আড্ডার গুণকীর্তন মোস্তফা আব্দুল্লাহ “বাংলা শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির এক বড় উদ্দীপনা শক্তি—বাঙালির আড্ডা’—বলেছেন সাহিত্যে নোবেলজয়ী প্রখ্যাত জার্মান ঔপন্যাসিক গুন্টার গ্রাস। গুন্টার গ্রাস দীর্ঘ এক বছরেরও বেশি সময় কাটিয়েছেন কলকাতায়, বাংলাদেশেও এসেছিলেন তিনি। কলকাতায় তিনি নিয়মিত আড্ডা দিয়েছেন কফি হাউসে—সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়সহ সমকালীন বাংলা সাহিত্যের নামী লেখকদের সঙ্গে। প্রখ্যাত এই জার্মান লেখক তরুণ বয়সে আড্ডা দিয়েছেন বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে বার্লিন, বন আর কলোন শহরেও। তাঁর মতে—‘আড্ডা প্রতিভা বিকাশের সহায়ক’। গুন্টার গ্রাসের আড্ডা জমানোর গল্প শুনেছি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে। কেবল গুন্টার গ্রাসই নন, যুগে যুগে বিশ্বের সর্বত্র শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, বিজ্ঞানীসহ সব স্তরের বুদ্ধিজীবীরই আড্ডা-অনুরাগের ইতিহাস আছে। শিল্পী পাবলো পিকাসো দীর্ঘকাল আড্ডা জমিয়েছেন মাদ্রিদ আর প্যারিসে, বিশ্ব বিখ্যাত ফরাসি নাট্যকার জ্যাঁ পল সার্ত্রকে বলা হয়ে থাকে ফ্রান্সের রাজধানী শহরের এক কফি ক্লাবের আড্ডার প্রাণপুরুষ, মিসরের কায়রো শহরে দিনের পর দিন কফি হাউসে আড্ডা দিয়েছেন নোবেলজয়ী সাহিত্যিক নগিব মাহ্ফুজ। তেমনি ইস্তাম্বুলে নোবেলজয়ী তুর্কি লেখক ওরহান পামুক, টোকিওতে ইয়াসুনায়ি কাওয়াবাতা, আমেরিকার বস্টন শহরে প্রখ্যাত নাইজেরীয় সাহিত্যিক ওলে সোয়েঙ্কা, এমনকি বিজ্ঞানী আইনস্টাইনেরও আড্ডা জমানোর ইতিহাস আছে আমেরিকার নিউ জার্সি রাজ্যের কয়েকটি শহরে।”
“বাঙালির আড্ডা-অনুরাগের সবচেয়ে বড় প্রেরণা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ। জোড়াসাঁকোর বাড়িতে কবিগুরু দিনের পর দিন আড্ডায় বসেছেন তাঁর অন্তরঙ্গ কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে। একবার ঘোর বর্ষার এক বর্ষণসিক্ত অলস দুপুরে নিঃসঙ্গতায় কাতর কবি বন্ধুকে উদ্দেশ করে কবিতা রচনা করেছেন ‘শ্রাবণের পত্র’ শিরোনামে:”
‘আমলা-শামলা আঁটিয়া নিত্য তুমি করো ডেপুটিত্ব একা পড়ে মোর চিত্ত করে ছটফট।’
কবিগুরুর মতই আমারও চিত্ত প্রায়ই ছটফট করে মরে একটু খানি আড্ডার জন্য। এখানে যে একেবারেই আড্ডা হয়ে উঠেনা তাও নয়। তবে তা সর্বত্রই গৌণ – ভুড়ি ভোজনটাই মুখ্য। এ যেন দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো। আড্ডা দিতে হলে আড্ডার জন্যই বসতে হবে – দাওয়াতের সঙ্গে আড্ডাকে গুলিয়ে ফেলা যাবে না। এই ধরনের একটা নিয়মিত আড্ডা হোতে পারে যে কোনো কফি শপে, নেইবারহুড সেন্টারে বা অন্য কোথাও। এই আড্ডায় আলোচনার কোনো নির্দিষ্ট বিষয়সূচি থাকবে না। অস্ট্রেলিয়ার রাজনীতি, অর্থনীতি, সামাজিক প্রসঙ্গ থেকে শুরু করে বাংলাদেশ ও বহির্বিশ্বের নানা বিষয় ও প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা- সমালোচনা ও মতবিনিময় চলবে। কেউ কেউ অতীত স্মৃতিচারণা ও জীবন অভিজ্ঞতা থেকে অন্যদেরও সমৃদ্ধ করতে পরবেন। এ ধরনের আড্ডার আলোচনা-মতবিনিময় থেকে নানা উপকরণ সংগ্রহে সক্ষম হতে পারেন নিবন্ধ রচনায় উৎসাহীরা। নানা মতের নানা আদর্শের অনুসারী সদস্যবর্গের আলোচনা-সমালোচনায় কলহ-বিবাদ কিংবা মনান্তর যাতে না ঘটে সেদিকও সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। সবকিছুই যেন চলে সৌহার্দ্যপূর্ণ ও হাসি-আনন্দের পরিবেশে।
নিশ্চই পাঠক ভাবছেন আমি স্বপ্ন দেখছি বা আমার মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটেছে। আপনি হয়তো একেবারে ভুল ভাবেন নি। আমার মত সত্তুর ছুঁই ছুঁই অবসরে যাওয়া অনেকেরই মস্তিষ্ক সচল রাখার জন্যই একটা আড্ডা প্রতিষ্ঠা একান্তই জরুরি। এ ধরনের বাঙ্গালীদের আড্ডা চক্র রয়েছে বিশ্বের অন্য অন্য শহরেও। জেনেছি আমেরিকার টেক্সাস অঙ্গ রাজ্যের এক শহরের এমনি একটি আড্ডা চক্রেরই মস্তিষ্ক প্রসূত (brain child) হোলো সেখান কার প্রতিষ্ঠিত বাংলা-সেন্টার ও আবাসিক এলাকা বাংলা-টাউন!
আড্ডার জন্য মনটা বড্ড আনচান করছিলো। এমনি ক্ষণে এক সময়কার সহকর্মী ও অনুজ প্রতিম আনিস প্রস্তাব করলো কাছা কাছি একটা কফি হাউসএ ঘুরে আসার। প্রস্তাবটা লুফে নিয়ে পরের দিনই সেখানে চলে গেলাম। স্বল্প পরিসরে অদ্ভুত এক ভিন্ন শৈল্পিক সাজ ও পরিবেশের আমেজ। কখনো মনে হয়েছে কোনো শিল্পীর স্টুডিওতে বসে আছি - কখনো বা কোলকাতার চৌরঙ্গীর আধা ফিরিঙ্গিদের কোনো কফি হাউসে। যে জীবনে কখনো আড্ডা দেয়নি সেও এখানে এসে কিছুক্ষণের জন্যে হলেও জমিয়ে আড্ডা না দিয়ে থাকতে পারবেনা। পার্কিং টিকেট খাবার কথা মনে পড়তেই উঠতে হল। বুঝতেই পারিনি কতটা সময় পেরিয়ে গেছে।
১ম এবং ২য় প্যারা দু'টি ফেব্রুয়ারি ০১, ২০১৪ প্রথম আলোতে প্রকাশিত সৈয়দ জিয়াউর রহমান রচিত ‘ওয়াশিংটনের বাঙালি আড্ডা’ থেকে অংশ বিশেষ উদ্ধৃত ও সঙ্কলিত।
|