নিতান্তই একটি ছোট গল্প মোস্তফা আব্দুল্লাহ
আনমনে গাড়ি চালাতে চালাতে হঠাৎ রিয়ার ভিউ মিররে চোখ পড়তেই পুলিসের গাড়িটাকে তার পেছন পেছন আসতে দেখল মবিন। স্পিড মিটারের কাটাটা কখন যে আশির ঘর পেরিয়ে গেছে সেটা খেয়ালেই আসে নাই অথচ রাস্তার এই অংশটার সর্বোচ্চ গতি সীমা মাত্র ষাট কিলো মিটার। বেশ কিছু দিন ধরে প্রায়ই এরকম হচ্ছে বিশেষ করে কাজ শেষে বিকেলে বাড়ি ফেরার পথে।
মবিন ইউ টি এস এর পাঠ চুকানোর পর পার্মানেন্ট রেসিডেন্স পাওয়ার সাথে সাথেই দেশে গিয়ে তার বাগদত্তা রুবিনাকে সাথে নিয়ে এসে ঘর বেধেছে সিডনির এই পশ্চিমাঞ্চলে। কর্মস্থল উত্তরে, কিছুটা দুরে সমুদ্রের গা ঘেঁষে। এক মাত্র কন্যা সন্তান কণাকে ঘিরেই মবিন ও রুবিনার সমস্ত বিশ্বচরাচর। কাজের মাঝে একটু ফুরসত পেলেই টেবিলে স্ট্যান্ডে রাখা কণার ছবিটির দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকে মবিন আর সময় গুণতে থাকে কখন বাড়ি ফেরার সময় হবে। বিয়ের প্রায় ছয় বছর পর মবিন ও রুবিনার ঘর আলো করে আসে কণা। শুরু থেকেই ওদের আকাঙ্ক্ষা ছিল একটি সন্তানের। প্রায় বছর পাঁচেক পেরিয়ে যাওয়ার পরও যখন কোনও সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছিল না - আর যখন তারা এটাকেই ভবিতব্য বলে মেনে নিতে যাচ্ছিল তখনি আকস্মিক ভাবে এলো ভুবন আলো করা সন্তানের আগমনী বার্তা। কণার বয়স মাত্র পাঁচে ছুঁয়েছে সবে প্রিস্কুল থেকে প্রাইমারিতে ঢুকেছে। বছর দুয়েক আগের এক অবিশ্বাস্য ঘটনার কথা মনে হলেই মবিন এখনো শিউরে উঠে আর কণাকে কাছে পেলে জোর করে বুকে চেপে ধরে নিজেকে আস্বস্থ করতে চায় যে কণা ঠিক ঠিকই তার বুকের সাথেই লেপটে রয়েছে!
মবিনের আশঙ্কাটাই সঠিক হলো - পুলিসের গাড়িটা একটু এগিয়ে এসে মবিনের ডান পাশে গিয়ে, তাকে সামনে গিয়ে বায়ে দাড়াতে ইশারা করলো। এই নিয়ে অল্প কিছু দিনের মধ্যেই তৃতীয় বারের মত স্পিডিং এর জন্য আবার পুলিসের মুখো মুখী হতে হচ্ছে। আর যে কটি পয়েন্ট আছে আজ তাও যাবে লাইসেন্সটাই বোধ হয় গেল.
পুলিসের গাড়িটা আস্তে আস্তে মবিনের গাড়ির পেছনে এসে কিছুটা দূরত্ব রেখে দাঁড়াল। রিয়ার ভিউ মিররে দেখা যাচ্ছে পুলিসটি তার ড্যাস বোর্ডের কম্পিউটারে কিছু একটা দেখছে। বেশ কিছুক্ষণ পর ধীর গতিতে হেটে হেটে মবিনের গাড়ির দিকে এগুতে লাগলো।
লোকটাকে একটু চেনা চেনা মনে হচ্ছে না? আরে এতো দেখি সেই ভদ্রলোক যে কিনা প্লাটফরম থেকে লাইন এর ওপর ঝাঁপ দিয়ে আগন্ত ট্রেন এর সম্মুখ থেকে কণাকে উদ্ধার করে নিয়ে এসেছিল আশ্চর্য, ভদ্রলোক যে পুলিস সেটাতো জানতামই না
অবশ্য সেটা জানার অবকাশ মবিনের খুব বেশি একটা হয়ে উঠেনি। সেদিনের ঘটনার আকস্মিকতায় ও মেয়েকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে পেয়ে অন্য কোনও কিছুর দিকে মনোনিবেশ করার তখন কোনও প্রশ্নই আসে না। চোখের পর্দায় এখনো ভাসছে কণাকে কোলে নিয়ে মাঝ বয়সী দীর্ঘকায় এক সুঠাম পুরুষ, দেখতে কিছুটা ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের মত, প্লাটফরমের ওপর দাড়িয়ে আছে। আর মবিন তীরের বেগে তার কোল থেকে কণাকে ছিনিয়ে নিয়ে মূর্ছা যাওয়া রুবিনার কাছে এসে চিৎকার করে বলে চলছে: এইযে দেখো - তোমার কণা তোমার কাছেই আছে । বেশ কিছু সময় পর রুবিনার সম্বিত ফিরে এলে চার পাশের ভিড়টা কিছুটা লঘু হওয়ায় মবিনের মনে পড়ল তার কন্যাকে যে নিজের জীবন বাজি করে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে ছিনিয়ে আনল - সে কোথায়? অনেক খোজা খুঁজি ও জনে জনে জিজ্ঞাসা করেও তার কোনও হদিস পাওয়া গেলো না। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি ট্রেন স্টেশনে থেমে চলেও গিয়েছে। হয়তো তারই কোনও একটাতে করে এত ক্ষণে সে তার গন্তব্য স্থলে পৌঁছে গেছে। সেই ভদ্রলোকের কাছে কৃতজ্ঞতা না জানতে পারার গ্লানি বোধ হয় মবিন ও রুবিনার সারা জীবনেও যাবেনা। তাই যখনি তারা কণার দিকে তাকায় তখনি সেই ভদ্রলোক ও তার নিকট জনের মঙ্গলের জন্য বিধাতার কাছে মন প্রাণ দিয়ে প্রার্থনা করে; ঈশ্বর তাদের মঙ্গল করুন।
তার বেশ কিছু দিন পর অনেকটা কাঁকতলিয় ভাবেই হোমবুশ অলিম্পিক পার্কে বৈশাখী মেলায় ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ করেই মবিন ও রুবিনা ভদ্রলোকের দেখা পেয়ে যায়। প্রথমে তো নিজের চোখকে বিশ্বাসই হচ্ছিলো না। আলাপ পরিচয়ে জানা গেল তিনিও বাঙালী দেশ পশ্চিম বাংলায়। সিডনিতেই বাস রাজ্য সরকারের কোনও একটা বিভাগে কাজ করেন। মবিন ও রুবিনার অনেক পিরা পিরিতে পরের সপ্তাহের রোববার দুপুরে তাদের বাসায় আসার আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন। রুবিনা বার বার করে স্মরণ করিয়ে দিল যেন পরিবারের সবাইকে নিয়ে আসেন। তিনি অবশ্য বললেন যে আকস্মিক জরুরি কাজে মাঝে মধ্যেই তাকে ব্যস্ত হয়ে যেতে হয় তেমন কিছু না হলে নিশ্চয়ই আসবেন।
ভদ্রলোকটির জন্য কিছু একটা করতে পারছে বলে উৎসাহ ভরে মবিন বেশ ঘটা করেই বেশ কিছু বন্ধু বান্ধবদেরও দাওয়াত দিল সেই দিনের আয়োজনে। কিন্তু দুর্ভাগ্য বশতঃ ওই দিন সকাল বেলাই তিনি ফোন করে তার দাওয়াত রক্ষা করার অপারগতা জানিয়ে দুঃখ প্রকাশ করলেন। অফিসের কোনও একটা বিশেষ জরুরি কাজে নাকি সারা দিনই ব্যস্ত থাকতে হবে। তার পর আর এতদিন ভদ্রলোকের সাথে মবিনরা কোনও যোগা যোগ করার চেষ্টা করে নাই কিছুটা অসন্তুষ্ট হয়েই।
হঠাৎ করে তাকেই পুলিসের বেশে দেখে মবিন যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো মনে মনে আওড়ালো রাখে আল্লাহ মারে কে বড় বাচা বেঁচে গেলাম বোধ হয়। ভদ্রলোক কাছা কাছি আসতেই মবিন দরজাটা খুলে দাড়াতে দাড়াতে বলল আরে ভাই আপনি? Get back into the car please আমারে চিনতে পারেন নাই আমি.. Please remain in the car আরে.... Can I see your licence please লাইসেন্সটি নিয়ে ধীর গতিতে পুলিসটি তার নিজের গাড়িতে ফিরে গেলো।
সত্যি কি আমাকে চিনল না নাকি চিনে না চেনার ভান করছে কিছুই বলা যায় না নাকি ঘটি, এদেশে এসে অস্ট্রেলিয়ান বনে গেছে খুব ভালো হয়েছে যে আমার দাওয়াতে আসে নাই এই ধরনের মানুষের সাথে যোগ যোগ যত কম থাকে ততই ভালো।
লোকটি গাড়িতে ফিরে গিয়ে সম্ভবত টিকেটা লিখল এবং তা নিয়ে যখন ফিরে এলো, মবিন খুব ভালো ভাবে মনোযোগ দিয়ে তার চেহারাটা ঠাহর করতে চেষ্টা করল।
তাই তো - যদিও অবিকল একই ধরনের চেহারা তবুও একটু অন্য রকম মনে হচ্ছে না - আশ্চর্য, মানুষের চেহারার মধ্যে এত মিল থাকতে পারে? তাই হবে - এ পুলিস বেটা কোনও ভাবেই সেই লোক না। ও রকম একটা মানুষ, যে কিনা নিজের জীবনের পরোয়া না করে চলন্ত ট্রেনের সামনে ঝাঁপ দিয়ে অজানা একটি শিশুর জীবন রক্ষা করতে পারে - সে কোনও ভাবেই এ রকম কাটখোট্টা হতে পারে না।
মিছি মিছি সেই ভদ্রলোক, যার কাছে কিনা তারা চির কৃতজ্ঞ মেয়ের জীবন রক্ষার জন্য, তাকেই ভুল বুঝে অন্যায় ভাবে গাল মন্দ করার জন্য মবিনের ভীষণ অনুশোচনা হলো কাজটা একেবারেই ঠিক হয় নাই।
পুলিসটি ভাজ করা কাগজটি মবিনের হাতে দিয়ে তার গাড়ি নিয়ে চলে গেল। গাড়িটির চলে যাওয়া দেখতে দেখতে কাগজের ভাজ খুলে ভূত দেখার মত চমকে উঠল মবিন সে কি ঠিক ঠিক দেখছে? নিজেকে কিছুটা সামালে নিয়ে কাগজটা পড়তে শুরু করলো:
আপনার মত আমারও একটি মেয়ে ছিল, ছিল স্ত্রী। মেয়েটির বয়স যখন ছয়, ওকে আর ওর মাকে এক বেপরোয়া গাড়ি আমার কাছ থেকে চিরদিনের দিনের জন্য ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। বিচারে গাড়ির চালকের তিন মাসের জেল হয় ও তার সাথে কিছু একটা জরিমানা। জেল শেষে সে ফিরে গেছে তার স্ত্রী ও কন্যাদের কাছে। মন প্রাণ জুড়ে উপভোগ করতে পারছে স্ত্রীর ভালবাসা ও সন্তানদের মমতা।
আর আমাকে তো অপেক্ষা করতে হবে পরজন্ম পর্যন্ত - স্ত্রীর উষ্ণতা ও সন্তানের ভালবাসার আশায়।
সহস্র বার আমি চেষ্টা করেছি সেই গাড়ির চালকটিকে ক্ষমা করার। হয়ত বহু বার তাকে ক্ষমাও করেছি এমনকি এই মুহূর্তে হয়ত আবারও করলাম।
সবার মঙ্গলের জন্য বিধাতার কাছে প্রার্থনা করবেন ও সাবধানে গাড়ি চালাবেন। সদাই মনে রাখবেন - আপনার জন্য আপনার স্ত্রী ও কন্যা অপেক্ষা করে আছে। ভালো থাকুন।
*লেখকের নাম ও শিরোনাম বিহীন একটি ইংরেজি লেখার ছায়া অবলম্বনে রচিত।
মোস্তফা আব্দুল্লাহ, সিডনি
|