বন্ধু তোমার জন্য মোস্তফা আব্দুল্লাহ
“কিছু বন্ধু আছে, সৃতি যাদের রবে সৌরভের মত, আর সব ......”
আই সি ডি ডি আর’বির দিনগুলির সময় সহকর্মী রঞ্জন ব্যানার্জি মাঝে মধ্যেই শক্তি চট্ট্যপধ্যায়ের কবিতার এই পঙক্তিটি আবৃতি করতেন মধ্যাহ্ন ভোজের বিরতির আড্ডার আসরে। আমি ঢাকায় আই সি ডি ডি আর’বিতে কাজ করি ১৯৮০ থেকে ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত মোট ১২ বৎসরের জন্য, দুটো ৬ বৎসরের চুক্তির ভিত্তিতে। মাঝের দুই বৎসর কাজ করেছিলাম বাংলাদেশ প্ল্যানিং কমিশনে, উ এন ডি পি’র হয়ে। রঞ্জন এসেছিল কানাডা থেকে, স্ত্রী নিপা ব্যানার্জির ঢাকাতে কেনেডিয়ান হাই-কমিশনে ট্রেড-কমিশনার হিসাবে পোস্টিং এর সুবাদে। রঞ্জন নিজেও পরে একসময় জাকার্তাতে ট্রেড-কমিশনার ছিলেন। আড্ডা জমানোতে রঞ্জন এর জুরি মেলা ভার। খাদ্য রসিক হিসাবেও তুলনা হীন। ঢাকা থাকা কালীন ওই স্বল্প সময়ে ঢাকার অলি গলিতে হরেক রকমের যে পরিমাণ খাবারের দোকানের সন্ধান ও করেছিল, আমার সমস্ত জীবনে তার সিকি ভাগেরও খবর জানি না। খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে রঞ্জনের পাঞ্চ-লাইন ছিলঃ আমার দিদিমা শিশু বয়সকালে আমাকে গঙ্গা জলে স্নান করিয়ে আনে বিধায় কোন পাপই আর আমাকে কোন দিন স্পর্শ করতে পারবে না। আজকের লেখাটা অবশ্য রঞ্জনকে নিয়ে নয়, লেখটার শুরুতে ওর আবৃতি করা কবিতাটির লাইনটি উদ্ধৃতি করার লোভ সংবরণ করতে না পেরেই এই ভূমিকা।
আই সি ডি ডি আর’বির কাজ শেষে ১৯৯৫ সালে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্ক এর অর্থায়নে নিউজিল্যান্ড ভিত্তিক পি এ কন্সালটিং গ্রুপে যোগ দেই সিনিয়র সিস্টেম কনসালটেন্ট হিসাবে। কর্মস্থল ঢাকায়, পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড ও ডেষ্কোর আর্থিক পরিচালনা ব্যবস্থার উন্নয়ন। একাধারে একজন পেশাদারি একাউনটেন্ট ও ইংরেজি সাহিত্যে লন্ডন ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতক ডিগ্রী ধারী, পিটার ষ্টেলি নামক সত্তর ঊর্ধ্ব একজন ইংরেজ ছিলেন প্রজেক্ট এর প্রধান। আমি ছিলাম পিটার এর সহকারীর ভূমিকায়। পিটার কোন চিঠি বা রিপোর্ট ড্রাফট করে সব সময় আমার কাছে নিয়ে আসতেন, ঠিক ঠাক আছে কিনা দেখে দেয়ার জন্য। বুঝতেই পারছেন, সেটা আমার জন্য কতটা অস্বস্তিকর ছিল – আমরা যেখানে বস বা গুরুজনের ভুল দেখিয়ে দেয়াকে গর্হিত বেয়াদবি বলে শিখে এসেছি। স্বভাবতই আমি সব কিছুকেই “ঠিক আছে” বলে ফিরিয়ে দিয়েছি। পিটার একদিন আমাকে ধরে বসল; আমি সবসময়ই শত ভাগ ঠিক হতে পারি না – কখনো বা কোন ভাবে আমার ভুল হতেই পারে বা ভুল বুঝেও থাকে পারি, তার পরেও তুমি কেন সব সময়ই আমার সব কিছু ঠিক আছে বলে ফিরিয়ে দিচ্ছ? লজ্জায় মাথা নত করে জবাব দিলাম যে আমাদের সামাজিক/সংস্কৃতিতে ওপর-ওয়ালার ভুল খুঁজে পাওয়াকে খুব বেশি একটা ভাল চোখে দেখা হয় না – শুধু তাই নয় তাতে বিপদেরও সম্ভাবনা থাকে! পিটার সেদিনই আমাকে বুঝিয়ে দিল যে তার সহকারী হিসাবে আমার দ্বিতীয় প্রধান কাজ হচ্ছে, তার কাজে কোন ভুল ভ্রান্তি লক্ষ্য করলে তা তার নজরে আনা।
সদ্য-লব্ধ এই জ্ঞান কর্মক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে গিয়ে আমি যে কি বিপদেই পড়েছিলাম সে গল্প এখন আপনাদের শোনাই। মাঝে মধ্যে কাজকর্মের অগ্রগতি পর্যালোচনা করার জন্য আমাদেরকে সরকারী কর্মকর্তাদের সাথে সভাতে বসতে হতে হয়। সরকারের উচ্চপদে আসীন এমনি একজনের সাথে কথোপকথনে আমাদের প্রায়ই অসুবিধায় পড়তে হত। এই সবজান্তা কর্মকর্তাটি পিটারের কথা ঠিক মত বুঝতে পারত না, আবার সময় সময় তার নিজের ইংরেজিতে বলা কথার মাথা মুণ্ডু উদ্ধার করাও দুরূহ হয়ে উঠত। প্রায়ই পিটারের কথার সাথে তার বক্তব্যের সঙ্গতি থাকত না। তার চার-পাশ ঘিরে বসা অপেক্ষাকৃত তরুণ কর্মচারীদের মুখ দেখে যদিও আন্দাজ করা যেত যে তারও অস্বস্তি বোধ করছেন কিন্তু কেও কখনো বড়সাহেবের ভুলটা ধরিয়ে দেয়ার সাহস করে নাই। এমনি এক সভায় সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের একটি জরুরি অনুমোদনের প্রয়োজন নিয়ে আলাপ চলছিল। কিন্তু ওই কর্তা-মশাই, পিটার যা বলছে সেটা না বুঝে বার বার অন্য দিকে চলে যাচ্ছে। এমন সময় পিছন থেকে এক তরুণ কর্মকর্তা আমাকে ইশারা করে – বক্তব্যটাকে খোলাসা করার ইংগিত করে। আমিও তার ইশারা মত বিষয়টিকে বাংলায় খোলাসা করে বোঝাতে চেষ্টা করাতেই আমার হোল কাল। তিনি সম্ভবত এটাকে তার ইংরেজি সঠিক ভাবে না বলার বা না বোঝার ইংগিত মনে করে, রক্তচক্ষু করে আমাকে প্রায় ভস্মীভূত করে ফেলার মত অবস্থা! সভা সেদিন কোন সিদ্ধান্ত ছাড়াই মুলতবী হয়ে গেল। অফিস ফেরার পথে পিটারকে ঘটনাটা বুঝিয়ে বললে সে কোন মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকে।
কদিন পর আবার উক্ত সভার দিন স্থির হলে, মন্ত্রণালয় থেকে ফোনে জানিয়ে দেয়া হয় আমাকে যেন মিটিঙে না নেয়া হয়। পিটার আমাকে ছাড়া যেতে অস্বীকৃতি জানালে মন্ত্রণালয়ের সাথে আমাদের যোগাযোগ বন্ধ হয় ও প্রজেক্টের ভবিষ্যৎ সন্দিহান হয়ে পড়ে। এ ডি বি’র ম্যানিলা অফিস থেকে চাপ আসতে থাকে পিটারের ওপর, আমাকে ছাড়াই যেন মিটিঙে গিয়ে বিবাদ মিটিয়ে ফেলে। পিটারের এক গো, হয় আমাকে সাথে নিয়ে মিটিঙে যাবে অন্যথায় সে নিজেই চাকুরী থেকে ইস্তফা দিতে প্রস্তুত। কদিন স্তিতি-অবস্থা বিরাজ করার পর উক্ত কর্মকর্তা অন্য মন্ত্রণালয়ে বদলী হয়ে গেলে তার স্থলাভিষিক্ত হন অপেক্ষাকৃত সংযত ও তীক্ষ্ণ অপর একজন কর্মকর্তা।
পিটার ষ্টেলি তার ঢাকায় পাঁচ বৎসরের কর্মকালের প্রথম তিন বৎসর হোটেল শেরাটনে থেকেছেন। প্রতিদিন সকালে অফিসের পথে হোটেল থেকে বেরোবার সময় একগাদা দশ টাকার নোট নিয়ে বের হতেন। ট্রাফিক লাইটে গাড়ি থামতেই ছোট ছোট ছেলে-মেয়েগুলি ঘিরে ধরতো। পিটার প্রায় সবারই নাম জানতো। গাড়ীর গায়ে হাত দিয়ে ময়লা করে দিত বলে ড্রাইভার সিরাজ প্রায়ই ওদের গালাগাল করে। একদিন একটা ছোট্ট মেয়ে বলে বসল “আপনে এত কতা কেন কন, গাড়ি ধোয়নের লাইগ্যা সাবে আপনেরে বেতন দেয় না?” সিরাজ আবার বকা দিতেই পিটার জানতে চাইল মেয়েটা কি বলছে। ওর কথা শুনে হাসতে হাসতে মেয়েটাকে আরও দশ টাকা দিয়ে আমার দিকে ফিরে বলল; সুযোগ পেলে মেয়েটা একটা বড় সর উকিল হতে পারত। পিটারের কাছে নিয়মিত কয়েকজন আসত অর্থ সাহায্যের জন্য। আমাকে প্রায়ই পিটারের হয়ে দোভাষীর কাজ করতে হয়। বুঝতে অসুবিধা হতো না যে ওদের মাঝে কেও কেও পিটারের ভাল মানুষীর সুযোগ নিয়ে বেশ মোটা দাগের টাকা পয়সা হাতিয়ে নিচ্ছে। আমি একদিন তাকে সেই কথা বলাতে আমার দিকে মুচকি হেসে বলল; আমি কি আর তা বুঝি না! আমিও ওর মত পরিস্থিতিতে পড়লে হয়ত তাই করতাম! স্তম্ভিত হয়ে ভাবতে থাকলাম – আমি কেন পিটারের মত ভাবতে পারলাম না।
পিটার প্রোজেক্টের কাজ শেষে ২০০০ সালে অবসরে যাওয়ার জন্য বাংলাদেশ ত্যাগ করে। ২০০৩ সালে আমি বাংলাদেশে ইউ এস এইড এর অর্থায়নে, ইউ এস এ ভিত্তিক পি এ কন্সালটিং গ্রুপের প্রধান (চিফ অব পার্টি) হই। আমার কাজে বাংলাদেশের দীর্ঘ মেয়াদী জ্বালানীর প্রয়োজন ও তার অর্থায়নের ওপর একটি সমীক্ষা প্রস্তুত করার জন্য একজন বিশেষজ্ঞ এর প্রয়োজন পড়ে। প্রথমেই মনে আসে পিটারের কথা - কিন্তু সে কি তার অবসর জীবন ছেড়ে আবার ৬ থেকে ৮ সপ্তাহের জন্য কাজ করতে আসতে রাজি হবে? দোদুল্যমান মনে তাকে প্রস্তাব দিতে সে জানল “বন্ধু তোমার জন্য, যে কোন স্থানে, যে কোন কাজে” (For you my friend, anywhere, anytime) পিটার ঢাকা এসে ৬ সপ্তাহে কমপক্ষে ১০ সপ্তাহের কাজ সেরে ফিরে গেল।
এটা ছিল আমার জীবনের একটা গৌরবময় অধ্যায়। এমন এক বন্ধুর সান্নিধ্য পেয়েছিলাম, যে কিনা আমার সম্মান রক্ষার্থে তার নিজের লোভনীয় চাকুরী থেকে ইস্তফা দিতেও প্রস্তুত ছিল একদিন।
ধন্যবাদ পিটার। যেখানেই থাক, ভালো থেকো।
মোস্তফা আব্দুল্লাহ, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া
|