কাদম্বিনী গাঙ্গুলী মোস্তফা আব্দুল্লাহ
আজ ৩রা অক্টোবর। ১৯২৩ সালে এই দিনেই পরলোক গমন করেন কাদম্বিনী গাঙ্গুলী, ভারতের প্রথম দুজন ইউরোপীয় চিকিৎসা শাস্ত্রে শিক্ষিত, দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম নারী চিকিৎসকদের একজন। বিভিন্ন পত্র পত্রিকা ও প্রকাশনা থেকে তার সংগ্রাম বহুল জীবন ও জীবন-যুদ্ধে জয়ের কিছু তথ্যাদি দিয়ে সাজানো হয়েছে রচনাটি।
আমার স্ত্রীর কখনো ডাক্তার দেখানো বা শারীরিক পরীক্ষার জন্য এক্সরে বা স্ক্যানিং এর প্রয়োজন পড়লে প্রথমেই তিনি নিশ্চিত হতে চান মহিলা ডাক্তার বা টেকনিশিয়ান থাকবে তো? আর আমার মার কথা যদি বলি, মাথায় হাত দেয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকার কথা না। তিনি দাঁত দেখাতে তার মামাত ভাই এর ডেন্টিস্ট ছেলেকে যন্ত্রপাতি নিয়ে বাসায় আসতে বাধ্য করেছিলেন! কিছুটা হলেও কম বেশি আমাদের সমাজের অনেক মহিলারই ডাক্তারের কাছে যাওয়া নিয়ে এই ধরনের অস্বস্তিতে ভোগেন এবং অনেক ক্ষেত্রে তা তাদের জন্য বিপদজনকও হয়ে উঠে। আজও পুরুষ ও মহিলা জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে মহিলা ডাক্তারের সংখ্যা খুবই কম আর তাই মহিলারাই স্বাস্থ্য সেবা থেকে বঞ্চিত হন বেশি।
তখনকার দিনের রক্ষণশীল সমাজের নারীদের নাই-বলতে স্বাস্থ্য সেবার কথা ভেবেই সম্ভবত আজ থেকে ১৩০ বৎসর আগে কাদম্বিনী গাঙ্গুলী ভারতের প্রথম দুজন ইউরোপীয় চিকিৎসা শাস্ত্রে শিক্ষিত, দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম নারী চিকিৎসকদের একজন হয়েছিলেন। অপর জন ছিলেন আনন্দীবাঈ যোশী, যিনি আমেরিকা থেকে ডাক্তারি পাস করে আসেন। কাদম্বিনী গাঙ্গুলীর জন্ম ১৮ জুলাই ১৮৬১ সালে বিহারের ভাগলপুরে। তার পিতার নাম ব্রজকিশোর বসু। ব্রাহ্ম সংস্কারক ব্রজকিশোর বসুর কন্যা কাদম্বিনীর জন্ম বিহারের ভাগলপুরে হলেও, তার মূল বাড়ি ছিল বর্তমান বাংলাদেশের বরিশালের চাঁদসি। তার বাবা ভাগলপুর স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন।
উনবিংশ শতাব্দীতে চার দেয়ালের বাইরে বের হওয়া নারীদের জন্য ছিল দুঃসাধ্য। সেই শতাব্দীর মেয়ে হয়ে চলমান প্রথা ভাঙেন কাদম্বিনী গাঙ্গুলী। হয়ে ওঠেন বাংলার প্রথম নারী চিকিৎসক। সাফল্যের পথটা মসৃণ ছিল না তার, ছিল কাঁটায় ভরা। রক্তচক্ষু দেখিয়েছে তৎকালীন সমাজ। সেই রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে অনেকটা পথ একাই হেঁটেছেন কাদম্বিনী। চিকিৎসক হয়েও কাদম্বিনীকে সইতে হয়েছে শত অবহেলা। সমাজের মানুষের ধারণা ছিল, একটা মেয়ে কিভাবে ডাক্তার হতে পারে? নেতিবাচক ধারণা ভেঙে বারবার আঙুল তোলা মানুষগুলোর বিরুদ্ধে জয় যুক্ত হন কাদম্বিনী গাঙ্গুলী।
উদার পন্থী ব্রাহ্ম সমাজের সদস্য মনোমোহন, দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়, দুর্গামোহন দাসের মতো সেই সময়কার স্ত্রী স্বাধীনতার সমর্থকেরা একটি উচ্চমানের মেয়েদের স্কুল তৈরির জন্য বদ্ধপরিকর ছিলেন। ১৮৭৩ সালে এই স্কুলটি স্থাপিত হয়। নাম হয় ‘হিন্দু মহিলা বিদ্যালয়’। মূলত বোর্ডিং স্কুল। কাদম্বিনীর স্কুল শিক্ষায় পদার্পণ এখানেই। যত দূর জানা যায় তখন তাঁর বয়স ১৩। কিন্তু স্থাপন হওয়ার আড়াই বছরের মাথায় স্কুলটি উঠে যায়, তদানীন্তন রক্ষণশীল হিন্দু সমাজপতি ও এমনকি ব্রাহ্ম সমাজ এর রক্ষণশীল গোষ্ঠীর প্রবল বিরোধিতায়। পরে ১৮৭৬ সালে ‘বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয়’ নামে স্কুলটি পুনরুজ্জীবিত হয়। এটি ছিল বাঙালি মেয়েদের প্রথম ইংলিশ বোর্ডিং স্কুল। কিন্তু এই স্কুলেরও একই পরিণতি ঘটে উপরোক্ত কারণেই।
শেষ পর্যন্ত বহু টানাপড়েনের পরে স্কুল বাঁচাতে ১৮৭৮ সালে বঙ্গ মহিলা বিদ্যালয়কে মিশিয়ে দেওয়া হল বেথুন স্কুলের সঙ্গে। কাদম্বিনী ছিলেন এই স্কুল থেকে প্রথম এন্ট্রান্স বা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষায় বসা মেয়ে। মাত্র এক নম্বরের জন্য প্রথম বিভাগ না পেলেও সমস্ত সমালোচকের মুখ বন্ধ করেছিলেন। ‘সংবাদ প্রভাকর’ নামে তখনকার দিনের প্রভাবশালী পত্রিকা এই বলে কটাক্ষ করে — ‘কাদম্বিনী এক্ষণে কোন বিদ্যালয়ে পড়বেন?’
কাদম্বিনী নিজে জানিয়েছিলেন, তিনি ফার্স্ট আর্টস পড়বেন। কিন্তু এর জন্য কলেজ তৈরি করতে হবে। কাদম্বিনীর জন্যই বেথুন স্কুলকে কলেজে রূপান্তরিত করার কথা সরকার ভাবে এবং তা বাস্তবায়িত হয়। বাংলায় সাড়া পড়ে যায়। এক জন ছাত্রী ও এক জন লেকচারার নিয়ে শুরু হল কলেজ। কাদম্বিনীরও আগে প্রাইভেটে এন্ট্রান্স দিয়ে সফল হয়েছিলেন চন্দ্রমুখী বসু। এঁরা দু’জনেই ১৮৭৯তে এফএ পাশ করলেন এবং তাঁদের যুগ্ম সাফল্য বেথুন কলেজে বিএ পড়ানোর দরজা খুলে দেয়। চন্দ্রমুখী নিলেন পলিটিকাল ইকনমি আর কাদম্বিনী গণিত। ১৮৮৩ সালের জানুয়ারিতে ইতিহাস গড়ে দু’জনে বিএ পাশ করলেন। দেশের প্রথম দুই মহিলা গ্র্যাজুয়েট। স্ত্রীশিক্ষা বিশেষ করে মহিলাদের উচ্চশিক্ষার উপরে চাপা পড়া জগদ্দল পাথর নড়ে গেল। চন্দ্রমুখী বেথুনেই এমএ পড়া শুরু করলেন। কিন্তু কাদম্বিনী সিদ্ধান্ত নিলেন এমবিবিএস পড়বেন। এবার আরও ভয়ঙ্কর প্রতিরোধ ও লড়াইয়ের ইতিহাসের সূচনা হল।
মেডিক্যাল পড়তে চেয়ে তিনি আবেদন করেন ১৮৮১ সালে। শিক্ষা অধিকর্তা আগ্রহী হলেও কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ কাউন্সিলের কোনও প্রতিক্রিয়া দেখা যায় না। কাদম্বিনী হাল না ছেড়ে বিএ পড়ায় মন দেন। তার দু’বছর পরে আবার আবেদন করেন। এর মধ্যে ২১ বৎসর বয়সে কাদম্বিনী বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন ৩৯ বৎসর বয়স্ক তার বিপত্নীক শিক্ষক দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে। এ বিবাহ নিয়েও তুমুল আপত্তি তুলে ব্রাহ্ম সমাজের নেতৃত্ব ও পত্র পত্রিকায় নানা রকম কুরুচি পূর্ণ মন্তব্য প্রকাশিত হয়। বিয়ের কয়েক দিনের মধ্যেই মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হতে সমর্থ হন কাদম্বিনী। মেডিক্যালের চিকিৎসকদের একাংশ তা কিছুতেই বরদাস্ত করতে পারলেন না। তাঁদের অন্যতম ছিলেন রাজেন্দ্র চন্দ্র। তিনি বিলেতে লর্ড পরিবারের সঙ্গে বিয়ের সূত্রে আবদ্ধ হয়েছিলেন কিন্তু স্ত্রী শিক্ষার ঘোর বিরোধী ছিলেন। অতি রক্ষণশীল এই চিকিৎসক কাদম্বিনীর মেডিক্যাল পড়ার খোলাখুলি প্রতিবাদ করেছিলেন!
সেই কাদম্বিনীকে ‘ব্যাচেলর অব মেডিসিন’ বা এমবি পরীক্ষায় পাশ করানো হয়নি! চিকিৎসক রাজেন্দ্র চন্দ্র মেডিসিন পড়াতেন। তিনি কাদম্বিনীকে মৌখিক পরীক্ষায় তাঁর পেপারে এক নম্বরের জন্য ফেল করিয়ে দেন। চিকিৎসক জে এম কোটস ছিলেন তখন মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ এবং তিনিও মেডিসিনের অধ্যাপক ও অন্যতম পরীক্ষক ছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন যে, কাদম্বিনীর সঙ্গে অন্যায় হচ্ছে। তাঁর ইচ্ছানুযায়ী সিন্ডিকেটে আলোচনার পরে কাদম্বিনীকে ‘লাইসেনসিয়েট ইন মেডিসিন অ্যান্ড সার্জারি’ বা এলএমএসের সার্টিফিকেট দেওয়া হয় ১৮৮৬ সালের ৭ অগাস্ট। কিন্তু দু’বছর এলএমএস পড়ার পরে ফাইনালে ফের চিকিৎসক রাজেন্দ্র চন্দ্রের বিষয়ে তাঁকে ফেল করানো হল।
তখন অধ্যক্ষ কোটস নিজের অধিকার বলে কাদম্বিনীকে ‘গ্র্যাজুয়েট অফ দ্য মেডিক্যাল কলেজ অব বেঙ্গল’ বা জিএমসিবি উপাধি দেন। ফলে ডাক্তার হয়ে প্র্যাকটিসের ছাড়পত্র পেয়ে যান কাদম্বিনী। ইডেন হাসপাতালে তাঁকে কাজের সুযোগ করে দেন কোটস। কিন্তু যেহেতু ডাক্তারির এমবি বা এলএমএসের ডিগ্রি তাঁর ছিল না, তাই সেখানে তাঁকে নার্সের মর্যাদা দেওয়া হত। রোগ নির্ণয় বা অস্ত্রোপচার করতে দেওয়া হত না। ১৮৯০-এ তিনি লেডি ডাফরিন হাসপাতালে চাকরি পান। কিন্তু ডিগ্রি না পাওয়াটা সম্ভবত কাঁটার মতো তাঁকে বিঁধছিল। কারণ, বিরোধীরা প্রতি পদক্ষেপে ওই বিষয়টিকে তুলে তাঁর যোগ্যতা নিয়ে বিদ্রূপ এবং তাঁকে চিকিৎসকের দায়িত্ব দেওয়ার প্রতিবাদ করছিলেন। তখনই বিদেশে গিয়ে তিনি ডাক্তারি ডিপ্লোমা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। বিলেত যাওয়ার জন্য টাকার সংস্থান করা, বিদেশে থাকার ব্যবস্থা ও দেশে নিজের আট সন্তানের দেখাশোনার ব্যবস্থা করে তাঁকে বিদেশ যেতে হয়। বিলেত যাওয়ার পাথেয় সংগ্রহ করেছিলেন শিকাগো মহাসম্মেলনের প্রদর্শনীতে ভারতীয় মহিলাদের শিল্পকর্ম পৌঁছে দেওয়ার কাজ নিয়ে।
কাদম্বিনীর কাঙ্ক্ষিত ডিপ্লোমাগুলি ছিল এলআরসিপি, এলআরসিএস এবং এলএফপিসি। যা সংগ্রহ করেছিলেন অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতায়। ক্লাস করতেন এডিনবারায়। ১৮৯৩ সালের জুলাই মাসে স্কটিশ কলেজের তিনটি ডিপ্লোমা লাভ করেন। কলকাতায় ফেরার পরে ‘বামাবোধিনী’ বা ‘ইন্ডিয়ান মেসেঞ্জার’-এর মতো কাগজগুলি তাঁর তুমুল প্রশংসা করে। কিন্তু বিরোধিতায় ইতি পড়েনি তখনও। চিকিৎসক কাদম্বিনী তাঁর যোগ্যতার পদ বা চাকরি পাননি। কিছু দিন ডাফরিন হাসপাতালে সিনিয়র ডাক্তারের চাকরি করে ইস্তফা দিয়ে নিজের বাড়িতে চেম্বার খুলে পুরোপুরি প্রাইভেট প্র্যাকটিস শুরু করেন। পসার জমে ওঠে দ্রুত।
পেশা জীবনে বহু ব্যাপারে বাংলার প্রথম নারী হিসেবে রেকর্ড করা কাদম্বিনীকে অনেক বাধার সম্মুখীন হতে হয়। তাকে পরোক্ষ ভাবে বেশ্যা বলেছিল এক সম্পাদক, মহেশচন্দ্র পাল। তখনকার বঙ্গবাসী নামে সাময়িক পত্রিকার ডাকসাইটে সম্পাদক মহেশচন্দ্র পাল একটি কার্টুন ছেপে ডা. কাদম্বিনীকে ‘স্বৈরিণী’র সঙ্গে তুলনা করেছেন। কারণ কাদম্বিনী নাকি মোটেই ঘরোয়া নন। ঘর-সংসারের দিকে, ছেলেমেয়ের দিকে তার নাকি মন নেই, নিষ্ঠাও নেই। এতগুলো সন্তানের মা হওয়া সত্ত্বেও তিনি নাকি মাতৃ ধর্ম পালন করছেন না। এর ওপর আবার সমাজসেবা, স্বদেশী করে বেড়াচ্ছেন, সভাসমিতি করছেন বাইরে। সুতরাং বঙ্গবাসী পত্রিকায় একটা কার্টুন এঁকে দেখানো হলো, বারবনিতা ডা. কাদম্বিনী স্বামী দ্বারকানাথের নাকে দড়ি দিয়ে হিড় হিড় করে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু ছেড়ে দেবার পাত্রী নন কাদম্বিনী কিংবা তার স্বামী। মামলা হলো। বঙ্গবাসী পত্রিকার সম্পাদক মহেশচন্দ্র পালের ১০০ টাকা জরিমানা আর ৬ মাসের জেল হয়েছিল। সেই সময় এই ধরনের মামলা করা, বিশেষ করে এক শক্তিশালী পুরুষ কাগজের সম্পাদকের বিরুদ্ধে কোনো নারীর মানহানির মামলা করাটা মোটেই সহজ ছিল না।
১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দে বোম্বে শহরে কংগ্রেসের পঞ্চম অধিবেশনে প্রথম যে ছয় জন নারী প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছিলেন, কাদম্বিনী ছিলেন তাদের অন্যতম একজন। পরের বছর তিনি কলকাতার কংগ্রেসের ষষ্ঠ অধিবেশনে বক্তব্য রাখেন। কাদম্বিনী ছিলেন কংগ্রেসের প্রথম মহিলা বক্তা। কাদম্বিনী গান্ধীজীর সহকর্মী হেনরি পোলক প্রতিষ্ঠিত ট্রানসভাল ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের প্রথম সভাপতি এবং ১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতায় অনুষ্ঠিত মহিলা সম্মেলনের সদস্য ছিলেন। ১৯১৪ সালে তিনি কলকাতায় সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজের অধিবেশনে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। এই অধিবেশন মহাত্মা গান্ধীর সম্মানের জন্য আয়োজন করা হয়েছিল। কবি কামিনী রায়ের সঙ্গে কাদম্বিনী দেবী ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে বিহার এবং ওড়িশার নারীশ্রমিকদের অবস্থা তদন্তের জন্য সরকার দ্বারা নিযুক্ত হয়েছিলেন।
এই মহিয়ষী নারী ও ব্যতিক্রমী পথ-প্রদর্শকের অভূতপূর্ব জীবন এর অবসান ঘটে ১৯২৩ সালের ৩রা অক্টোবর, ৬৩ বছর বয়সে।
* বিভিন্ন পত্র পত্রিকা ও প্রকাশনা থেকে সংগৃহীত ও পুনর্মুদ্রিত।
মোস্তফা আব্দুল্লাহ, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া
|