গ্রিন-এপেল থেকে বিগ-এপেল মোস্তফা আব্দুল্লাহ
আমি নিতান্তই গোবেচারা নিরীহ গৃহপালিত জীব, যাকে আমেরিকানরা ব্যাঙ্গ করে বলে ‘গ্রিন এপেল’। বিদেশ তো দুরের কথা, আমি একা একা ঢাকার বাইরেও খুব একটা যাইনি। ১৯৭৫ সনের অগাস্ট মাসের কোন এক বিকালে সেই আমিই উড়োজাহাজে উঠে রওনা দিলাম নিউ ইয়র্ক এর উদ্দেশ্যে, যার আর এক নাম ‘বিগ এপেল’। সেটা ছিল থাই এয়ার এর ব্যাংকক থেকে আসা দিল্লী গামী একটি ফ্লাইট; সম্ভবত বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ঢাকা থেকে প্রথম বিদেশ গামী উড়োজাহাজ।
আমরা জনা পাঁচেক উঠেছিলাম ঢাকা থেকে। প্লেনে ওঠা মাত্র ব্যাংকক থেকে আসা অন্য যাত্রীরা আমাদেরকে জেঁকে ধরলঃ ঢাকায় কি এখনো যুদ্ধ চলছে, হতাহতের সংখ্যা কি রকম, বিদ্রোহীরা কি ধরা পড়েছে, আপনারা পালালেন কেমন করে – এরকম আর কত কি। রাত নাগাদ দিল্লী পৌঁছলাম। পরদিন সকালে লুফথানসা এয়ারলাইন্স করে নিউ ইয়র্ক যাবো। রাতটা হোটেলে কাটিয়ে সকালে দিল্লী আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের ইমিগ্রেসন পার হতেই পুলিশের উর্দি পরা একজন আমাকে ডেকে একটা ঘরের ভিতর নিয়ে জেরা শুরু করল। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড সম্বন্ধে আমি কি কি জানি, আমার কি এর সাথে কোন যোগ সাজশ ছিল, এমন একটা সময়ে আমি কি ভাবে দেশ থেকে বেরিয়ে যেতে পেরেছি, কে কে আমাকে এ ব্যাপারে সাহায্য করেছে, কাকে কাকে আমি চিনি ইত্যাদি ইত্যাদি। বিশেষ করে তদানীন্তন দিল্লীর বাংলাদেশ হাই কমিশনে কর্মরত একজন কূটনৈতিক কর্মকর্তা, যিনি আত্মীয়তার সূত্রে রাতে আমার সাথে দেখা করতে হোটেলে এসেছিলেন, তার সম্বন্ধেই জানতে বেশি আগ্রহী। বুঝতে পারলাম দেশ থেকে যদিও বের হতে পেরেছি কিন্তু আমেরিকা আর আমার যাওয়া হবে না – আর কিছুক্ষণ পরেই উড়োজাহাজটি রওনা দেবে। ভদ্রলোক আমাকে ছেড়ে কার সাথে জানি টেলিফোনে কথা বললেন – তারপর আমার দিকে মুখ করে বললেন, দৌড়িয়ে যাও – তা না হলে প্লেন মিস করবে।
প্লেনটি জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট হয়ে রোববার বিকালে নিউইয়র্ক পৌঁছালো। মালামাল নিয়ে বেরিয়ে বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম আমাকে যার নিতে কথা তার জন্য। তার কোন হদিস না পেয়ে চিঠিতে লেখা হোটেলের ঠিকানা দেখে নিজে নিজেই যাওয়া মনস্থ করলাম। বাদ সাধল বেরোবার পথে একটা বিরাট কাঁচের দরজা – যেটা কিনা নিজে নিজেই একবার খুলছে আবার নিজে নিজেই বন্ধ হচ্ছে! বড় মুসীবত, খোলা দেখে বেরোবার সময় যদি গায়ের ওপর বন্ধ হয়ে যায়? কাছাকাছি গিয়ে অনেক ভেবে চিন্তে একজনের পিছন পিছন গিয়ে খোলা পেতেই দৌরে বেরিয়ে গিয়ে নিজের বুদ্ধির তারিফ নিজেই করলাম। সন্ধ্যার পর হোটেলে পৌঁছলাম, কয়েক রাত্রির অঘুমে প্রচণ্ড পরিশ্রান্ত শরীর, ভিত সন্ত্রস্ত মন ও জঠরের জ্বালা নিয়ে। অভুক্ত পেটে আধো আধো ঘুমে কেটে গেল রাত্রিটা।
তখনকার দিনে বাংলাদেশ থেকে বিদেশ যাত্রীরা মাত্র ২০ ডলার সাথে নিয়ে যেত পারত। আমার সাথে বাড়তি আরো ২০ ডলার ছিলো। সকাল হতে বুঝলাম পয়সা যতই খরচ হোক না কেন, কিছু একটা খেয়ে প্রাণ বাঁচাতে হবেই। হোটেল রুম থেকে বেরিয়ে নিচের রেস্তোরায় বসে বেছে বেছে সব থেকে কমদামী নাস্তাটাই আত্মতৃপ্তি করে খেয়ে রুমে ফিরে এসে দেখি – আরেক মুসীবত, দরজা যে খুলছে না! টানা টানি করলাম, ধাক্কা ধাক্কি করলাম, কোন কাজই হোল না। এদিক ওদিক চাইতে দেখতে পেলাম কালো রঙের উর্দি পরা বিরাট বপুর এক কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তি লিফট থেকে বেরিয়ে এসে আমার দিকে লক্ষ করে জোরে সরে বলছে, দরজা থেকে এক্ষণই সরে হাত তুলে দাড়াও। ওকে যতই বলি এটা আমার রুম, কে কার কথা শোনে। আমার কাছে রুমের চাবি দেখতে চাইল। রুমের চাবি? সে তো ভিতরে, সেটা যে সাথে নিয়ে বেরোতে হয় তাতো আমাকে কেও বলেনি। চুরি করতে এসেছি সন্দেহে আমাকে নজর বন্দী করে ধরে নিয়ে গেল ম্যানেজারের অফিস রুমে। সেখান থেকে একটা ডুপ্লিকেট চাবি জোগাড় করার পরই নিষ্কৃতি পেলাম।
নিউ ইয়র্ক শহরে দিনের প্রথম কাজ জাতিসঙ্ঘ এর নির্দিষ্ট অফিসে গিয়ে আমার প্রয়োজনীয় কাগজ পত্র ও প্রথম মাসের বৃত্তির টাকা সংগ্রহ করা। হোটেলের রিসেপসন থেকে জেনে নিলাম যে এখান থেকে বেরিয়ে হাতের বাম দিকে যেতে থাকলে বিল্ডিঙের নম্বর দেখতে দেখতে পেয়ে যাব - এখান থেকে মাইল খানেকের মত হয়ত হবে। বাসে করে যাওয়ার সাহস হোল না, যদি ঠিক স্টপে নামতে না পারি। ট্যাক্সি নিলাম না, আবার অন্য কোথাও যদি নিয়ে যায় – আর পকেটে যেটুকু পয়সা বাকি আছে সেটাতো খোয়াবার ভয় আছেই। যেতে যেতে ভাল করে লক্ষ করতে থাকলাম পথের দু’পাশের বিল্ডিংগুলিকে, যাতে ফিরে আসার সময় পথ চিনে ফিরে আসতে পারি। চোখে পড়ল এক বিশাল সাইন বোর্ড “পিপলস ড্রাগ স্টোর” – মুখস্থ করে নিলাম নামটা। ফিরার পথে এটা দেখলেই নিশ্চিত হব যে ঠিক পথেই ফিরছি।
নির্দিষ্ট অফিসে পৌঁছানোর পর পঞ্চাশোর্ধ এক ভারি মহিলা আমাকে তার সামনে বসিয়ে এক অল্প বয়স্ক তরুণীকে ডেকে বুঝিয়ে দিল আমার কাজ কর্মগুলিকে সমাধা করে দেয়ার জন্য। সেই তরুণীর টেবিলে বসে দুপুর পর্যন্ত কাজ কর্ম সারার পর সে জানাল যে লাঞ্চে পর সেদিন সে আর ফিরবে না – আমি যেন লাঞ্চ সেরে পূর্বোক্ত মহিলার কাছেই ফিরে যাই বাকি কাজ টুকু সমাধা করার জন্য। সেই মত আমি উক্ত মহিলার কাছে গিয়ে যেই বলেছিঃ
- ওই মহিলাটি আজ দুপুরের পর ফিরবেনা বলে আমাকে তোমার সাথে দেখা করতে বলেছে।
- কেন, তুমি কি করেছ ওর সাথে যে ও আর ফিরছেই না আজ?
আরে এই মহিলা বলে কি? ভয়ে লজ্জায় আমার শোচনীয় অবস্থা! কাঁদো কাঁদো স্বরে মিন মিন করে উত্তর দিলাম, সত্যিই আমি কিছু করি নাই, আমি জানি না উনি কেন ফিরবেন না। আমার এই করুণ অবস্থা দেখে মহিলাটির বোধহয় মায়া হোল, সে দুষ্ট হাসি হেসে বললঃ
- ওহে প্রেমিক-প্রবর (লাভার-বয়) ঘাবড়িয়ো না, – বসো আমি তোমার বন্দোবস্ত (ফিক্স) করছি।
ফিক্স করার কথা শুনে তো এবার আমার হাত পা আরও পেটের ভিতর ঢুকে যাওয়ার অবস্থা। যাই হোক শেষ পর্যন্ত তিনি আমার সব কাজ সমাধা (ফিক্স) করে আমাকে বিদায় দিলেন। সেটাই ছিল আমার আমেরিকানদের রসবোধ এর সাথে আমার প্রথম পরিচয় – যার সম্মুখীন হতে হয়েছে অহরহই পরের দুটি বছর।
কাজ শেষে এবার হোটেলে ফেরার পালা। ফিরতি পথে কিছু দুর যেতেই পিপলস ড্রাগ স্টোর এর সাইন বোর্ডটা চোখে পরতেই নিশ্চিত হলাম যে ঠিক পথেই ফিরছি। বেশ কিছু দূর হাঁটার পর মনে হোল যেন অনেক বেশী দূর হেটে ফেলেছি – এতক্ষণে তো হোটেলে পৌঁছে যাবার কথা – ভাবলাম আর একটু এগিয়ে দেখি। আরে! এযে দেখছি আরেটা পিপলস ড্রাগ স্টোর এর সাইন বোর্ড! পথে এক জনকে জিজ্ঞেস করে জানতে পাড়লাম যে আমি উল্টা পথে অনেকটা রাস্তা চলে এসেছি। পরে জেনেছি পিপলস ড্রাগ স্টোর এর দোকান আমেরিকার যত্র তত্র ছড়িয়ে রয়েছে। (১৯৯০ সালে যার নাম বদলিয়ে হয়েছে “সি ভি এস”) সেদিন বিকালে নিউইয়র্ক ছেড়ে ওয়াশিংটন ডিসি’র পথে রওনা দেই। এরপর কাজ উপলক্ষে ও ভ্রমণ এর জন্য অনেকবারই নিউইয়র্ক ফিরেছি আর এই শহরের বিচিত্র চরিত্র ও পরিবর্তনগুলো দেখে বিস্মিত হয়েছি। আমার কর্মজীবনের বেশির ভাগ সময়ই কেটেছে কনসালটেন্ট বা উপদেষ্টা হিসাবে। তবে কনসালটেন্ট এর কি কাজ বা এর সঠিক সংজ্ঞা কি তা উপলব্ধি করতে আমার অনেক সময় লেগেছে।
সেই নিউইয়র্ক শহরেই, তা বছর চল্লিশেক আগে হবে – দিন ভর কনফারেন্স শেষে হোটেলে সদল বলে ফিরছি নিউইয়র্কের তদানীন্তন স্বনাম ধন্য ফরটি-সেকেন্ড স্ট্রিট দিয়ে। রাস্তার পাশে সারি সারি দোকানের কাঁচের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে উগ্র মেকআপ করা মাঝ বয়েসি কিছু বিপুল বপুর মহিলা আমন্ত্রণ জানাচ্ছে দোকানের ভিতর এসে কনসালটেন্ট দের সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য – যারা কিনা আপনাদেরই যাবতীয় প্রয়োজন মিটাবার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে! স্বচ্ছ কাঁচের ভিতর দিয়ে লক্ষ করলে দেখা যায় অপেক্ষারত অতীব স্বল্পবসনা “কনসালটেন্ট”দের, বিশ্বের “প্রাচীনতম পেশার” শ্রমজীবী।
তারও বিশ বছর পর, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের তদানীন্তন চেয়ারম্যান মহোদয়, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক এর এক দল কনসালটেন্ট এর সাথে এক উত্তপ্ত বিরোধপূর্ণ মিটিংয়ে আমাদেরকে “বিশ্ব ব্যাংক ও পশ্চিমাদের বারবনিতা” বলে উল্লেখ করলেন। জানিনা চেয়ারম্যান মহোদয়ও আমাদের মতই ফরটি-সেকেন্ড স্ট্রিট থেকেই কনসালটেন্টদের এই অপর নামটি শুনে এসেছিলেন কিনা!
মোস্তফা আব্দুল্লাহ, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া
|