bangla-sydney
bangla-sydney.com
News and views of Bangladeshi community in Australia













লেখালেখির সাতকাহন
মোস্তফা আব্দুল্লাহ



পত্র পত্রিকায় লেখালেখি পড়ে মনের মধ্যে সব সময়ই লিখবার একটা বাসনা ছিল। তবে এ ব্যাপারে নিজের অযোগ্যতা বা অপারগতা নিয়ে আমার সন্দেহের কোন অবকাশই ছিল না। বহু বারই কাগজ কলম নিয়ে বসেছি এবং অনেক কসরত করে কিছু একটা দাঁড়ও করিয়েছি, আবার তা তাড়াতাড়ি নিজেই ছিড়েও ফেলেছি – পাছে না আবার কে দেখে ফেলে। এমনি করে করে, তা এখন থেকে বছর তিরিশেক আগে তো হবেই, একটা লেখা দাঁড় করিয়ে চুপি চুপি ঢাকার ডেইলি স্টার পত্রিকায় পাঠিয়ে দিলাম। এক সপ্তাহ গেল - দুই সপ্তাহ গেল, তৃতীয় সপ্তাহে দেখি লেখাটা রোববারের ম্যাগাজিন সেকশনে ছাপা হয়েছে। আমার বিশ্বাস, সেদিনের অনুভূতি যদি লিপি বদ্ধ করতে পারি তাহলে হয়তো তা মহাকাব্যেও পরিণত হতে পারে। লেখাটার বিষয় বস্তু এখন আর মনে নাই, থাকলে ভাল হতো। যাই হোক, এর পর প্রচণ্ড রকম উৎসাহ ভরে আরও কয়েকটা লেখা শেষ করে ফেললাম। সেগুলোও পাঠিয়ে দিলাম ডেইলি স্টারে। ওর কয়েকটা ছাপা হোল আবার দুই একটা হোল না। যেগুলো ছাপা হোল, ছাপার অক্ষরে সেগুলিকে বার বার পড়েও মনের আশ মেটে না – আর যে কটা ওরা ছাপালো না, সেগুলির জন্য মনে একটা চাপা অভিমান জমা হতো। তারপর কি করে জানি লেখা লেখিটা আস্তে আস্তে থেমে গেল। সম্ভবত কাজের চাপে, বলা যেতে পারে লেখালেখির চাপেই, কারণ পেশাদারি কনসালটেন্ট হিসাবে আমাকে অনেকটা সময়ই দিতে হতো লেখালেখি নিয়েই।

এর মাঝে অনেক কাল পর আবার ফিরে এলাম সিডনীতে নূতন করে বাস গড়ার জন্য। অবসর জীবন, এর ওর বাসায় আনন্দ আতিথিয়তায় কেটে যায় সময়। বিশেষ করে আমার ঢাকার কিছু প্রাক্তন সহকর্মীদের সাথে প্রায়ই জমিয়ে চলে গালগল্প। এদের সবারই বয়োজ্যেষ্ঠ হওয়ার সুবাদে আমার জীবন অভিজ্ঞতার কথা, সুযোগ ও সুবিধা মত ফলাও করে বলার সুযোগ হাত ছাড়া করি না। যে কারণেই হোক, হয়ত বা আমাকে চুপ করানোর জন্যই, আনিস একদিন বলল: আপনি আপনার এসব অভিজ্ঞতার কথা লিখে ফেলেন না কেন, পড়ার জন্য একটা ভালো বিষয় হতে পারে।

ভাবতে বসলাম লিখব কি বিষয় নিয়ে। কথা বলার সময় তো রাজা উজির মারতে অসুবিধা হয় না – লিখতে বসলেই সব তাল গোল পাকিয়ে যায়। বেশ কিছু কাগজ ও কালি কলমের শ্রাদ্ধ করলাম, মন মত তেমন কিছু একটা হোল না। ভেবেই চলেছি কি করা যায়। নাতী দুটো পেছনে বসে টেলিভিশন দেখছে – আর মাঝে মধ্যে নিজেদের মধ্যে বচসায় লিপ্ত হচ্ছে। মনে হোল এদের কারণেই আমার লেখাটা আগাচ্ছে না! উদর পিণ্ডি বুদোর ঘাড়ে চাপাতে পেরে যদিও কিছুটা আত্মতৃপ্তি বোধ করলাম, কিন্তু আমি যে কিছু একটা লিখতে পারব, সে ভরসা দিন দিনই ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছিল।

এমন সময় কেন জানি মনে হোল, এই নাতী দুটোর জন্য কি কিছু একটা লেখা যায় না? যা একদিন হয়ত ওরা বড় হয়ে পড়তে চাইতেও পারে। এ ছাড়া আরও ভাবলাম, এরা যখন বড় হয়ে এগুলো পড়তে পারবে, ততদিনে তো নির্ঘাত আমিই অক্কা পেয়ে যাব – সুতরাং লেখাটা যে কোন কাজেরই হয় নাই, তা আর আমাকে শুনতে হবে না। লিখতে শুরু করে দিলাম আমাদের সময়কার ফেলে আসা দিনগুলির কথা - আমরা কি ভাবতাম, কি করতাম, আমাদের কিসে আনন্দ হত আর কিসেই বা বুক ভাসিয়ে কান্না পেত। এমনি করে করে কখন জানি প্রায় বিশ পৃষ্ঠার একটা (আমার ভাষায়) মহাকাব্য রচনা করে ফেললাম, যা কিনা পরে পৃষ্ঠা চল্লিশেকে গিয়ে দাড়ায়। বার বার পড়ি আর তত বারই মোহিত হয়ে যাই নিজের কীর্তিতে! কিন্তু গোল বাধল, এখন কাকে এটা পড়তে দেই – আমার কাছে যেমন এটাকে এক মহান সৃষ্টি বলে মনে হচ্ছে অন্য জনের কাছে তো তা না ও মনে হতে পারে। আনিসের প্রস্তাব/উপদেশেই যেহেতু আমার লেখাটির শুরু, তাকে তো আর মিছেমিছি ছেড়ে দেয়া যায় না – তার ঘাড়েই চাপিয়ে দিলাম এই দুরূহ কাজটি। এখানে বলে রাখি, অদ্যাবধি www.bangla-sydney.com এর প্রকাশক/সম্পাদক আনিসুর রহমান আমার এই উৎপাত থেকে রক্ষা পায় নাই। আমার প্রতিটি লেখাই তার হাতের কাটছাঁট ও শুদ্ধিকরণের পরই হয়ত বা পাঠ যোগ্য হয়ে উঠে।

আনিসের মুখে লেখাটার প্রশংসা শুনে বুকের ওপর থেকে একটা জগদ্দল পাথর নেমে গেল। আনিস প্রস্তাব করল লেখাটা তার ওয়েবসাইটে প্রকাশ করার। আমি কপট স্বরে নিম রাজি হয়ে বললাম: ওটাতো আমাদের একান্ত পারিবারিক বিষয়ের ওপর লেখা, তা প্রকাশ করা কি যথা-যত হবে? যদিও মনে মনে প্রার্থনা করছিলাম, আনিস যেন আমার কথা না শুনে ওটা সত্যি সত্যি প্রকাশ করে। আর তাই হোল। বন্ধু বান্ধব ও পরিচিত জনের সাথে দেখা হলে বা ফোনে লেখাটা ভাল লেগেছে বলে জানালো – আর কজন লিখেও জানলো তাদের ভালো লাগার কথা। সেসব যে আমার জীবনের কত বড় পাওয়া তা যেমন লিখে বোঝাতে পারব না, তেমনি তাদের কাছে আমার কৃতজ্ঞতা বোধের ও শেষ নাই।

উৎসাহ পেয়ে আমার লেখার হোল শুরু। বাংলায় কি করে টাইপ করতে হয় জানতাম না – তাই ইংরেজিতেই লিখতে শুরু করলাম। কয়েকটা লেখা প্রকাশের পর বাংলায় লেখার জন্য মনটা আনচান করতে শুরু করল। আবারো আনিসের শরণাপন্ন হলাম – সেই শিখিয়ে দিল কি করে বাংলা ডাউনলোড করতে হয়, কি করে অভ্র দিয়ে বাংলায় টাইপ করতে হয়। এ ব্যাপারে আমার শ্রদ্ধেয় অগ্রজ-স্বরূপ আলমগীর ভাইয়ের কাছ থেকেও যথেষ্ট সাহায্য ও উৎসাহ পেয়েছি। শুদ্ধ বাংলা বানান আমি কোন কালেই আয়ত্তে আনতে পারি নাই। এ বিষয়ে আমার সহধর্মিণী সব গুলি বাংলা লেখারই প্রাথমিক প্রুফ-রিডারের কাজ করে দিচ্ছেন। ভাগ্যিস তিনি প্রুফ-রিডারের সম্মানীর কথা জানেন না - জানলে এই দুর্মূল্যের বাজারে আমার খবর ছিল।

আমাদের পরিবারের সবার দাদা, প্রখ্যাত সাংবাদিক প্রয়াত সৈয়দ জিয়াউর রহমান সর্বদা উৎসাহ যুগিয়েছেন আমার লেখালেখির বিষয়ে। প্রতিটা লেখা তাঁর কাছে পাঠিয়ে অপেক্ষা করতাম তার উৎসাহ ব্যঞ্জক মতামতের জন্য। সৈয়দ জিয়াউর রাহমান ছিলেন একজন নিরপেক্ষ ও নির্ভীক সাংবাদিক, যার কর্মজীবনের মূলমন্ত্র ছিল - প্রত্যেকেরই নিজ নিজ রাজনৈতিক মতাদর্শ থাকতেই পারে, তবে সংবাদ পরিবেশন কালে একজন সত্যনিষ্ঠ সাংবাদিক কে তার ব্যক্তিগত মতাদর্শের ঊর্ধ্বে উঠতে সক্ষম হতে হবে। প্রায় সাত যুগ ধরে বিস্তৃত তার সাংবাদিক জীবনের শুরু ১৯৫৭ সালে ময়মনসিংহের কলেজ জীবন থেকে, মৌলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানির কাগমারী সম্মেলনের সংবাদ সংগ্রহ ও তা পরিবেশনের মাধ্যমে, যার পরিসমাপ্তি ঘটে ২০১১ সালে ওয়াশিংটন ডিসি তে ভয়েস অব আমেরিকার জ্যেষ্ঠ সম্পাদক হিসাবে অবসর গ্রহণের পর। ২০২০ সালে তিনি দেহত্যাগ করেন। তিনি আমাকে প্রায়শঃ বলতেন আমার লেখাগুলিকে পুস্তকাকারে প্রকাশ করতে। তাকে কথা দিয়েছিলাম, কিন্তু সে কথা তার জীবদ্দশায় পূরণ করা হয়ে উঠল না।

এর মাঝে একদিন ফেসবুক খুলে দেখি আমদেরই ১৬ বৎসর বয়সের এক নাতনী, আলিয়া রহমান, ৪০০ পৃষ্ঠার একটি ভবিষ্যবাদী উপন্যাস (The Outer Lands) লেখা সম্পন্ন করে পুস্তকাকারে প্রকাশও করে ফেলেছে ২০১৭ সালে। ১২ বৎসর বয়সে যখন সে উপন্যাসটি লেখা শুরু করে, তখনো ডোনাল্ড ট্রাম্প নামক সং টির আমেরিকার রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চে তেমন আবির্ভাব ঘটে নাই। আশ্চর্যের বিষয়, আলিয়ার উপন্যাসটিতে ট্রাম্প এরই বর্তমান কার্য কলাপের প্রতিফলন!

আলিয়া বর্তমানে আমেরিকার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। এই সেদিন আলিয়ার লেখা একটি ছোট গল্প মেরিল্যান্ড ইউনিভার্সিটির The Sebastian Herbstein Memorial Scholarship in Fiction Writing প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান দখল করেছে। রূপে গুণে সরস্বতী আমাদের এই নাতনীটি একাধারে একজন অঙ্কন শিল্পী এবং সু-গায়িকাও, যে কিনা নিজেই নিজের গান বেঁধে সুর করে গিটার বাজিয়ে তা গায়। স্কুল ছাড়ার আগেই সে আমেরিকান উইমেন বাস্কেট বল অলিম্পিক ট্রেনিং ক্যাম্পে অনুশীলনের জন্য চূড়ান্ত ১৫০ জনের মধ্যে নির্বাচিত হয়েছিল। এহেন সর্ব গুনে গুণান্বিত নাতনিটি যখন তার বইটি প্রকাশ করে ফেলল – তখন আর আমি কেমন করে বসে থাকি। এর মধ্যে নাকি সে একদিন তার মাকসুদ ভাইকে (আমাকে) স্বপ্ন দেখেছে সুপার ম্যানের বেশে আর তারা দুই বোন আমার সংগ নিয়েছে দুই ওয়ান্ডার ওমেন হয়ে। এখন তো আর আমার ফিরিবার পথ নাই – পুস্তকাকারে যে এখন সুপার ম্যানকে তার লেখাগুলি প্রকাশ করতেই হবে।

বয়স ৭৪ বৎসর পার করার বেশ কিছু আগে থেকেই হাঁটুর ও কোমরের ব্যথা আমার নিত্য সঙ্গীতে পরিণত হয়েছে। এই নিত্য সঙ্গীদের অনুরোধ অনুযোগ উপেক্ষা করে প্রাত্যহিক প্রাতঃভ্রমণ দিন দিনই বেশ কষ্টকর হয়ে উঠছে। তার পরও প্রতিদিনই বেরিয়ে যাই। প্রথম কয়েক মিনিট মনে হয় – আজকে আর হবে না, ফিরে যাই। তার পরও মনের জোড়ের ওপর ভর করে চলতে চলতে প্রায় আধা ঘণ্টার ওপর হাটা হয়ে যায়। আমার লেখা লেখি ও যেন অনেকটা সেই নিয়ম মেনেই চলে। কোন ভাবেই প্রথম লাইনটা আসে না – তাও বা যা শুরু করলাম, প্রথম অনুচ্ছেদ বা প্যারার পর আর কোন ভাবেই আগাতে পারি না। তারপর আমার প্রাতঃভ্রমণের মত, ঠিক ঠিকই পৃষ্ঠা দুই এক এর মত লেখা কখন যেন হয়ে যায়। সেগুলি অবশ্য পড়ার যোগ্য হয় কিনা তা পাঠকই ভাল জানেন।

সব শেষে আমার সাম্ভব্য পাঠকদের কাছে আমার একটি বিনীত আবদার; আমার লেখাগুলিকে অনুগ্রহ করে কোন ভাবেই সাহিত্যিক মানদণ্ডে বিচার করবেন না, কেন না কোন মানদণ্ডই আমি উৎরাতে পারব না। তবে যদি একজন পাঠকও আমি কি বলতে চেয়েছি তা অনুধাবন করতে পারেন, তাহলে আমি নিজেকে একশ তে একশই পেয়ে উৎরে গেছি বলে মনে করব।




মোস্তফা আব্দুল্লাহ, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া




Share on Facebook               Home Page             Published on: 28-May-2020

Coming Events:



Lakemba Blacktown Mascot
Minto Money raised so far





Lakemba Blacktown Mascot
Minto Money raised so far



Blacktown Lakemba Mascot
Minto Money raised so far







Blacktown Lakemba Mascot
Minto Money raised so far