bangla-sydney
bangla-sydney.com
News and views of Bangladeshi community in Australia












এই লিংক থেকে SolaimanLipi ডাউনলোড করে নিন



টেক কেয়ার
মোস্তফা আব্দুল্লাহ


"টেক কেয়ার" বা ভালো থেকো ছবিটা পরিবেশনার জন্য বাংলা সিডনী ডট কম তথা আনিসুর রাহমান ও তাকে সহযোগিতাকারি স্বেচ্ছাসেবক দের সবাইকে জানাই আন্তরিক অভিনন্দন। আশা করবো আগামীতেও তারা মাঝে মাঝে আমাদেরকে এ ধরনের পরিচ্ছন্ন, শৈল্পিক ও চিত্ত-জাগানিয়া চিত্তবিনোদনের সুযোগ এনে দেবেন। চিত্ত-জাগানিয়া বলছি এই কারণে যে ছবিটির মূল বক্তব্য নিঃসন্দেহে অনেকের মনেই মরণ ব্যাধি ক্যান্সার এর বিষয়ে আরও সচেতনতা সৃষ্টি করতে সহায়ক হবে। ক্যান্সার এর পরিধি ও এর করাল গ্রাস শুধু আক্রান্তদের মধ্যেই সীমিত থাকে না। ক্যান্সার যে সাথে সাথে পরিবার ও পারিপার্শ্বিক সমাজকেও সাথে নিয়ে কুরে কুরে খেতে থাকে, "টেক কেয়ার" ছবিটি তাই আবার জানান দিয়ে গেল।

ক্যান্সার এর মত একটি জটিল ও স্পর্শকাতর বিষয়কে সেলুলয়েডের পর্দায় এত মননশীল ভাবে পরিবেশনা পরিচালকের শৈল্পিক পরিচ্ছন্নতা ও সৃজনশীল অন্তর্দৃষ্টির আভাষ দেয়। ক্যান্সারই যে শেষ কথা নয়, তার পরও জীবন আছে, আছে আশা, আছে ভালোবাসা আর সেটাই ছবিটির মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হয়ে ফুটে উঠেছে। পাওলি দাম এর অভিনয় খুবই ভালো লেগেছে। প্রাণবন্ত উচ্ছল এক তরুণী থেকে ক্যান্সারে আক্রান্ত আশাহীন এক অবয়বের যে চরিত্রটি তিনি ফুটিয়ে তুলেছিলেন তা ছিল নিখুঁত। এই পরিবর্তনটি ছিল স্বচ্ছ জলের স্রোতধারার মত নিরবচ্ছিন্ন ও ত্রুটি-বিহীন। নায়িকার পিতার নিঃসঙ্গতা ও ক্যান্সার এর বিষয়ে অজ্ঞতার অপরাধ-বোধ বার বার ফুটে উঠেছে তার নুরি পাথর ছড়ানো শুষ্কপ্রায় ক্ষীণ-স্রোতা নদীটির পাশে দাড়িয়ে থাকা শট থেকে। তিস্তার বাবা ও কাকুর সাথে আমিও কেপে উঠেছিলাম যখন তিস্তা ওদেরকে তার ক্যান্সার এর কথা জানলো, যদিও দর্শক হিসাবে বিষয়টা আমাদের আগে থেকেই জানা ছিল। তিস্তার বাবার অপরাধ-বোধ আমাকে ব্যাধিত করেছে, আর তাই কন্যাকে ক্যান্সার এর অভিশাপ থেকে আড়াল রাখার নিষ্ফল প্রয়াসে তার মায়ের মৃত্যুর কারণ গোপন করাকে খুব একটা অস্বাভাবিক বলে মনে হয় নাই। ছবিটি আমার ভালই লেগেছে। ছবিটির অন্যান্য দিক যেমন শৈল্পিক, কারিগরি ও আনুষঙ্গিক অন্যান্য বিষয়ে সমালোচনা লেখার জন্য যে বিচার বুদ্ধি ও বিজ্ঞতা প্রয়োজন তা আমার নাই আর তাই আমি সে দিকে যাব না। অজ্ঞতার একটা সুবিধাও আছে – খুঁচিয়ে ভুল খুঁজতে না পারার। শুনেছি পরিচালকের নাকি এটি প্রথম প্রয়াস! স্বভাবতই ভাবতে আনন্দ হচ্ছে আগামীতে আরও ভালো ভালো খবর আসছে। আরেকটা কথা আপনাদের না জানিয়ে পারছিনা – আমরাই ছবিটির প্রথম দর্শক, এর আগে ছবিটি কোথাও জনসম্মুখে প্রদর্শিত হয়নি!

ছবিটা দেখতে দেখতে প্রয়াত ডাক্তার আব্দুল হকের কথা মনে পরে গেল। ছবিটার যে বিষয় বস্তু সেটাই তো হক ভাইয়ের মনের কথা ছিল – তাই নয় কি? তা না হলে কেনই বা তিনি বছরের পর বছর ভোর রাতে উঠে গ্যাসের চুলা, সিলিন্ডার, হাড়ি বসন ও আরাও কত কি টেনে নিয়ে গাড়ির পেছনে উঠিয়ে গুড মর্নিং বাংলাদেশ এর জায়গা দখল এর জন্য হাজির হয়ে যেতেন। কেনই বা লোকজনের মুখ বাঁকানো কথা বার্তার কথা জেনেও জনে জনে অনুরোধ করে যেতেন ক্যান্সার এর বিরুদ্ধে যুদ্ধে তার সহযাত্রী হওয়ার জন্য। ছবিটা দেখতে দেখতে বার বার আমার হক ভাইয়ের কথা মনে পড়ছিল আর ভাবছিলাম আজকের এই প্রদর্শনীকে যদি হক ভাইয়ের কর্ম কাণ্ডের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্যে উৎসর্গ করা যেত তাহলে হয়ত ছবিটির মূল বক্তব্য দর্শকদের কাছে আরও জীবন্ত হয়ে উঠত। আমি মোটামুটি নিশ্চিত যে সব দর্শকও ও আয়োজকরাও হয়ত সে রকমই ভাববেন আর তাই আমি আমার মত করে এই চিত্ত-জাগানিয়া প্রদর্শনীটিকে হক ভাইয়ের শ্রদ্ধার প্রতি উৎসর্গ করলাম।

ছবিটি দেখতে গিয়ে আমার আরো একটি অনুভূতি হয়েছে যা কিনা আমার ব্যক্তিগত। তবুও সেটা এখানে লিখছি এই ভেবে যে হয়তো তা কারো কারো কাছে সেটা ভালো লাগতেও পারে। সেই ১৯৭৭ সালের কথা। সদ্য বিবাহিত স্ত্রীকে নিয়ে সিডনির পূর্বাঞ্চলে রেন্ডউইকে ডেরা বেধেছি এক বেডরুমের এক ফ্লাটে। প্রায়ই ছুটির দিনগুলিতে অলস সময় কাটানোর জন্য দুজনে বসতাম ফ্লাট বাড়ির সামনের চত্বরে - সময় কেটে যেত মৃদু আলাপচারিতায় ও সামনের রাস্তার লোক জনের আনা গোনা দেখতে দেখতে। আমাদের লাগোয়া ফ্লাটে থাকতেন এক বৃদ্ধা মহিলা, একাই। মাঝে মাঝে ফিরতেন বাজার হাতে নিয়ে হেটে হেটে। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে বেশ কষ্ট হত। প্রথম দিন আমি উঠে গিয়ে তার হাতে থাকা ঝোলাটিকে নিয়ে সিরি বেয়ে উঠতে সাহায্য করতে চাইলে সে কিছুটা ঘাবড়েই গিয়েছিল। তার পর থেকে এটা একটা নিত্ত নৈমিত্তিক ব্যাপারে দাড়িয়ে গেল। সিরি দিয়ে উঠে মাঝে মাঝে আমাদের সাথে বসে কিছুক্ষণ গল্পও করে যেত। গল্পে গল্পে জানতে পারলাম নিঃসন্তান হিসাবে বহু দিন আগেই বিধবা হয়েছেন। নিকট আত্মীয় বলতে রয়েছে এক ভগ্নি-পুত্র – কাছা কাছি থাকে, কুঁজিতে – কালে ভদ্রে খোজ খবর নিতে আসে।

সময়ের সাথে সাথে সখ্যতা বারতে থাকে। আমি অফিসে চলে গেলে আমার স্ত্রী একা থাকে বলে তিনি যেতে আসতে তার খোজ নিতে থাকেন। আমার স্ত্রীও কিছু ভালো মন্দ রান্না হলে তাকে দিতে গেলে তার চক্ষু অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠে। এমনি করে কিছুদিন যাওয়ার পর আমার স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার পর মহিলাটি নিজ থেকেই স্বঘোষিত অভিভাবক হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেললেন। এমনকি আমার স্ত্রী যখন একা থাকেন তখন কেও দরজায় করা নাড়লেও তার দরজা খোলা মানা, যতক্ষণ না তিনি তার দরজা খুলে এসে দেখবেন কে দরজায় দাড়িয়ে! সন্তান প্রসবের সময় ঘনিয়ে আসতেই তিনি আমাদেরকে বার বার স্মরণ করিয়ে দেন যে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময় তাকে যেন নিশ্চিত জানিয়ে নেয়া হয় এবং সেটা যদি গভীর রাতেও হয়, তবুও।

আর ঘটনাটা ঘটল মাঝ রাতেই। পাশের ফ্লাটে থাকা আলম ভাই এর গাড়ি করে হাসপাতালে যাওয়ার সময় ভাবিকে বলে গেলাম এত রাতে তাকে আর জাগিয়ে কাজ নাই – আপনি সকালে উঠেই ওনাকে বলে দিয়েন। ভাবী সকালে খবরটা জানাতেই মহিলাটি তরিঘড়ি করে গির্জায় চলে যাওয়ার সময় বলে গেলেন সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর যেন তাকে খবর দেয়া হয় – তার পরই তিনি গির্জা থেকে ফিরবেন! তার কথা মত গির্জায় গিয়ে পেছন থেকে দেখি একটা মোম বাতি জ্বালিয়ে মাথা নিচু করে গভীর প্রার্থনায় নিমগ্ন এক সৌম্য মূর্তি। মনের অজান্তেই কবে ভুলে গিয়েছিলাম সেই মূর্তিটির কথা। "টেক কেয়ার" এ তিস্তার জন্য গির্জায় প্রার্থনারত যাজিকাকে দেখে মনের ভিতর একটা হোঁচট খেলাম। আমিতো দেখেছি এই যাজিকার মত এক মূর্তিকে – কোথায় সেটা? আর তাই "টেক কেয়ার" আমার জন্য চিত্ত-জাগানিয়াই হয়ে থাকবে।

আমদের কন্যাকে নিয়ে বাড়ি ফিরে ঘরে ঢোকার পথে তিনি ওকে প্রথম কোলে নিয়ে অনেকক্ষণ ধরে চোখ বন্ধ করে মনে মনে প্রার্থনা করলেন। তার পর নিজের ঘরে গিয়ে এক গাদা পোশাক নিয়ে এলেন ওর জন্য। প্রতিটা পোশাকই নিজের হাতে সেলাই করা! এর কিছুদিন পর আমার মেয়েকে কোলে নিয়ে একটা ছবি তুলে তা বাধিয়ে টেলিভিশন এর ওপর রেখে বললেন যে আমি যখন আমার গ্র্যান্ড ডটারকে সামনাসামনি দেখতে পাব না তখন ওই ছবিটির দিকে তাকিয়ে থাকব।

দেখতে দেখতে মাস তিনেক পেরিয়ে গেল। যতই মেয়ের মুখের দিকে দেখি ততই আমার মায়ের মুখটা ভেসে আসে; আহা না জানি কত আশা করে বসে আছেন তার এক মাত্র সন্তানের এক মাত্র মেয়েটিকে দেখার জন্য। স্ত্রীকে কথাটা জানাতেই সে জানালো যে এক মাত্র নাতনিটি এক দেশে বড় হয়ে উঠবে আর দাদি থাকবে আরেক দেশে, কেউ কাউকে চিনবে না জানবে না, সেটা হতে পারে না। চল আমারা দেশে ফিরে যাই। যেই বলা সেই কাজ – এক মাসের মধ্যে দেশে ফিরে আসার প্রস্তুতি সম্পন্ন। এর মাঝে একদিন ওই মহিলাকে আমাদের সিদ্ধান্তটা জানাতেই তিনি কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন; তার পর আস্তে আস্তে বলেন, চলেই যদি যাবে তবে আমার সাথে কেনই বা সখ্যতা গরলে – কেনই বা এত মায়া জাগালে। বাড়ি ফিরে যাওয়ার আনন্দে দূর দেশে এক মাতামহের কথা ভাবতে গিয়ে এখানেও যে আর এক মাতামহ রয়ে গেছে ক্ষণিকের জন্যও তা মনে পরে নাই!

বিদায়ের দিন আবারো আমাদের কন্যাকে কোলে নিয়ে চোখ বন্ধ করে অনেকক্ষণ ধরে প্রার্থনায় করল। হাসি মুখে বলল; "তোমাদের যাবার বেলায় আমি এখানে থাকতে চাই না। আমি এখন গির্জায় গিয়ে মোম বাতি জ্বালিয়ে প্রার্থনায় বসবো বিধাতা যাতে মঙ্গল মত তোমাদেরকে তোমাদের গন্তব্য স্থলে পৌঁছে দেন। বিধাতা তোমাদের মঙ্গল করুন, যেখানেই থাক ভালো থেকো, Take Care"।

বহু কষ্টে কান্না জড়িত কণ্ঠে বললাম "আমরা তোমার গ্র্যান্ড ডটারকে আবার তোমাকে দেখাতে নিয়ে আসব"। বিশ্বাস করলেন কিনা জানিনা তবে হাসি মুখে বললেন; বিধাতা চাইলে নিশ্চয়ই আসবে।

বছর পাঁচ ছয়েক পরের কথা, ততদিনে আমদের আরেকটি কন্যা সন্তান জন্মেছে, ওদেরকে নিয়ে বেরাতে এসেছিলাম সিডনীতে। সেই মহিলার ফ্লাটে গিয়ে দেখতে পাই আমাদের বড় কন্যাটির সেই দুই মাস বয়সের ছবিটি তখনো শোভা পাচ্ছে তার টেলিভিশন এর ওপর!

আজ না হয় এ পর্যন্তই থাক, এর পরও আরো কিছু কথা রয়ে যায়, সে কথা না হয় আরেক দিন হবে। সবাই ভালো থাকুন "Take Care"।



মোস্তফা আব্দুল্লাহ, সিডনি




Share on Facebook               Home Page             Published on: 5-Dec-2016

Coming Events:





A day full of activities, games and fun.







Blacktown Lakemba Mascot