স্মৃতি বিলাস মোস্তফা আব্দুল্লাহ
আগের অংশ
সেই সাতাত্তরের কথা – বছর খানেক হয়ে গেল দেশ থেকে অস্ট্রেলিয়া এসেছি। ইলিশ মাছের কথা মনে হলেই মনটা কেমন করে আর জিভে পানি এসে যায়। এমনই দিনে ডঃ ফজলুল হক ভাইয়ের টুঙ্গাবির নতুন বাড়িতে দাওয়াত। এসে জানতে পারলাম কে একজন ঢাকা থেকে মেলবোর্নে একটা নোনা-ইলিশ নিয়ে এসেছেন আর সেটারই কিছু অংশ এসেছে হক ভাইয়ের বাড়িতে। হক গিন্নী তা চুলোয় বসিয়েছেন। মনে হোল সেই ইস্টার্ন সাবার্ব থেকে প্যারামাটা পার হয়ে এতটা আসাটা নিতান্তই সার্থক। কেননা সাতাত্তরের দিকে আমরা যারা ওই দিকে থাকতাম তাদের কাছে প্যারামাটা পার হওয়াকেই অস্ট্রেলিয়ার প্রায় আরেক প্রান্তে পৌঁছে যাওয়া বলে মনে করতাম। নোনা-ইলিশের কথায় ফিরে আসি। শুনলাম অতিথির সংখ্যাধিক্যের কারণে ওটাকে অনেকটা সবজির সাথে ঝোল করা হয়েছে। সেটাই যখন পরিবেশিত হোল তাতে আসলে কতটা ইলিশের ঘ্রাণ ছিল তা হলফ করে বলতে পারবো না তবে আমাদের সবার মনের মধ্যে পদ্মার টাটকা ইলিশের গন্ধ যে মৌ মৌ করছিল সেটা কেউই অস্বীকার করতে পারবেনা। খাবার পর মনে হয়েছিল দুই এক দিন যদি হাতটা না ধুয়ে থাকা যেতো! সবে মাত্র সস্ত্রীক সিডনী পৌঁছেছি – কোথায় কোন দোকানপাট কিছুই জানা নাই। তার ওপর এখানে যে দেশীয় তৈজস পত্রের দোকান থাকবে চিন্তাও করিনি। এমন সময় খোঁজ পেলাম যে বণ্ডাইএ ‘ইযি অ্যান্ড সন্স’ বলে একটা দোকান আছে যেখানে সবই পাওয়া যায়। শাহাদাত আলি ও আমি পরিবারসহ হাজির হলাম সেখানে। দোকান ঘুরে দেখি যা চাই তাই আছে। শাহাদাত আলি এতই উল্লসিত হয়ে পড়ল যে সে এখন তেঁতুল আছে কিনা খোঁজ করতে লেগে গেল। অনেক খোজা খুঁজির পরও না পেয়ে দোকানীকেই জিজ্ঞাসা করা সাব্যস্ত হোল। কিন্তু সমস্যা হোল যে আমরা কেওই তেঁতুলের ইংরেজি জানি না। শাহাদাত আলি দমার পাত্র নন। আমরা নানা ভাবে long long, short short, brown brown, sour sour ইত্যাদি বলে যখন দোকানীকে বোঝাতে গিয়ে হয়রান হয়ে যাচ্ছি তখন দোকানী আমাদের কাছে জানতে চাইল; “Are you looking for tetul?”.
ঠিক হোল সবাই মিলে পিকনিকে যাওয়া হবে। আমজাদ ভাই করিতকর্মা মানুষ – তাকেই দেয়া হোল ভার, সব বন্দোবস্তের। তখনও আমাদের অনেকেরই নিজের গাড়ি নেই। ঠিক হোল যে একটা বাস ভাড়া করে সেটাতেই সবাই এক সাথে যাওয়া যাবে। পিকনিকের দিন যথা সময়ে সবাই আমজাদ ভাইয়ের বাসার সামনে উপস্থিত। ঘণ্টা পেরিয়ে যাওয়ার পরও আমজাদ ভাইয়ের দেখা নাই। তারও ঘণ্টা খানেক পর একটা বাস নিয়ে হাজির আমজাদ ভাই। বাসের চালক অর্ধ ঘুমন্ত উঠতি বয়সের এক কিশোর। সবার মুখ চাওয়া- চাওয়ি দেখে আমজাদ ভাই জানালেন যে ভোরে উঠে বাস আনতে গিয়ে দেখেন যে বাস ড্রাইভার অসুস্থ। অন্য কোন ড্রাইভার ও তার জানা নেই। কিছু ভেবে না পেয়ে কাছেই পুলিশ ফাঁড়িতে গিয়ে তাদের সাহায্য কামনা করেন। পুলিশের তো চক্ষু চড়ক গাছ – এ রকম সমস্যা নিয়ে তো কেউ কখনও তাদের কাছে আসে নাই। অনেক বলে কয়ে তাকে অন্যত্র চেষ্টা করতে বলে সেই যাত্রায় তারা নিষ্কৃতি পান। আমজাদ ভাই নিরুপায় হয়ে ওই রবিবার সকালে তাঁর বাসার রাস্তার প্রায় সব গুলো বাসার দরজায় টোকা মেরে খোঁজ করেন যে কেউ তার বাসটাকে চালাতে রাজি আছেন কিনা। অবশেষে এই কিশোরকে যখন বলেন যে সমাজের কাছে তার আর মান সম্মান থাকবে না যদি আজ একটা ড্রাইভার জোগাড় করতে না পারেন - আর তাতেই সে নিমরাজি হওয়াতে নজরবন্দি করে ধরে এনেছেন! প্রয়াত মনসুর ভাই একদিন ফ্লেমিংটন মার্কেটে গিয়ে দেখতে পান এক দোকানীর কাছে বেশ কিছু কাচা মরিচ, যা কিনা তখনকার দিনে খুব বেশি একটা দেখা যেতো না। দোকানীকে জিজ্ঞাসা করলেন মরিচ গুলো ঝাল হবে কিনা। সে মাস্তানি চালে জবাব দিল “Man – this is poison”। মনসুর ভাই সাথে সাথে একটা মরিচ নিয়ে তার সামনেই চিবিয়ে খেয়ে ফেলাতে দোকানীর মাথায় হাত। সে মনসুর ভাইয়ের হাত ধরে বলল “Boss it’s all yours if you want it. You do not have to pay, if you don’t want to”! মাছ কিনতাম কিংসফোর্ডের একটা দোকান থেকে। এক দিন গিয়ে দেখি কিছু গুড়া মাছ যা আগে কখনো দেখিনি। লোভ সম্বরণ করতে না পেরে সবটাই, প্রায় কেজি খানেকের মত দিয়ে দিতে বললাম। দোকানদার কিছুটা আশ্চর্য হয়েই আমার দিকে তাকিয়ে বলল “You must be fishing a lot”। তখনও জানতাম না যে এটার নাম Bait Fish যা দিয়ে এরা তখনকার দিনে শুধু মাত্র বড়শীতে গেঁথে মাছই ধরত।
এক ভদ্রলোক এ দেশে আসার পর পরই তার স্ত্রীর জন্য একটা চাকুরী জোগাড়ে ব্যস্ত হয়ে পরলেন। বাসার ধারে কাছেই স্কুলের বাচ্চাদের কাপড় বানানোর একটা কারখানায় গিয়ে বললেন “My wife need service”. উত্তর দাতা জানালেন যে এর জন্য তাকে কাছেই পেট্রোল পাম্পের সার্ভিস সেন্টারে যেতে হবে। অতঃপর তিনি যখন একই কথা পেট্রোল পাম্পে গিয়েও বললেন - পাম্প মালিক জানালেন “But she needs to bring her car”!
উনআশি আশি সনের দিকে কুয়ানটাসে প্রশিক্ষণে আসা কিশোরদের নিয়ে আমরা প্রতি রোববার বণ্ডাই ওভালে ক্রিকেট খেলতাম। মাঝে মধ্যেই লক্ষ্য করতাম যে কিছু পথচারী উৎসাহী দর্শক আমাদেরকে (খেলা?) দেখছে। এমনই একদিন দর্শকের সংখ্যা অন্য অন্য দিনের চেয়ে বেশ কিছুটা বেশি বলে মনে হোল। কারণ খোজ করে জানা গেল যে আমাদেরই কোন একজন এক উৎসুক দর্শকের প্রশ্নের উত্তরে বলেছে যে মাঠে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল অনুশীলন করছে!
* আমার স্মৃতিচারণে অনিচ্ছাকৃত ভাবে কোন ভুল বর্ণনা উপস্থাপিত হয়ে থাকলে ক্ষমা প্রার্থী।
আগের অংশ
মোস্তফা আব্দুল্লাহ, গ্লেনউড, সিডনি
|