একজন ব্যতিক্রমী মানুষ মোস্তফা আব্দুল্লাহ
সম্ভবত মাঝ রাতের কিছুটা পর – একটা বিকট আওয়াজে ঘুম ভাঙতেই হুড়মুড় করে বিছানা থেকে উঠতে গিয়ে খাট থেকে মাটিতেই পড়ে গেলাম। উঠতে যাব, আবারো পর পর ঘড় বাড়ি কাঁপানো প্রচণ্ড বিস্ফোরণ এর শব্দে আরও গুটি সুটি মেরে খাটের নিচে লুকাতে গেলাম। এর পর কিছুক্ষণ শুন-শান নীরবতা। তার পর কাছা কাছি মিরপুর রোড এর দিক থেকে শোনা গেল ভারি যান বাহনের চলা চলের শব্দ। সময়টা ১৯৭৫ সালের অগাস্ট মাস, স্থান ধানমণ্ডি ৩২ নং সড়কের উল্টো দিকে, কলাবাগান। ভোর হতেই এখানে সেখানে যে যার চৌহুদ্দির মধ্যে থেকেই জানতে বুঝতে চেষ্টা করছে – ব্যাপারটা কি ঘটে গেল। গলির মাথায় জটলা দেখে সাহস করে এগিয়ে গিয়ে জানতে পাড়লাম যে গত রাতে একদল বিদ্রোহী সামরিক বাহিনীর সদস্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর বাড়ীতে আক্রমণ করে তাকে সহ তার পরিবারের প্রায় সমস্ত সদস্যকেই হত্যা করেছে। সকাল হতেই সমগ্র দেশ স্তম্ভিত হয়ে সে খবর জানতে পারল। সারা দেশ জুড়ে এক শ্বাসরুদ্ধকর ও অনিশ্চিত পরিস্থিতি।
সে সপ্তাহেই জাতিসঙ্ঘ এর অর্থায়নে, আমার তদানীন্তন কর্মস্থল সেন্সাস কমিশন হতে উন্নতর প্রশিক্ষণের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার কথা। সেন্সাস কমিশনে বছর দুয়েকের মত চাকুরীরত অবস্থায় উক্ত প্রশিক্ষণের জন্য আমাকে মনোনীত করা হয়। সেখানে আমার সমকক্ষ পদমর্যাদার অন্য তিনজন অ্যাসিস্ট্যান্ট সেন্সাস কমিশনার এর মধ্যে আমিই ছিলাম সর্বকনিষ্ঠ। তদুপরি সর্বাপেক্ষা উপযুক্ত প্রার্থী বিবেচনায় আমিই মনোনয়ন পাওয়ায় তা অন্যদের চাপা ঈর্ষার কারণ হয়ে দাড়ায়। এ নিয়ে আমি ওই সময়ে অফিসে কিছুটা বিরূপ পরিস্থিতির মধ্যেই সময় পার করে চলছিলাম। আর ঠিক সেই ক্ষণেই উদ্বুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে আমার বিদেশ যাত্রাটি কিছুটা অনিশ্চয়তার মুখো মুখী হয়ে যেতে পাড়ে বলে আমার শঙ্কা হচ্ছিল।
দিন দুয়েক পর পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি ঘটলে আমি অফিসে গিয়ে দেখতে পাই যে সেদিনও অফিসে খুব বেশি একটা কেও আসে নাই। চিফ সেন্সাস কমিশনার জনাব কাজী বাহাউদ্দিন আহাম্মদের এর কক্ষে দেখা করতে গিয়ে কথা প্রসঙ্গে জানতে চাইলাম যে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আমার বিদেশ যাওয়ার কোন ব্যাঘাত ঘটবে কিনা? তিনি কিছুটা ভেবে আমার দিকে সরা সরি চেয়ে জবাব দিলেন; ব্যাঘাত ঘটবারই সম্ভাবনা বেশি। কারণ স্বরূপ উল্লেখ করলেন যে উদ্বুদ্ধ পরিস্থিতিতে বর্তমানে দেশে কোন সক্রিয় “সরকার” নাই – সব কিছুই একটা স্থবির অবস্থায় বিরাজমান। যতক্ষণ পর্যন্ত সরকারের কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠা না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত সব কিছুই স্থিতিশীল অবস্থায় থাকার কথা।
- এই পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক আইন অনুগ কার্যক্রম অনুসারে আপনাকে বিদেশ যাওয়ার অনুমতি দেয়ার কথা না – তবে আপনার দেশ ত্যাগে বাধা দেয়া বা না দেয়ার মধ্যে কোনটা যে সঠিক আর কোনটা বেঠিক সিদ্ধান্ত, সেটা এই মুহূর্তে আমি নিশ্চিত করে বলতে পারছি না।
ওনার কথা খুব একটা আশাব্যঞ্জক বলে মনে হোল না, হয়ত বা আমার আর বিদেশে যাওয়া হয়ে উঠবে না আর সেই সাথে আমেরিকায় প্রশিক্ষণ ও ভবিষ্যৎ সোনালী দিনের স্বপ্ন গুলি মিইয়ে যেতে থাকল। বাহাউদ্দিন সাহেবের কাছে অনুনয় বিনিনয় করতে গিয়ে গলা থেকে স্বর নড়ল না। আমার আশা নিরাশার চেহারাটার দিকে চেয়ে তিনি আবার বললেনঃ
- আপনার এই বিদেশ না যাওয়াতে কারো কিছু একটা বিশেষ লাভ হবে বলে আমার মনে হয় না। পক্ষান্তরে, আপনি যদি বিদেশে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ফিরে আসতে পারেন তা হলে দেশের ও আপনার, দুজনেরই লাভ হওয়ার সম্ভাবনা বলেই আমার ধারনা।
তার পর খুবই ক্ষীণ কণ্ঠে বললেনঃ
- বর্তমান পরিস্থিতিতে আমার পক্ষে আপনাকে বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দেয়া সম্ভব নয়, তবে আপনি যদি আমার সাথে না দেখা করে থাকেন, তাহলে তো আমার জানারই কথা নয় যে আপনি ইতিমধ্যে বিদেশে চলে গেছেন, কি যান নাই!
তার পর আরও ক্ষীণ কণ্ঠে প্রস্তাব করলেন যে আমি যেন এই মুহূর্তে অফিস থেকে বেরিয়ে যাই এবং কাওকে না জানাই যে তার সাথে আমার দেখা হয়েছে। স্মিত হাস্যে আরও বললেনঃ
- এখন আপনি কি সিদ্ধান্ত নেবেন, সেটা একান্তই আপনার বিষয়। তবে আমার ধারনা, আপনি যে সিদ্ধান্তই নেন না কেন তাতে যে সরকারের তেমন কোন একটা বিশেষ বিপর্যয় ঘটবে, তা আমার মনে হয় না!
আমি অফিস থেকে বেরিয়ে দেশ থেকে প্রথম বিদেশ গামী ফ্লাইটে আমেরিকার পথে রওনা দেই। কার্যত আমি কোন আইন ভঙ্গ করি নাই – আমার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা অবগত নন(?) যে ইতিমধ্যে আমি বিদেশে চলে গেছি কিনা, আর আমাকে তো বাংলাদেশ সরকার, সরকারী কর্মকর্তা হিসাবে বিদেশে যাওয়ার ছাড়পত্র ও টিকেট দিয়েই রেখেছিলেন।
বছর দুয়েক পর যখন বিদেশ থেকে ফিরে আসি ততদিনে জনাব বাহাউদ্দিন সম্ভবত অবসরে চলে গেছেন। ইচ্ছা থাকলেও তার সাথে সাক্ষাত হয়ে উঠে নাই। অনেক বার ভেবেছি দেখা হলে তাকে বলব কেমন করে তার বিচক্ষণতা আমার জীবনকে সমৃদ্ধ করেছে। অনেকদিন পর হঠাৎ করেই সেই সুযোগ হয়ে উঠল একদিন গুলশান ১ নম্বর মার্কেটে। পরিচয় দিয়ে সেদিনকার কথা মনে করিয়ে দিয়ে কৃতজ্ঞতা জানাতে তিনি এক গাল হেসে বললেনঃ
- আপনি যার জন্য উপযুক্ত ছিলেন, আপনি নিজে থেকেই সেটা অর্জন করেছিলেন। এর মধ্যে আমার করার বা না করার কিছু ছিল না!
আমি তার দিকে চেয়ে মনে মনে ভাবি, আমি কি ঠিক ঠিকই একজন প্রাক্তন ঊর্ধ্বতন সরকারী আমলার সামনে দাড়িয়ে কথা বলছি? এই ধরনের মানবিক মূল্যবোধ ও মনোবৃত্তির মানুষের সংখ্যা দিন দিনই বিলুপ্ত প্রায় হতে চলেছে। আর তার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে উত্তর উত্তর বৃদ্ধি প্রাপ্ত প্রতি নিয়ত বিশৃঙ্খলা, অনিয়ম ও অসততায় ভরা সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জনজীবন। দিন দিনই অর্থ ও অনৈতিক পেশী শক্তির কাছে রাষ্ট্রীয় যন্ত্র জিম্মি হয়ে “দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন” এর পরিবর্তে তার উল্টোটারই বেড়ে চলছে জয় জয়কার।
অন্য যে কেও সম্ভবত সরকারী আইন কানুন ও বিধি বিধানের বেড়া জালের আওতায় আমার সেদিনের বিদেশ যাত্রা বন্ধ করে দিত। তিনি তা না করে ওই সব কিছুর ঊর্ধ্বে উঠে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের সার্বিক কল্যাণের কথা ভেবে আমার বিদেশ যাত্রার প্রতিবন্ধক হয়ে উঠেন নাই। এ ধরনের মানুষরা সর্বদাই সচেষ্ট থাকেন অন্যকে কি করে ঠেলে ওপরের দিকে ওঠানো যায়, টেনে নিচে নামানো নয়।
জীবনের বহু ক্ষেত্রেই এমন অনেকের কাছ থেকেই এমন ধরনের সাহায্য সহযোগিতা ও অনুকম্পা পেয়েছি। কখনো কখনো একে সম-স্থানিকতা বা কো-ইনসিডেন্স বলে ভেবেছি – সঠিক সময়ে সঠিক জায়গায় উপস্থিত ছিলাম বলেই হয়ত। আবার ভেবে কূল কিনারা করতে না পেরে একে একরকম ঐশ্বরিক আশীর্বাদ বলেও মেনে নিয়েছি। আগামীতে এ ধরনের ঐশ্বরিক আশীর্বাদ বা হস্তক্ষেপ নিয়ে আরও কিছু লেখার ইচ্ছা রইল।
আমার সৌভাগ্য, কয়েক বৎসর পূর্বে দেশে বেড়াতে গিয়ে কাজী বাহাউদ্দিন আহম্মদের সাথে দেখা করার সুযোগ আমার হয়েছিল। খুবই অসুস্থ ও দুর্বল অবস্থায় বিছানায় শয্যাশায়ী ছিলেন। আমাকে দেখতে পেয়ে তিনি আনন্দিত হয়েছিলেন – আমি নিজেকেও খুব সৌভাগ্যবান বলে মনে করেছি। তাকে আবার আমার প্রতি তার বিচক্ষণতার কথা স্মরণ করিয়ে দিতেই তিনি বললেনঃ
- আমার এই অন্তিম কালে, আপনার আমাকে দেখতে আসা যে আমার জন্য আরও বহুগুণ পাওয়া। আমার সর্ব সময়ের আশীর্বাদ রইল আপনার ও আপনার পরিবারের সুখ শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য।
শ্রদ্ধেয় কাজী বাহাউদ্দিন আহাম্মদ, আপনি যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন।
মোস্তফা আব্দুল্লাহ, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া
|