দি গোল্ডেন এইজ মোস্তফা আব্দুল্লাহ
গত ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি বার্ধক্য জনিত এক শারীরিক অসুবিধার কারণে দুই রাত্রির জন্য হাসপাতালে থাকতে হয়ে ছিল। অস্ত্রোপচারের পর সন্ধ্যায় কখন যে ওয়ার্ডে নিয়ে আসে সেটা অনুভূতি-নাসকের প্রভাবে আচ করতে পারিনি। সকালে ঘুম ভাঙতেই দেখি জোড়ায় জোড়ায় চোখ আমার দিকে তাকিয়ে আছে। নার্সদেরও দেখলাম কানাঘুষা ও এদিক ওদিক ছুটা ছুটি করতে। কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারলাম আমাকে নিয়ে আসা হয়েছে যে বৃন্দাবনে যেখানে বাকি সব রাধার মাঝে আমিই একমাত্র কৃষ্ণ। প্রাথমিক অস্বস্তি কাটিয়ে ওঠার পর বরফ গলানোর উদ্দেশে বলেই ফেললাম; "আপনাদের আমাকে নিয়ে শঙ্কার কোন কারণ নাই আমার শরীরের যে অঙ্গে অস্ত্রোপচার করা হয়েছে এবং আমাকে যেমন ভাবে পাইপ ও বৈদ্যুতিক তার দিয়ে জড়ানো হয়েছে তাতে আমার হাজার বাসনা থাকলেও আমি এক পাও কারো দিকে এগুতে পারবো না তাই আপনারা নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন"। এর পরের দুই দিন রাধা-কুঞ্জে বেশ ভালই কাটল। কৃষ্ণের সার্বক্ষণিক খোঁজ খবর নেয়ার জন্য রাধার আর অভাব হোল না। ওই কদিন অবশ্য আমার সহধর্মিণী ফোন করে আমার খবর নেয়ার আগে আমার গার্ল ফ্রেন্ডরা কেমন আছেন সেটাই জানতে চাইতেন।
হাসপাতালের রোগীদের সাথে দেখা সাক্ষাতের সময়ের পরিধিটা ছিল বেশ উদার সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৮টা পর্যন্ত। আমার বিছানার ঠিক উল্টো দিকের ষাটোর্ধ রোগিণীর সত্তর ছুঁই ছুঁই স্বামীটি সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ওয়ার্ডেই কাটিয়ে দিতেন। ভদ্রলোক বেশ সদালাপী, সত্তরের শুরুর দিকে আর্জেন্টিনা থেকে এদেশে এসে বসবাস শুরু করেন। বয়সের ভারে যদিও কিছুটা নূজ তবে যৌবনে যে খুবই সুঠাম দেহের অধিকারী ছিলেন তা তার অবয়ব দেখে আন্দাজ করা যায়। তাকে দেখতে অনেকটা বিখ্যাত অভিনেতা ওমর শরীফ এর মত মনে হচ্ছিল। পরে কথাচ্ছলে জানতে পারলাম তার ধমনীতে কিছুটা আরব রক্তেরও মিশ্রণ রয়েছে। এত দিন ছিলেন সিডনির পশ্চিমাঞ্চলে, গত কয়েক বছর হলো আরো পশ্চিমে - দুরে পাহাড়ের কোল ঘেঁসে আবাস গড়েছেন। ছেলে মেয়েরা প্রাপ্ত বয়স্ক হতে না হতেই যে যার পথে চলে গেছে। তাদের জায়গায় এখন আছে দুটি কুকুর ছানা ।
আমার আদি নিবাস বাংলাদেশ শুনে উনি যে বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধের কথা ও ওই অঞ্চলের ইতিহাস জানেন তা দিয়েই আমাদের আলাপ বেশ জমে উঠল। ভাগ্যক্রমে কিছু দিন আগে ফিনান্সিয়াল টাইমস এর প্রাক্তন ওয়ার্ল্ড ট্রেড এডিটর এলান বিইটির লেখা ফল্ল্স ইকোনমি বইটি আমার হস্তগত হয়েছিল। সেখানে আর্জেন্টিনা বিপুল পরিমাণ প্রাকৃতিক সম্পদের মালিক হওয়া সত্ত্বেও কেন পার্শ্ববর্তী দেশ আমেরিকার কাছা কাছিও যেতে পারল না তার বিশদ বিশ্লেষণ রয়েছে। সুযোগ হাত ছাড়া করলাম না আমারও জ্ঞান জাহির করতে। জমে উঠল আলাপ। ভদ্রলোক দুটি দিনের বেশির ভাগ সময়ই কাটালেন আমার সাথে আলাপ করে। একবার আমার মনে হয়েছিল সত্যিই কি উনি আমার সাথে আলাপের জন্য আলাপ করছিলেন না ঠিক আমার সামনা সামনি তার স্ত্রীর দিক থেকে আমার নজর অন্যত্র সরিয়ে রাখার জন্য আমাকে ব্যস্ত রাখছিলেন। পরে অবশ্য তার নায়ক সুলভ চেহারা ও গড়নের সাথে আমার নিজের তুলনা করে এটাকে আমার একটা স্বপ্ন বিলাস বা wishful thinking ছাড়া আর কিছু মনে হয় নাই।
যাক যে উদ্দেশে এই প্রসঙ্গের অবতারণা তাতেই যাওয়া যাক। আলাপ এক পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়াল বার্ধক্য নিয়ে। এই বার্ধক্যকে The Golden Age বলাতেই তার যত আপত্তি। এক মাত্র অবসর ভাতা ছাড়া এর মাঝে যে কি gold আছে তা উনি খুঁজেই পান না। অবশ্য আমার কিছু পরিচিত স্বগোত্রীয়দের কথাবার্তায় মনে হয় এটাই বোধ হয় খাটি সোনা। দুই এক জন তো প্রথম পরিচয়েই আমাকে জিজ্ঞাসা করেছেন পেনশন পাই কিনা। এবার সিডনি ফেরার পথে ঢাকা এয়ারপোর্টে বহু দিন পর ঢাকায় বসবাস রত কলেজ জীবনের এক সহপাঠীর সাথে দেখা। অস্ট্রেলিয়ায় থাকি শুনেই বললেন "ভালই তো আছ পেনশন পাচ্ছ তোমার আর চিন্তা কি"। এদের কেমন করে বোঝাই যে ৩৫ বছর আগে যখন অস্ট্রেলিয়া থেকে ফিরে যাই তখনও তার পেছনে কোনো অর্থনৈতিক কারণ ছিল না আর ৭ বছর আগে যখন ফিরে আসি তখনও পেনশনটাই মুখ্য উদ্দেশ্য না। জানি সেটা অরণ্য রোদন হবে - তাই চুপ করে থাকি।
কথা বলতে বলতে খেই হারিয়ে ফেলা - বার্ধক্য এর এই এক মহা দোষ। যাক আবার আসল কথায় ফিরে যাওয়া যাক। ভদ্রলোকের মতে বার্ধক্য এর অর্জন বলতে তো চোখের ছানি, নর বরে হাঁটু, রবিকে খাবি শোনা, বউকে শাশুড়ি মনে করে ভুল করা - আরো এমন কত কিছু। এর মধ্যে যে সোনা কোথায় সেটাই তার প্রশ্ন। প্রশ্নটা একেবারে অবান্তর নয় আবার এটাই যে শেষ কথা সেটাও হতে পারেনা। আমরা যারা গোল্ডেন এইজে পৌঁছে গেছি তাদের জন্যতো বটেই আর যারা এর দোরগোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছেন তাদেরও বোধ হয় এখন থেকেই প্রস্তুতি নেয়াটা খুবই সমীচীন হবে। আমাদের মন মানসিকতায় এদের নার্সিং হোম এ শেষ সময়টা অতিবাহিত করার কোনো বিকল্প উপায় বের করা যায় কিনা ভেবে দেখার এখনি মোক্ষম সময়। শুনেছি আমাদের উপমহাদেশেরই ভারতীয় এবং শ্রীলংকানরা এ বিষয়ে নিজেদেরকে সংগঠিত করে অনেকটা এগিয়ে গেছে এবং সরকারের কাছ থেকেও যথেষ্ট সমর্থন পাচ্ছে। আশা করি আমরাও হয়ত এর থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে কিছু একটা করার চেষ্টা তো করতে পারি।
তাই কিছু একটা শুরু করার আহ্বান জানিয়েই আজকের এই লেখাটা শেষ করছি আর তার সাথে বার্ধক্য নিয়ে মনীষীদের কিছু উক্তি ও আমার নিজের জীবন অভিজ্ঞতা থেকে কিছু সঞ্চয় সবার সাথে ভাগ করার অভিপ্রায় নিয়ে ইতি টানছি আজকের মত।
* Do not regret growing older. It is a privilege denied to many: Author Unknown
* Age is an issue of mind over matter. If you don't mind, it doesn't matter: Mark Twain
* Old minds are like old horses; you must exercise them if you wish to keep them in working order : John Adams
* If I'd known I was going to live this long, I'd have taken better care of myself: Eubie Blake
* Men are like wine - some turn to vinegar, but the best improve with age: Pope John XXIII
* Old age is like a plane flying through a storm. Once you're aboard, there's nothing you can do: Golda Meir
* Move it or lose it: Tittle of the exercise program for seniors at TVS.
* না-খেয়ে মানুষ যত না মরে, তার থেকেও বেশি মরে খেয়ে ।
* শরীরটাকে নাড়ান - নয়ত অঙ্গটাকে হারান
* শরীরটার খেয়াল রাখুন শরীর আপনার খেয়াল রাখবে
* "রেগে গেলেন - হেরে গেলেন" : মহাজাতক
* He whom we bring unto old age, We reverse him in creation (making him go back to weakness after strength). Have ye then no sense? : Quran, Sura Ya-Sin 36:68
মোস্তফা আব্দুল্লাহ, সিডনি
|