেতে সমর্থ হয়েছি। এই অদৃষ্টের হস্তক্ষেপকে সঠিক ভাবে চিনতে পারা নিয়ে একজন জ্ঞানী জনের কাছ থেকে শোনা ছোট একটা গল্প দিয়ে আপাতত এ লেখটার ইতি টানছি -
চারদিক থেকে বন্যার পানি ধেয়ে আসতে দেখে সবাই যে যার মত বাড়ি ঘড় ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের আশায় ছুটে চলেছে। কেবল একজনই মাত্র ব্যতিক্রম – বিধাতার ওপর তার পূর্ণ বিশ্বাস আছে বলে সে নিশ্চিত যে, বিপদ আসলে বিধাতা তাকে রক্ষা করবেনই। বন্যার পানি আরও বেড়ে গেলেও পাড়া পড়শিদের সাহায্যের আহ্বানেরও সাড়া দিতে অস্বীকৃতি জানান তিনি - তার ইস্পাত কঠিন ঈমানের জোরে। পানি আরও বাড়তে বাড়তে বাড়ি ঘড় অর্ধেক ডুবে গেলে একটি বাঁশের মাচান বানিয়ে জিনিষ পত্র নিয়ে তার ওপর ওঠে বসেন। বাড়ির পাশ দিয়ে চলে যাওয়া একটি নৌকার মাঝি তাকে তাদের সাথে নৌকায় উঠে নিরাপদ স্থানে যাওয়ার পরামর্শ দিলে তা তিনি প্রত্যাখ্যান করে বলেন, অন্যদের মত তার বিশ্বাস অতটা ঠুনকো নয়। আরো পানি বাড়তে থাকলে একসময় অন্য সব মালামাল বিসর্জন দিয়ে একমাত্র সম্বল ছাগলটিকে নিয়ে ঘড়ের টিনের ছাদের ওপর উঠে যান। ওপর দিয়ে উরে যাওয়া একটি হেলিকপ্টার তাকে উদ্ধার করার জন্য একটা রশি ছুড়ে দিলে ছাগলটি লাফ দিয়ে রশিটি ধরে উড়ে যাওয়া হেলিকপ্টারে উঠে রক্ষা পায়!
পানি বাড়তে বাড়তে অন্য সব কিছুর সাথে বন্যার পানিতে ভেসে যাওয়ার সময় তিনি চিৎকার করে বিধাতাকে প্রশ্ন করেন, তোমার প্রতি আমার এমন অগাধ বিশ্বাস থাকার পরও তুমি আমাকে রক্ষা করলে না কেন? বিধাতা মুচকি হেসে বলেন, আমি তো তোমাকে সাহায্যের জন্য বার বার হাত বাড়িয়েছিলাম; প্রথমবার তোমার প্রতিবেশী হয়ে, এরপর নৌকা বেয়ে এসে, সব শেষে হেলিকপ্টার থেকে। তোমার ছাগলটা সেটা দেখতে পেল - কিন্তু তুমি তা বুঝতে পারলে না!
মোস্তফা আব্দুল্লাহ, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া
|