ফার্স্ট ক্লাস সিটিজেন মোস্তফা আব্দুল্লাহ
আমার বড় কন্যার স্কুল জীবনের এক বন্ধু ঢাকা থেকে সিডনী বেড়াতে এসেছিল কিছু দিন আগে। সেই শিশু বয়স থেকেই আমাদের কন্যাদ্বয়ের সহপাঠীদের আমাদের বাড়িতে যত্রতত্র যাওয়া আসা আর সেই সুবাদে ওদের প্রায় সবার সাথেই আমাদেরও একটা আদর আবদারের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। আর তাই ওদের কেও কখনো বেড়াতে আসলে পারত পক্ষে আমাদের সাথে দেখা না করে যায় না। এ ক্ষেত্রেও বন্ধুটিকে নিয়ে যখন আমার কন্যা আমাদের বাড়ীর সামনে এসে পৌঁছল তখন আমি ঘর্মাক্ত কলবরে যার পর নাই কসরত করে বাড়ীর সামনের ঘাস কাটার চেষ্টায় ব্যস্ত। ওদেরকে ভিতরে যেতে বলে ঘাস কাটায় আপাত: বিরতি দিয়ে ওদের সাথে কথা বলার জন্য ঘড়ে এসে বসলাম। কুশলাদি বিনিময় ও আনুষঙ্গিক আলাপ আলোচনার এক পর্যায়ে জিজ্ঞেস করলাম, “শুনেছিলাম তুমি নাকি বিদেশে এসে স্থায়ী ভাবে বসবাসের কথা ভাবছিলে, সেটার কি হোল?” প্রশ্নটা শুনে আমার কন্যা ও তার বন্ধু মুখ চাওয়া চাওই করে হেসে উঠলো। কন্যাটি জানালো যে এই কথাই নাকি তাদের মধ্যে হচ্ছিলো। তবে ঘড়ে ঢুকবার সময় বাগানে ঘাস কাটা রত অবস্থায় আমার করুণ অবস্থা দেখে ও নাকি বিদেশে এসে স্থায়ী ভাবে বসবাসের কথাটা দ্বিতীয় বার আরও ভালো ভাবে ভেবে দেখার কথা ভাবছে! তাইতো? বিষয়টা তো নির্ঘাত দ্বিতীয় কেন – বার বার ভেবে দেখার দাবীদার। এমন ভাবে তো কখনো ভেবে দেখি নাই! এই শেষ বয়সে আবার বিদেশে ফিরে এসে স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করাটা কি ঠিক হোল? দেশে আর যাই হোক, এটা নিশ্চিত - যে ঘাস কাটতে হোতো না। তা ঠিক, তবে ঘাস না কাটতে হোলেও এমন অনেক কিছুই করতে হতো যা এখানে কখনো করতে হয় না। যেমন ধরুন আমার আপনার মত যারা নিরীহ গোবেচারা প্রাণী, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্তর অতিক্রম করা ও কর্ম জীবনের প্রতিষ্ঠাও একেবারে ফেলে দেয়ার নয়; তাদেরকেও মাঝে মধ্যে দ্বারস্থ হতে হয় ইউনিয়ন পরিষদ বা তদ্রূপ কোন প্রতিষ্ঠানের কর্ম কর্তার কাছে একটি সুচরিত্র বা সুনাগরিক বা অনুরূপ কোন সনদের জন্য। কখনো ভেবে দেখেছেন কি যারা এই সনদ দাতা তাদের বেশির ভাগেরই নিজের “চরিত্র” কোন স্তরের ও কোন ধরনের সবরকম যোগ্যতার উচ্চমার্গে আরোহণ করতে পারার জন্য এরা সনদ দাতা হতে পেরেছেন? যে নিরীহ লোকটি দিনের পর দিন মধ্যপ্রাচ্যের তপ্ত রোদের নিচে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে উপার্জনের প্রায় সবটুকুই দেশে পাঠিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিসার্ভ বাড়িয়ে চলেছে – ঢাকা এয়ারপোর্ট থেকে বের হবার সাথে সাথে অপেক্ষমাণ আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কতিপয় হায়েনার মত ঝাঁপিয়ে পড়ে তার ওপর বখরার দাবীতে – আর প্রতীবাদ করলে তাদের গাল দেয় “বিদেশের কামলা” খাটা মজুর বলে। একেই বোধ হয় বলে “চোরের মায়ের বড় গলা”!
যখন আমরা নিজেদের সাত পুরুষের ভিটা থেকে এই পরভূমে ফিরে আসি - আর ইমিগ্রেশন অফিসার হাসি মুখে অভিবাদন করে বলেন “ওয়েল-কাম ব্যাক হোম”! তখন কি একে অদৃষ্টের এক পরিহাস বলে মনে হয় না? এদেশের পুলিশরা আমাদের মালামাল নিয়ে লুটেরাদের মত টানা হেঁচড়া করেনা, কামলা বলে গাল দেয় না। একটা সনদের জন্য এমন সব লোকদের দ্বারস্থ হতে হয় না, যাদের অনেক কেই আর যাই হোক – নিজ সন্তানাদির কাছে সুনাগরিক বা সুচরিত্রের মানুষের উপমা হিসাবে দাড় করানো যায় না। দলীয় পৃষ্ঠপোষকতার জোরে উন্মুক্ত জন সভায় বোমা মেরে মানুষ হত্যা করে জজ মিয়া নাটক সাজিয়ে প্রকৃত অপরাধীদের আইনের ধরা ছোঁয়ার বাইরে রাখা যায় না – প্রমাণাদি থাকা সত্ত্বেও দিন দুপুরে জনসম্মুখে প্রতিপক্ষকে নিপীড়ন ও হত্যা করে রাজনৈতিক ছত্র ছায়ায় পার পেয়ে যাওয়া যায় না। যুগের পর যুগ চলে যায় ধর্ষণ, গুম ও হত্যা রহস্যের কোন কূল কিনারা হয় না। যেখানে যার লাইনে দাঁড়ানোর কথা সেখানেই সে দাঁড়িয়ে থাকে - কাওকে লাইন ডিঙ্গিয়ে কোন “নেতা” আগে চলে যায় না। ভোটের সময় এলে ভোট প্রার্থী অন্য দশজনের কাছে যেমন ভাবে ভোট প্রার্থনা করে তেমনি করে আমার আপনার কাছেও করে – কখনো ভয় দেখিয়ে বা হুমকি ধমকি দিয়ে চায় না। আমার ভোটটা যে আমাকেই দিতে হবে বা পারব সেটা নিশ্চিত জানি।
এ কেমন কথা? আমরা নিজ দেশ ছেড়ে ভিন দেশে “থার্ড-ক্লাস” সিটিজেন হয়ে বাস করছি – তার পরেও এরা আমাদের জাতি, ধর্ম, ভাষা, বর্ণ ও রাজনীতির ভিন্নতা থাকলেও সবাইকে এক কাতারে দেখে “মানুষের সম্মান” দিয়ে যাচ্ছে? আমার নাগরিক অধিকার ও সুবিধাদি আমি লিবারেল না লেবার না গ্রিন - না দল-পাগল বা দল-অন্ধ, তার ওপর নির্ভর করছে না! ব্যাপারটা কেমন সন্দেহ সন্দেহ ঠেকছে না? মনে হয় এদের বোধ হয় অন্য কোন মতলব আছে – তা না হলে আমরা নিজ দেশে “ফার্স্ট-ক্লাস” সিটিজেন হয়েও এমন ব্যাবহার পাই না কেন? এত কিছুর পরও দেশের জন্য মন কাঁদে – ফিরে যেতে চায় বার বার। কেও কেও ফিরেও যায়, আবার অনেকেরই ফিরে যাওয়া হয়ে উঠেনা। অনেকেরই এই ফিরে না যেতে পারার কারণ বোধ হয় ওই আবার “ফার্স্ট-ক্লাস” সিটিজেন হওয়ার ভয়!
পড়াশুনা ও কর্ম উপলক্ষে, সীমিত হোলেও, বেশ কিছু দেশ বিদেশ ঘোরার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। সেই সুবাদেই বলছি যে বাংলাভাষীদের ছাড়া অন্যদের মাঝে এই ফাস্ট/সেকেন্ড/থার্ড ক্লাস সিটিজেন কথাটার এত ব্যাপক প্রচলন আছে বলে আমার জানা নাই। এই নাগরিক শ্রেণীবিন্যাসটা তাহলে কি? এর কি আদৌ কোনও অস্তিত্ব আছে বর্তমান পৃথিবীর কোথাও? অনেক খোঁজাখুঁজি করেও এ ধরনের কোনও নাগরিক শ্রেণিবিন্যাসের অস্তিত্ব পৃথিবীর কোন দেশেই আছে বলে আমি খুঁজে পাই নাই। তার পরেও আমি যে বিদেশে একজন “থার্ড ক্লাস সিটিজেন” হিসাবে বসবাস করি এই কথাটা প্রায়ই আমার কিছু বিজ্ঞ বন্ধু জনদের কাছ থেকে শুনতে হয়। বিশেষ করে একজন যিনি কর্ম জীবনে কোনও এক কর্পোরেশনের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসাবে অবসর নিয়েছেন - তার আপসোসের অন্ত নেই আমার জন্য। সময়ে সুযোগে আমাকে জানাতে ভুলেন না যে তিনি চাইলেই বিদেশে বসবাস করতে পারতেন – তবে “থার্ড ক্লাস সিটিজেন” হিসাবে তা কোনও দিনই তিনি করতে চান নাই। তার কথায় কখনো কখনো কিছুটা হীনমন্যতাতেও ভুগি – তবে কি এই শেষ বয়েসে বিদেশে এসে ভুল করে ফেললাম? প্রতিবারের মত এবারও যখন দেশে গিয়ে বন্ধুদের সাথে আড্ডায় বসেছি, আমার সেই অবসর প্রাপ্ত চেয়ারম্যান বন্ধু পাশে এসে বসে আস্তে আস্তে বললেন “দোস্ত তুইই বুদ্ধিমানের কাজ করেছিস, সময় ও সুযোগ থাকতে কেন যে বিদেশ চলে গেলাম না”। হঠাৎ ভূত দেখার মত চমকে উঠলাম – এ দেখি ভূতের মুখে রাম নাম। হঠাৎ করে প্রাক্তন চেয়ারম্যান মহোদয়ের ফার্স্ট ক্লাস সিটিজেন থেকে থার্ড ক্লাস সিটিজেন হওয়ার বাসনা কেন হলো বোধগম্য হলো না! কদিন আগে তিনি গিয়েছিলেন তার প্রাক্তন কর্মস্থলে নিজের অবসরের ফাইল পত্রের কিছুটা সুরাহা ও তদবিরের তাগিদে। ডিরেক্টর অ্যাডমিনিস্ট্রেশন এর অফিসে ঢোকা মাত্র তার প্রাক্তন অধস্তন কর্মকর্তা ডিরেক্টর মহোদয় যারপরনাই আদব কায়দা ও সম্মানের সাথে ওনাকে তার সামনের চারটি চেয়ারের একটিতে বসার আমন্ত্রণ জানিয়ে পিয়নকে চা আনার তাগিদ দেন। পিয়নকে সাবধান করে দেন যেন নিশ্চিত ভাবে ভি আই পি কাপে (ফার্স্ট ক্লাস?) চেয়ারম্যান সাহেবকে চা দেওয়া হয়। চেয়ারম্যান মহোদয় চেয়ারে বসে যেই না কথা বলা শুরু করেছেন অমনি চারজন যুবক কোন রকম অনুমতি বা আমন্ত্রণের তোয়াক্কা না করেই ঘরে ঢুকে তিনটি খালি চেয়ারে বসে পড়ল ও চতুর্থ জন চেয়ারম্যান মহোদয়ের চেয়ারের হেলান দেয়ার জায়গাটিতে হাত রেখে তার পাশে দাঁড়িয়ে রইলো। অবস্থা দৃষ্টে মনে হলো নির্ঘাত এই যুবকরা ক্ষমতাসীন দলের কোনও পাণ্ডা। এমতাবস্থায় ডিরেক্টর সাহেব চেয়ারম্যান সাহেবকে বিনীত অনুরোধ করলেন চেয়ারটা ছেড়ে দিয়ে পাশেই একান্ত সচিবের কক্ষে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার জন্য! বোঝা গেল চেয়ারম্যান সাহেবের জন্য এটা মেনে নেওয়া ছিল বেশ কষ্টকর – অবসরের কারণে “ফার্স্ট ক্লাস সিটিজেন” থেকে “থার্ড ক্লাস সিটিজেন”, এ রকম পদাবনতি? এ কেমন কথা? বন্ধুর জন্য কিছুটা কষ্ট বোধ হলেও নিজের এই বিদেশে আসার ব্যাপারে আর আমার তেমন গ্লানি বোধ রইলো না। যদি বা থার্ডক্লাশ সিটিজেন হয়েও থাকি তবুও এই থার্ডক্লাশ থেকে আমার আর পদাবনতির কোনও সম্ভাবনা নাই। কথার কথাই ধরা যাক; মনে করি এদেশে আমার কোনও ব্যক্তিগত কাজে কোনও সরকারী বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে গেছি – অন্য আর দশ জনের মত আমাকেও লাইনেই দাঁড়াতে হবে – যেমন দাঁড়াতে হবে স্বয়ং প্রধান মন্ত্রীকেও, যদি তিনি কোনও ব্যক্তিগত কাজে এসে থাকেন। এ দেশে যে একেবারেই বৈষম্য বা নিয়মের একটু আধটু এদিক ওদিক হয় না - তাও না। তবে তাকে অনুৎসাহিত করে তার নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিকারের (check & balance) জন্য রয়েছে কার্যকর আইন ও তার প্রয়োগ। এই উপমাটা দিয়ে নাগরিকত্ব যে ব্যক্তি বিশেষ বা সময়ের হেরফেরে ওঠা নামা করে না তা সম্ভবত আমার বন্ধুকে বোঝাতে পেরেছিলাম। এ দিক থেকে অবশ্য আমাদের প্রিয় জন্মভূমির কথা ভিন্ন - যখন যারা ক্ষমতায় থাকেন, তখন তারা ও তাদের অন্ধ অনুরক্ত ও সুযোগ অন্বেষী চাটুকাররা রাতারাতি বনে জান ফার্স্ট ক্লাস সিটিজেন আর এর বাইরে যে বিশাল জনগোষ্ঠী - তাদের যে আদৌ কোন ক্লাস আছে কিনা তা একমাত্র বিধাতাই বলতে পারেন।
(বেশ কিছুদিন পূর্বে ‘থার্ড ক্লাস সিটিজেন’ শিরোনামে আমার অনুরূপ একটি লেখা প্রকাশিত হয়েছিল, এ লেখাটি তারি একটি ভিন্ন সংস্করণ)
মোস্তফা আব্দুল্লাহ, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া
|