জীবন যখন যেখানে যেমন মোস্তফা আব্দুল্লাহ
বৎসরের শুরুর দিকে দেশ থেকে যখন ফিরি তখনো করোনা’র বিস্তারের খবর ছড়িয়ে পড়ে নাই। তবে আমার বিশ্বাস ততদিনে হয়তবা এর বিস্তার শুরুও হয়ে গিয়েছিল। আমাদের পার্শ্ববর্তী কয়েকজন সহযাত্রী যে ভাবে হেঁচে ও কেশে যাচ্ছিলেন তাতে করোনার মত কোন ভয়াবহ মরণ-ব্যাধির কথা মনে উদ্রেক না হোলেও উড়োজাহাজের এর সরবরাহকৃত খাবার গ্রহণের অভিরুচি আমদের দুজনেরই উবে গিয়েছিল। ঘরে ফিরেই আমরা দুজনেই ভয়ানক রকম অসুস্থ হয়ে পরি, দিন কয়েকের জন্য। ভাগ্যিস তখনো “করোনা” খবরে পরিণত হয় নাই – তা না হলে হয়ত বনের বাঘ খওয়ার আগেই মনের বাঘই শেষ করে দিত!
সেরে উঠতে না উঠতেই করোনার মরণ ছোবলের সাঁড়াশি আক্রমণে – ধীরে ধীরে স্তব্ধ হতে শুরু করল বিশ্ব ব্যাপী জন জীবন। গৃহ বন্দি হয়ে বাড়তে থাকে অস্থিরতা – মনের মধ্যে ঘুর পাক খেতে থাকে “ভবিষ্যতে” কবে যে এর অবসান হবে আর আবার কবে “অতীতের” জন জীবন ফিরে পাব। এই অতীত ও ভবিষ্যৎ নিয়ে ঘুরপাক খেতে খেতে বর্তমান যে আমদের দিকে চেয়ে মুখ টিপে হেসে হেসে পালিয়ে যাচ্ছে, তার খেয়াল বোধ হয় আমরা অনেকেই করছি না! এই হারিয়ে যাওয়া “বর্তমানটা” যে আর কোন দিনই ফিরে আসবে না! এই মহামূল্যবান কথাটি আমরা অনেকেই বুঝতে না পারলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মাত্র ১৫ বৎসর বয়সের এক ইহুদি তরুণী অ্যান ফ্রাঙ্ক ঠিকই তা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। রাত্রি শেষে ভোরের আলো যে দেখা দেবেই এই বিশ্বাসে নিশ্চিত হয়ে বর্তমানের প্রতিটা মুহূর্তের সদ্ব্যবহার সে করেছে দু দুটা বছর ধরে, কাগজ কলমকে সঙ্গী করে।
জার্মান অধিকৃত নেদারল্যান্ডসে নাৎসিদের হাত থেকে বাঁচতে দু’বছর গোপন কুঠুরিতে লুকিয়ে ছিল অ্যান ফ্রাঙ্ক ও তার পরিবারের সদস্যেরা। সেই গোপন, নিঃসঙ্গ জীবনে অ্যানের প্রিয় বন্ধু হয়ে উঠেছিল তেরো বছরের জন্মদিনে উপহার পাওয়া একটি ডায়েরি। যেখানে অ্যান লিখে রেখেছিল নিজের চিন্তা, অভিমান, যন্ত্রণা, প্রেম সব কিছু।
কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে ষোলো বছর বয়সে মৃত্যু হয়েছিল অ্যানের। বেঁচে গিয়েছিলেন শুধু অ্যানের বাবা অটো ফ্রাঙ্ক। তিনিই ডায়েরিটি খুঁজে পেয়ে অ্যানের ইচ্ছে পূরণের জন্য বই হিসেবে তা প্রকাশ করেছিলেন। সেই ডায়েরিই, ‘অ্যান ফ্রাঙ্ক: দ্য ডায়েরি অব আ ইয়ং গার্ল’, অ্যানকে পরবর্তীকালে হলোকস্টের সময়ের অন্যতম আলোচিত মুখ করে তুলেছিল। অ্যান এর বর্তমানই নিয়ে গিয়েছে তাকে, ভবিষ্যতের স্বপ্ন-শিখরে। অ্যান ফ্রাঙ্ক এর কথা ভাবতে ভাবতে মনে হোল আমার নাতী দুটোকে বলি আজ থেকেই যেন দিন শেষে তারা প্রতি দিন - দিনপঞ্জি লিপিবদ্ধ করা শুরু করে। মেয়েকে টেলিফোন করে বললাম কথাটা, তাদেরকে দিয়ে যেন লেখাতে শুরু করে - কেমন যাচ্ছে তাদের এই ঘর-বন্দি জীবনটা।
এ কদিন ধরে অফিসের কাজ ঘড়ে বসে করার পাশাপাশি স্বামী সন্তানদের সামাল দিতে দিতে মেয়েটা আমার সম্ভবত হাঁপিয়ে উঠেছিল: - তাদের আর কেমন যাবে, তারা তো মহা আনন্দেই আছে, যা কিছু যাচ্ছে তা তো আমার ওপর দিয়ে। - তাহলে তুমিই না হয় তোমার দিনপঞ্জি লেখা শুরু কর। মেয়েটা বোধ হয় আন্দাজ করতে পেরেছিল যে একটা ফাউল করে পেনাল্টি শট খেতে চলেছে, তাই বলটা আবার আমার কোর্টে ঠেলে দেয়ার জন্য বলল: - তুমিই না হয় ওদের দিয়ে কাজটা শুরু করাও। বুঝতে পারলাম, ফেঁসে গেছি তাই আপাতত ওই প্রসঙ্গটা চেপেই গেলাম।
সারা পৃথিবী জুড়ে কেবল মাত্র উদ্বেগময় খবরাখবরের ছড়া ছড়ির মাঝে, এবার ঢাকা থেকে ফেরার পথে, কিছুটা হোলেও হাসির জোগান দিতে পারে, এমনি একটা ঘটনার বর্ণনা দিয়ে আজকের এই লেখাটা শেষ করি। করোনা বিষয়ক সংবাদ ও তথ্য-ভারে বেসামাল হয়ে ঘটনাটা প্রায় ভুলেই যেতে বসে ছিলাম।
ঢাকা এয়ারপোর্টে তরুণ বয়সের ফিট ফাট বেশভূষার হাসি খুশি চেহারার এক ইমিগ্রেশন অফিসার আমাকে “স্যার” বলে সম্বোধন করল! “স্যার” তো বলেছেই তাও আবার হাসি মুখে - ঠিক ঠিক শুনেছি বা দেখেছি তো? যত দিন যাচ্ছে চক্ষু ও কর্ণের ওপর আস্থাটা দিন দিন কমে আসছে বলে বিশ্বাস করতে ঠেকছিল। দেশ থেকে ফেরা বা ঢোকার সময় আমার মত সাধারণ গোবেচারা গোছের লোকজন বেশ একটা শঙ্কিত ও সংকোচই বোধ করে থাকি। কারণ ওনারা সাধারণত আমাদের পাসপোর্ট বা মালামাল পরীক্ষার সময় এমন চোখে তাকান, মনে হয় যেন - হয় আমরা চুরি করে ঢুকছি বা পালিয়ে যাচ্ছি।
সেটা সম্ভবত আমাদের অভ্যাসের দোষ। সাত পুরুষের ভিটে মাটি ছেড়ে যখন এই অস্ট্রেলিয়ায় ফিরে আসি আর ইমিগ্রেশন অফিসার যখন মাঝে মধ্যে হাসি মুখে বলেন “ওয়েল কাম ব্যাক হোম”, কেমন জানি খটকা লাগে। খটকা লাগে যখন কখনো কোন কারণে রাস্তায় পুলিশ গাড়ি থামিয়ে বলে “মে আই ছি ইয়োর লাইসেন্স - প্লিজ”।
যাক সে কথা এখন, যে কথা বলতে বসেছিলাম সেখানেই ফিরে যাওয়া যাক। আমার বিশ্বাস করতে ঠেকছিল, ঠিক ঠিকই কি ওই তরুণ বয়সের উর্দি পরা সরকারী কর্মচারীটি আমাকে স্যার বলেছে? আমাকে স্যার বলার তো তার কোন কারণই নাই – আমি জীবনে কোন দিন আমলা-গিরি বা গলাবাজি করার কোন সুযোগই পাই নাই বা না নিজেকে কখনো উপযুক্ত বলে মনে করেছি। যদিও খুবই স্বল্পকালীন সময়ের জন্য খণ্ড-কালীন শিক্ষকতা করেছিলাম, তবে সেই সুবাদে এমন উর্দি পরা লোকজনের কাছ থেকে স্যার বলে সম্বোধন পাবার দুরাশা বা দুঃসাহস কোন কালেও করি না।
বিষয়টা ছিল একটু ভিন্ন – হাসির খোরাক যোগাবার মত। পাসপোর্ট দেখাবার জন্য লাইনে দাঁড়িয়েছি, আমি সামনে – পেছন পেছন গিন্নী। তরুণ বয়সের অফিসারটি আমার পাসপোর্ট দেখে ফেরত দিয়ে গিন্নিকে ডেকে ক্যামেরার সামনে দাড়াতে বলল। ক্যামেরার সোজা সুজি না হওয়াতে তাকে আবার আর একটু এগিয়ে এসে সোজা সুজি দাঁড়াতে বলে। অফিসারটি একবার পাসপোর্ট এর দিকে দেখছে, আবার গিন্নীর দিকে তাকাচ্ছে, মাঝে মধ্যে সামনে রাখা কম্পিউটারের স্ক্রিনে কি যেন পড়ছে। বেশ একটু অস্বস্তিকর অপেক্ষা। কিছুটা উদ্বিগ্ন কণ্ঠেই জানতে চাইলাম – কোন সমস্যা? অফিসারটি পাসপোর্ট ফিরিয়ে দিতে দিতে আমার দিকে চেয়ে কিছুটা দুষ্টু হাসি হেসে বলল “না স্যার - ফিরে যাবার সময় বউ বদল করে নিয়ে গেলেন কিনা চেক করে দেখলাম”!
মোস্তফা আব্দুল্লাহ, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া
|