নাড়ির টান মোস্তফা আব্দুল্লাহ
মাকে মনে পড়ে আমার, মাকে মনে পড়ে
আমার মায়ের সব থেকে ছোট বোন – নাম ছিল “বেলা”, আমারা সবাই তাকে বেলা খালা বলে ডাকতাম। এই বেলা খালাকে জন্মের পর পরই আমার মার এক নিঃসন্তান মামা দত্তক নিয়েছিলেন। সেই সুবাদে ওই নানা-নানীর সাথে আমার মা ও তার অন্য অন্য ভাই বোনদের সম্পর্কটা ছিল খুবই নিবিড়। মামা বাড়ীর সবারই ওই বাড়ীতে যাওয়া আসা ছিল অহরহ। ওই নানাটি যে আমাদের নানীর আপন ভাই ছিল সেটা নিয়ে কোন দিন আমার মনে কোন প্রশ্নের উদ্রেক হয় নাই বা এ নিয়ে ভাববার কোন কারণও ছিল না। কদিন আগে এক অলস বিকালে ফেলে আসা দিনগুলি নিয়ে কথা বলতে বলতে এক সময় বেলা খালার প্রসঙ্গ উঠে এলো। বেলা খালা বিয়ের কয়েক বৎসরের মধ্যেই প্রথম সন্তান প্রসব কালে মারা যান। কথা প্রসঙ্গে মনে হোল – বেলা খালাকে দত্তক নেয়া নানাটি তো আমাদের নানীর আপন ভাই’ই ছিল – তাই নয় কি? এর সঠিক উত্তর আমার গিন্নীরও জানা নাই – আমারা কেওই কোনদিন জানার প্রয়োজনও বোধ করি নাই! মনে হোল এর সঠিক উত্তর আমার মার কাছেই জানা যাবে – তাই মনস্থির করলাম, আম্মাকেই জিজ্ঞেস করি না কেন! পরক্ষণেই একটা ধাক্কা খেলাম – আম্মাকে এখন কোথায় পাব? তিনি তো সেই কবে বছর পনেরো আগেই ২১শে রমজানের এক সন্ধ্যায় আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন।
সত্যিই কি তিনি আমাকে ছেড়ে চলে গেছেন? মা’রা কি কখনো সন্তানদেরকে ফেলে রেখে যায়, না যেতে পারে? বিগত পনেরো বছরের কোন একটা দিনও কি মনে হয়েছে তিনি কাছেই নাই – ডাক দিলেই কি সাথে সাথে জবাব দেবেন না? তার সারাটা জীবনই তো আমাদের ডাকের সারা দিতে দিতে আর আমাদের পথ চেয়ে বসে থাকতে থাকতেই কেটে গেছে। আমাদের বাড়ীর গাড়ি ঢোকার গেটের মুখো মুখী নিচ তালাতেই ছিল আম্মার শোবার ঘড়ের জানালা। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আমরা যতক্ষণ না বাইরে থেকে বাড়ি ফিরেছি ততক্ষণ পর্যন্ত সেখানে বসেই তিনি সর্বক্ষণ অপেক্ষা করেছেন আমাদের জন্য। সবার প্রতি কড়া হুকুম ছিল – যার যেখানে যাবার কথা, সে যেন সেখানে পৌঁছেই তাকে তা জানিয়ে দেই। এ নিয়ে আমার মেয়েরা তাদের দাদীর সাথে কম দুষ্টুমি করতো না। বাইরে থেকে ফিরে আম্মার সাথে দেখা করে ওপরে উঠে নিজেদের ঘড়ে গিয়ে চিৎকার করে বলতো “দাদা আমরা পৌঁছে গেছি”। ওরা ওদের দাদিকে দাদা বলেই ডাকতো। দাদাকে দেখার সৌভাগ্য ওদের হয় নাই।
আম্মার এই ধরনের বাড়া বাড়ি নিয়ে আমাদের মুখে কখনো বিরক্তি লক্ষ্য করলে, উনি বলতেন এখন বুঝবেনা কেন আমি এমন করি – তবে একদিন ঠিকই বুঝতে পারবে। বুঝতে ঠিকই পেরেছিলাম পরে যখন মেয়ে দুটোকে হাই স্কুল শেষ করার পর এক এক করে ইউনিভার্সিটিতে পড়ার জন্য বিদেশে পাঠিয়ে দিলাম। দিন শেষে ওদের টেলিফোন পেতে দেরি হলে আমাদের কপালে চিন্তার বলি রেখা দেখে আম্মা মুচকি হেসে বলতেনঃ এখন কেমন লাগছে? তার পর বলতেন, চিন্তা করোনা ইনশাআল্লাহ ভালো আছেন, এখনি খবর পাবে। ওটা যেন মন্ত্রের মত কাজ করত – কিছুক্ষণের মাঝেই ফোনটা বেজে উঠত!
আব্বার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ এর মুহূর্তে অন্য অন্য আরও একান্ত ঘনিষ্ঠজন পরিবৃত হয়ে আম্মাকে ধরে আমি দাঁড়িয়েছিলাম। আব্বার মোনাজাত রত জোরা হাত দুটি যখন আস্তে আস্তে নিজের মুখের ওপর পড়ে গিয়ে উনি চলে গেলেন, মার দিকে চেয়ে দেখি তিনি দাতে দাতে ঠোট কামড়ে কান্না ঠেকিয়ে রাখছেন আর চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি ঝরছে। আমাকে এমন ভাবে জরিয়ে ধরলেন যেন আমি একটা ছোট শিশু, হাত থেকে ফসকে গিয়ে না জানি পড়ে গিয়ে ব্যথা পাই। আস্তে আস্তে তার হাতের মুঠিটা আলগা হতে থাকলে আমার মনে হোল যে তিনি যে কোন মুহূর্তে মূর্ছা যেতে পারেন – মুখের কাছে কান নিয়ে শুনতে পেলাম বির বির করে বলছেন “আল্লাহ্, আমার ছেলেটার এখন কি হবে”। আমি এখনো ভেবে পাই না, যিনি কিনা এই মাত্র তার জীবন সঙ্গীকে হারিয়ে সদ্য মাত্র বিধবা হয়ে গেলেন – তিনি তার প্রাপ্ত বয়স্ক ২৩ বৎসর বয়সের পুত্রের কি হবে সেটা ভেবেই ব্যকুল! এটা একমাত্র “মা”য়ের পক্ষেই সম্ভব।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকানোর শেষ দিকে আমি একটা আন্তর্জাতিক সংস্থার হয়ে কিছুদিন কাজ করেছিলাম। সেই সুবাদে আমাকে প্রায় প্রতি দিনই বরিশাল শহর থকে স্পীড বোটে করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেতে হত। এক বিকেলে ফিরার পথে অন্য একটি দেশি নৌকার সাথে স্পীড বোটটা প্রচণ্ড গতিতে ধাক্কা খেলে আমি ছিটকে গিয়ে মাঝ নদীতে পড়ে যাই। প্যান্ট শার্ট জুতা মোজার ভারে আমি কেবল নদীর গভীরের দিকেই তলিয়ে যাচ্ছিলাম, কোন ভাবেই হাত পা ছুড়ে নিজেকে ওপরের দিকে টেনে ওঠাতে পারছিলাম না। এক সময় মনে হোল আমি আর কোন ভাবেই জীবিত অবস্থায় এখান থেকে ওপরে উঠতে পারব না। সেই মুহূর্তে মার মুখটা চোখের পর্দায় ভেসে আসলো আর তৎক্ষণাৎ আমার মনে হোল আমি যদি আর ফিরে যেতে না পারি তবে আমার মার কি হবে – আমার মা’টা যে কানতে কানতে অন্ধ হয়ে মরেই যাবে। দম ফুরিয়ে যাচ্ছে, সর্ব শক্তি দিয়ে আপ্রাণ চেষ্টা করছি হাত পা ছুড়ে ওপরের দিকে ওঠার জন্য, আর তখনি মনে হোল কে জানি শক্ত হাতে আমাকে টেনে পানির ওপর উঠিয়ে আনল। আমার আজ অব্দি নিশ্চিত বিশ্বাস যে সেটা ছিল ‘নাড়ির টান’, যে নাড়ি একদিন বিচ্ছিন্ন করে মা আমকে পৃথিবীতে ছেড়ে দিয়েছিল পথ চলতে শিখতে, সেই নাড়ি ধরে টান দিয়েই তিনি আমাকে আবার তার কাছে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিলেন সেদিন! মার জীবনটা শুধু মাত্র তার ছেলে বৌ নাতি-নাতনীদের নিয়েই সীমাবদ্ধ ছিল না। তার মনটা ছিল আকাশের মত উদার। তিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তার নিজের ও শ্বশুর বাড়ীর আর্থিক ভাবে অসচ্ছল নিকট ও দুর আত্মীয়দের নিয়মিত সাহায্য করে গেছেন। তিনি আমার বাবার ঢাকা শহরে রেখে যাওয়া এক খণ্ড জমি আমার এক অসচ্ছল চাচাকে দিয়ে দিয়েছিলেন তাদের বাসস্থানের জন্য। বাড়ীতে আসা নিয়মিত ফেরিওয়ালারা পর্যন্ত খুব কম দিনই একটা কিছু মুখে না দিয়ে ফিরে যেতে পেরেছে। বাড়ীর কাজের লোকজনের যাতে যত্ন আত্তির ব্যাঘাত না হয় তা তিনি নিজে বসে তদারক করতেন। এমন কি জীবনের শেষ সন্ধ্যায়ও বিছানায় শায়িত অবস্থায় খোজ খবর করেছেন ড্রাইভার, মালী ও অন্যদের ঠিক মত ইফতারি দেয়া হয়েছে কিনা ও সেহেরীর খাবার ঠিক মত গোছানো হয়েছে কিনা। তিনি সবসময়ই নিকট ও দূর আত্মীয় পরিবেষ্টিত থাকতেন – আর আমাদের শেখাতেন যে অতিথি গৃহস্থের জন্য কল্যাণ ও আশীর্বাদ বয়ে আনে।
আমাদের বাড়ীতে বেড়াতে আসা অনেক অতিথিকেই মাকে বলতে শুনেছি “আমার জীবন সম্পূর্ণ রূপে পরিপূর্ণ ও পরিতৃপ্ত – ছেলে বৌ ও নাতনীদের নিয়ে”। আমাদের জীবনে আমরা অনেক কিছু পেয়েছি কিন্তু এই অমূল্য সম্পদটি তুলনা হীন, এর কাছে যে সব কিছুই মলিন।
যেদিন সবাই মিলে আমার স্নেহময়ী মাকে কবরের শীতল গহ্বরে রেখে বাড়ি ফিরে এসেছিলাম, সে রাত্রির মত এমন নিঃসঙ্গ মুহূর্ত আমার জীবনে আর কোন দিনও আসে নাই। আমার চার পাশ ঘিরে ছিল স্ত্রী, সন্তান, নিকট আত্মীয় স্বজন ও বন্ধু বান্ধব, আমার সাথে আমার শোক ভাগ করে নেয়ার জন্য। কিন্তু আমিতো কারো সাথেই আমার শোক, কষ্ট ভাগ করে নিতে পারছিলাম না। আমি হয়ে পড়েছিলাম একা, নিঃসঙ্গ ও নিঃশব্দ। সেদিন খুব বেশি করে মনে হয়েছিল যে আমার যদি একটি ভাই বা বোন থাকতো তাহলে হয়ত আমরা একজন আরেকজনের মনের কষ্টটা বুঝতে পারতাম, ভাগ করে নিতাম আমাদের দুঃখ শোক, একজন আরেকজনের সাথে। ভাগ করে নেয়ার মাঝেই যে রয়েছে আত্মতৃপ্তি, সে সুখই হোক বা দুঃখই হোক।
পিতা মাতারা অনেকটা বাড়ীর পেছনের আঙ্গিনার ডালপালা ছড়ানো প্রাচীন ফল গাছটির ন্যায়, যাকে জন্ম অব্দই দেখছি ঠায় শক্ত হয়ে দাড়িয়ে আছে। দিনের পর দিন আমাদের ক্ষুধা পেলে সে তার ফল দিয়ে তা নিবারণ করে, রোদের তাপ থেকে বাঁচার জন্য ছায়া দিয়ে যায়, ঝড়-বাদল থেকে রক্ষা করে তার ডাল পালা দিয়ে আগলিয়ে, পরিশ্রান্ত হলে শীতল বাতাস বুলিয়ে দেয় গায়ে। এমনি করে করে কখন যে ওই গাছটা, অন্য আর সব কিছুর মত আস্তে আস্তে নিজেই দুর্বল হয়ে যায় আমাদের চোখের আড়ালে। ধীরে ধীরে পাতাগুলি ঝরতে থাকে, ডাল পালাগুলি হয়ে যায় শীর্ণ। যে গাছটি আমাদেরকে জন্মাবধি আগলে রেখেছিল – একদিন ঝড়ের আঘাতে সে নিজেই নিজেকে আর রক্ষা করতে পারে না – উপড়ে পরে যায়। তখন মনে পড়ে ওই মায়াময়ী বৃক্ষটির কথা। কেনই বা বৃক্ষটির আরেকটু যত্ন করে পরিচর্যা করা হলো না বা আর কিছুটা সময়ই কেনই বা গাছটার ছায়ায় বসে গা জুড়িয়ে নিলাম না। প্রতিটি মা’ই তার সন্তানের কাছে অতুলনীয়। তাই মা’কে নিয়ে আমার এই সামান্য নিবেদনটি পৃথিবীর সব মায়ের পায়ে উৎসর্গ করছি। মায়ের কাছে সন্তানের মঙ্গল কামনার চেয়ে আর কোন কিছুই যে মূল্যবান হতে পারে না – এমন কি তার নিজের জীবন ও না। আর তাই আমাদের সমস্ত জীবনটাই যে একটা “মা দিবস”।
মা আমরা ভালো আছি - তুমি যেখানেই থাকো, ভালো থেকো।
মোস্তফা আব্দুল্লাহ, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া
|