এক দূর দ্বীপ বাসিনীর মায়ার বন্ধন মোস্তফা আব্দুল্লাহ
দূর দ্বীপ বাসিনীর কোলে তাজিন | সাত সমুদ্দুর তের নদী পাড়ি দিয়ে রাজকন্যা তার রাজপুত্তুরের সাথে ঘড় করতে এলো ১৯৭৮ সনের শুরুর দিকে। আমারা টোনা-টুনি আমাদের প্রথম সংসার পাতলাম সিডনীর পূর্বাঞ্চল সমুদ্র ঘেঁষা রেন্ডউইকে – আমার অস্ট্রেলিয়া জীবনের প্রথম দিনের আশ্রয় স্থল, আলম ভাই ভাবির ফ্লাটটার ঠিক উল্টো দিকের ফ্লাটটাতে। আলম ভাইদের প্রথম সন্তান নন্দিতের তখনো ভালো করে কথা ফুটে নাই। পাশাপাশি দু’ঘর মিলিয়ে ছিল আমাদের পাঁচ জনের সুখের সংসার। পাঁচ জনের সুখের সংসার বলছি এই কারণে যে বছর তিনেক এর মাথায় যখন এই পাঁচ জনের সংসার থেকে আমারা দুইজন দেশে ফিরে যাই – সংসারের বাকি তিনজনও আর একা একা থাকতে না পেরে ছয় মাসের মাথাতেই দেশে ফিরে যায়!
আনন্দ সুখের মাঝ দিয়ে দিনগুলি যেতে যেতে বছর দুয়েকের মাথায় আমাদের ঘড়ের প্রথম সন্তানের আগমনী বার্তা এলো। এর মাঝে আমার মাও মাস ছয়েকের জন্য আমাদের কাছে ঘুরে গেলেন। আমদের একান্ত ইচ্ছা ছিল যে তিনি আমাদের সাথে থেকে যান। কিন্তু তখনকার সিডনীর কথা ভাবলে তার মত বয়স্ক একজন মহিলা, যিনি কিনা সরাটি জীবন আত্মীয় স্বজন পরিবেষ্টিত হয়ে একান্তই একটা নিজস্ব ভুবনে বাস করেছেন, এখানে থাকাটা তার জন্য হয়ে যেত কারাবাসের চেয়েও কঠিন। তিনি ফিরে গেলেন এই বলে আমাদের সান্ত্বনা দিয়ে যে, আমি তো মাঝে মধ্যে আসবই আর তোমরাও কিছুটা গুছিয়ে নিয়ে বছর গেলেই দেশে যাবে, আসবে।
প্রায়ই ছুটির দিনগুলিতে অলস সময় কাটানোর জন্য দুজনে বসতাম ফ্লাট বাড়িটির সামনের চত্বরে - সময় কেটে যেত মৃদু আলাপচারিতায় ও সামনের রাস্তার লোক জনের আনাগোনা দেখতে দেখতে। আমাদের লাগোয়া ফ্লাটে থাকতেন এক বৃদ্ধা মহিলা, একাই। মাঝে মাঝে ফিরতেন বাজার হাতে নিয়ে হেটে হেটে। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে বেশ কষ্ট হত। প্রথম দিন আমি উঠে গিয়ে তার হাতে থাকা ঝোলাটিকে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে সাহায্য করতে চাইলে সে কিছুটা ঘাবড়েই গিয়েছিল। তারপর থেকে এটা একটা নিত্ত নৈমিত্তিক ব্যাপারে দাঁড়িয়ে গেল। সিঁড়ি দিয়ে উঠে মাঝে মাঝে আমাদের সাথে বসে কিছুক্ষণ গল্পও করে যেত। গল্পে গল্পে জানতে পারলাম নিঃসন্তান হিসাবে বহু দিন আগেই বিধবা হয়েছেন। নিকট আত্মীয় বলতে রয়েছে এক ভগ্নি-পুত্র, কাছাকাছি থাকে, কুঁজিতে – কালে ভদ্রে খোজ খবর নিতে আসে।
সময়ের সাথে সাথে সখ্যতা বাড়তে থাকে। আমি অফিসে চলে গেলে আমার স্ত্রী একা থাকে বলে তিনি যেতে আসতে তার খোজ নিতে থাকেন। আমার স্ত্রীও কিছু ভালো মন্দ রান্না হলে তাকে দিতে গেলে তার চক্ষু অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠে। এমনি করে কিছুদিন যাওয়ার পর আমার স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার পর মহিলাটি নিজ থেকেই স্বঘোষিত অভিভাবক হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেললেন। এমনকি আমার স্ত্রী যখন একা থাকেন তখন কেও দরজায় করা নাড়লেও তার দরজা খোলা মানা, যতক্ষণ না তিনি তার দরজা খুলে এসে দেখবেন কে দরজায় দাড়িয়ে! সন্তান প্রসবের সময় ঘনিয়ে আসতেই তিনি আমাদেরকে বার বার স্মরণ করিয়ে দেন যে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময় তাকে যেন নিশ্চিত জানিয়ে নেয়া হয় এবং সেটা যদি গভীর রাতেও হয়, তবুও।
আর ঘটনাটা ঘটল মাঝ রাতেই। পাশের ফ্লাটে থাকা আলম ভাই এর গাড়ি করে হাসপাতালে যাওয়ার সময় ভাবিকে বলে গেলাম এত রাতে তাকে আর জাগিয়ে কাজ নাই – আপনি সকালে উঠেই ওনাকে বলে দিয়েন। ভাবী সকালে খবরটা জানাতেই মহিলাটি তড়িঘড়ি করে গির্জায় চলে যাওয়ার সময় বলে গেলেন সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর যেন তাকে খবর দেয়া হয় – তার পরই তিনি গির্জা থেকে ফিরবেন! তার কথা মত গির্জায় গিয়ে তাকে খবরটা জানানোর পরই তিনি আমার সাথে ঘরে ফিরে আসলেন।
দিন কয়েক পর আমাদের কন্যাকে নিয়ে বাড়ি ফিরে ঘরে ঢোকার পথে তিনি ওকে প্রথম কোলে নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে চোখ বন্ধ করে মনে মনে প্রার্থনা করলেন। তার পর নিজের ঘরে গিয়ে এক গাদা পোশাক নিয়ে এলেন ওর জন্য। প্রতিটা পোশাকই নিজের হাতে সেলাই করা! এর কিছুদিন পর আমার মেয়েকে কোলে নিয়ে একটা ছবি তুলে তা বাঁধিয়ে টেলিভিশন এর ওপর রেখে বললেন যে আমি যখন আমার গ্র্যান্ড ডটারকে সামনাসামনি দেখতে পাব না তখন ওই ছবিটির দিকে তাকিয়ে থাকব।
দেখতে দেখতে মাস তিনেক পেরিয়ে গেল। যতই মেয়ের মুখের দিকে দেখি ততই আমার মায়ের মুখটা ভেসে আসে; আহা না জানি কত আশা করে বসে আছেন তার এক মাত্র সন্তানের এক মাত্র মেয়েটিকে দেখার জন্য। স্ত্রীকে কথাটা জানাতেই সে জানালো যে এক মাত্র নাতনিটি এক দেশে বড় হয়ে উঠবে আর দাদি থাকবে আরেক দেশে, কেউ কাউকে চিনবে না জানবে না, সেটা হতে পারে না। চল আমারা দেশে ফিরে যাই। যেই বলা সেই কাজ – এক মাসের মধ্যে দেশে ফিরে আসার প্রস্তুতি সম্পন্ন। এর মাঝে একদিন ওই মহিলাকে আমাদের সিদ্ধান্তটা জানাতেই তিনি কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন; তার পর আস্তে আস্তে বলেন; চলেই যদি যাবে তবে আমার সাথে কেনই বা সখ্যতা গড়লে – কেনই বা এত মায়া জাগালে। বাড়ি ফিরে যাওয়ার আনন্দে দেশের এক মাতামহের কথা ভাবতে গিয়ে এখানেও যে অন্য আরও একজন “দূর দ্বীপ বাসিনী” মাতামহ তার স্নেহের মায়ার জালে আমাদের কন্যাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছিল তার কথা কেমন করেই বা ভুলে গেলাম!
বিদায়ের দিন আবারো আমাদের কন্যাকে কোলে নিয়ে চোখ বন্ধ করে অনেকক্ষণ ধরে প্রার্থনা করল। হাসি মুখে বলল; “তোমাদের যাবার বেলায় আমি এখানে থাকতে চাই না। আমি এখন গির্জায় গিয়ে মোম বাতি জ্বালিয়ে প্রার্থনায় বসবো বিধাতা যাতে মঙ্গল মত তোমাদেরকে তোমাদের গন্তব্য স্থলে পৌঁছে দেন। ঈশ্বর তোমাদের মঙ্গল করুন।“
বহু কষ্টে কান্না জড়িত কণ্ঠে বললাম “আমরা তোমার গ্র্যান্ড ডটারকে আবার তোমাকে দেখাতে নিয়ে আসব।“ বিশ্বাস করলেন কিনা জানিনা তবে হাসি মুখে বললেন; “বিধাতা চাইলে নিশ্চয়ই আসবে”।
বিধাতা নিশ্চয়ই চেয়েছিলেন। তা না হলে কেনইবা বছর পাঁচেক পর বিধাতার আশীর্বাদে সপরিবারে আমাদের এই সিডনী ঘুরে যাওয়া। সে গল্পটা না হয় আগামী বারের জন্য তোলা রইল।
মোস্তফা আব্দুল্লাহ, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া
|