“... তাই বলে কি প্রেম দিব না?” মোস্তফা আব্দুল্লাহ
গত তিরিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে বছরান্তে না হলেও প্রায়ই সিডনি ক্যানবেরা ঘুরে যেতে হয়েছে – প্রথম জীবনে অফিসের কাজে আর বছর দশেক আগ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত কন্যাদ্বয়কে দেখে যাওয়ার জন্য। যখনই এসেছি: “দেশের খবর কি?” এ ধরনের একটা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে প্রায় সর্বদাই – বাংলাদেশী দের কাছ থেকে। আমার বিচারে যেটা সঠিক বলে মনে হয়েছে সে উত্তরটাই দেওয়ার চেষ্টা করেছি। লক্ষ্য করলাম এতে কেউ কেউ সন্তুষ্ট হচ্ছেন আর কেউ বা মুখ ভার করছেন। প্রথমে বুঝতে অসুবিধা হলেও পরে বুঝতে পারলাম যে খুশি বা অখুশি হওয়াটা নির্ভর করছিল আমাদের দেশের রাজনৈতিক মেরুকরণের কোন পাশে কার অবস্থান তার ওপরে! এর পর সাবধান হয়ে গেলাম – যতটা পারি বুঝে শুনে উত্তর দিতে সচেষ্ট হতাম। তাতে খুব বেশি একটা লাভ হলো না – উভয় পক্ষই আমাকে প্রতিপক্ষের লোক বলে ভাবতে লাগলো!
সংখ্যাতে যদিও তারা খুবই নগণ্য – তাদের ধারণা যে আপনি এক পক্ষের সাথে সুর না মেলালে নির্ঘাত অন্য পক্ষের লোক! তারা এটা অনুধাবন করতে পারেন না যে মুষ্টিমেয় কিছু রাজনীতির সাথে সরাসরি জড়িত মানুষ ছাড়া বাংলাদেশের মূল জনসংখ্যার বেশির ভাগই কোনো একক দলের প্রতিই অন্ধ ভাবে অনুরক্ত নয় – পাঁচ বছর পর পর উন্মুক্ত নির্বাচনের ফলাফলই সে কথা জানান দিয়ে যায়। দেশের ভালো মন্দের উপর যাদের ন্যূনতম মমত্ববোধ আছে তারা দেশের ভালো দেখলে তাকে ভালো বলতে আর মন্দকে মন্দ বলতে কখনো পিছ পা হয় না। আর অন্যদিকে যারা শাসক গোষ্ঠীর অনুকম্পার প্রত্যাশায় রাজনীতি নিয়ে “পলিটিক্স” করে – তারা কখনই সত্যকে মিথ্যা বানিয়ে আর মিথ্যাকে সত্য বানিয়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে কুণ্ঠা বোধ করে না।
এ প্রসঙ্গে আর একটি কথা না বলেই পারলাম না: তারা যেমন তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে বড়াই করতে পিছপা হয় না – তেমনি যারা নিজেদেরকে অরাজনৈতিক সত্তা বলে মনে করে তাদেরও এব্যাপারে গর্ববোধ কম না। তাদের এই অরাজনৈতিক পরিচয় অর্জন করতে, সম্ভাব্য ব্যক্তিগত সুযোগ সুবিধার প্রলোভন ও ভয়ভীতিকে উপেক্ষা করে তারা যে সাহস, মনোবল ও ব্যক্তিসত্তার প্রমাণ দেখিয়েছেন, তাকে খাটো করে দেখার একেবারেই কোনো অবকাশ নাই।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাঙ্গালীদের নিজ জন্মভূমি ছেড়ে স্থায়ী ভাবে বসবাস করার সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এদের বড় একটি অংশের জন্য অর্থনৈতিক কারণটাই প্রধান। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রী ধারীদের জন্য এটাই মুখ্য কারণ বলে মেনে নেয়া যায় না। তারা হয়ত এখানে এসে আর্থিক দিক থেকে আনুপাতিক ভাবে সচ্ছলতা লাভ করেছেন তবে দেশে থাকলে যে নিদারুণ অর্থ কষ্টে দিনানিপাত করতেন সেটাও না। তারা মুখ্যতঃ এসেছেন নিজ দেশের অগ্রহণযোগ্য পরিস্থিতি এড়াতে ও বিদেশের অণুকুল কর্ম-পরিবেশের সুযোগ নিতে। আমার মনে হয় খুব কম সংখ্যকই আমার সাথে দ্বিমত পোষণ করবেন যে দেশের এই বিরাজমান সার্বিক পরিস্থিতির জন্য কাউকে যদি একক ভাবে দায়ী করা যায় তবে সেটা হবে রাজনৈতিক নেতৃত্ব। আর ওই রাজনিতিকদেরই দুঃশাসনের ফলশ্রুতিতে দেশ ত্যাগ ক’রে – বিদেশে এসে সেই রাজনিতিকদেরই তোষামোদ করা কি “মেরেছ কলসির কানা – তাই বলে কি প্রেম দিব না?” -র মত নিদারুণ রসিকতা বলে মনে হয় না!
এ ধরনের মন মানসিকতার কারণটা কি হতে পারে? আমাদেরই উপমহাদেশের ভারত ও শ্রীলংকা এবং অন্যান্য প্রতিবেশী দেশ সমূহের জন গোষ্ঠীর মধ্যে তো এই ধরনের প্রবণতা এত প্রবল ভাবে পরিলক্ষিত হয় না। কারণটা সম্ভবতঃ আমাদের ইতিহাস – অতীতে বাংলা ভাষা ভাষীদের নিজেদেরকে কখনো শাসন না করার ইতিহাস। অনাদিকাল ধরে আমরা কোন না কোন অ-বাংলা ভাষীর অধীনে শাসিত হয়েছি। যদিও ৭৫০ থেকে ১১৯৯ সাল অব্দি পাল বংশের রাজত্ব কালকে বাঙ্গালীদের শাসন আমল বলে ধারনা করা হয় – তবে এ বিষয়ে যথেষ্ট মত ভেদ রয়েছে এবং এর স্বপক্ষে কোন জোরাল প্রমাণও নাই। হোসেন শহীদ সোরোয়ারদী ও শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক অবিভক্ত বাংলার মুখ্য মন্ত্রী ছিলেন তবে সেটাও পরাধীন ভারতবর্ষে ইংরেজের অধীনে।
এই নিজ ভাষা ভাষীদের দ্বারা শাসিত না হওয়ার কিছুটা প্রতিফলন দেখা যায় আমাদের ভাষার মাঝেও। এটা লক্ষণীয় যে বাংলা ভাষায় নিজস্ব কোনো গালি গালাজ নাই। দুই একটা যা আছে তা অন্য ভাষা থেকে অনুবাদ বা ধার করে নেয়া। সমাজ বিজ্ঞানীদের ধারণা কটু কথা বা গালি গালাজের সাধারণত প্রয়োজন শাসক গোষ্ঠীর – অধীনস্থকে ভয় ভীতির মাধ্যমে বশে রাখার জন্য। আমরা যেহেতু কাউকেই – এমনকি নিজেদেরও – কখনো শাসন করার সুযোগ পাই নাই অতএব আমাদের ভাষায় গালি গালাজ বা কটু কথার প্রয়োজন পড়ে নাই! আমাদের মূলত প্রভু বা শাসক গোষ্ঠীর অনুকম্পা পাওয়ার জন্য বা কখনো কখনো জীবন ও জীবিকা রক্ষার তাগিদে আশ্রয় নিতে হয়েছে – চাটুকারিতার ভাষার। আর সেটাই বোধ হয় আজ কিছু সংখ্যকের মজ্জাগত চরিত্রে রূপ নিয়েছে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ক্ষণিকের জন্য হলেও বাঙ্গালীরা প্রথম স্বপ্ন দেখেছিল নিজেদেরকে শাসন করার। সে স্বপ্ন অচিরেই দু্:স্বপ্নে পরিণত হলো ষড়যন্ত্রকারী ও তাদের দোসরদের ক্ষমতা-লিপ্সা, স্বজনপ্রীতি ও অদুরদৃষ্টিতার বেড়াজালে পড়ে। এর ফলশ্রুতিতে বলি হলেন ইতিহাসের প্রথম বাংলাভাষী বাঙালী শাসক/রাষ্ট্রপ্রধান – স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রাণপুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাদ বাকি ইতিহাস কারোই অজানা নেই। সে ইতিহাস শুধুই ষড়যন্ত্রের, চাটুকারিতার ও বিদেশী প্রভুদের মন-তুষ্টির মাধ্যমে ক্ষমতায় টিকে থাকার ছলা কলা। এই যাত্রার কাহিনীর মাঝে খুব একটা বৈচিত্র্য নেই – পালা বদলের সাথে সাথে শুধু মাত্র একবার এই দলের ও অন্যবার আরেক দলের কলাকৌশলীদের উত্থান ও পুনরুত্থান।
মোস্তফা আব্দুল্লাহ, সিডনি
|