খেপুপাড়ার দিন রাত্রি মোস্তফা আব্দুল্লাহ
ততক্ষণে পশ্চিম আকাশের সূর্যটা অনেকটাই ঢুলে পড়েছে, সন্ধ্যা নেমে আসতে আর দুই আড়াই ঘণ্টার মত বাকি। অতি দ্রুত গতি সম্পন্ন স্পীড বোটের যাত্রী আমরা চার জন। চালক, আমি আর দুজন মার্কিনী – এসেছে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতা-উত্তর খাদ্য ও স্বাস্থ্য বিষয়ক তথ্যাদি আহরণের জন্য। উদ্দেশ্য বাংলাদেশের জনগণের কি ধরনের সাহায্য সহযোগিতার প্রয়োজন তা নির্ণয় করা। আমাকে সাথে নেয়া হয়েছে তাদের হয়ে স্থানীয় লোকাল গাইড হিসাবে। তখন মাত্র কিছু দিন হোল দেশ স্বাধীন হয়েছে, ইউনিভার্সিটির পাঠও ক্ষান্ত দিয়েছি – দক্ষিণাটাও বেশ লোভনীয়, তাই কাল বিলম্ব না করে কাজে নেমে পড়লাম। সেই যে চুক্তি ভিত্তিক কাজ শুরু করলাম – বাদ বাকি জীবনটা ওই কন্ট্রাক্ট-জব করেই কাটিয়ে দিতে হলো। যদিও একবার সরকারী চাকুরীতে ঢুকেছিলাম, তবে নয় মাসের মাথায় সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে বেশ কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিলো। এই যে দেখুন, ধান বানতে শিবের গীত গাওয়া শুরু করেছি। এই বদভ্যাসটা যেন বয়স বাড়ার সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে - সে কথা না হয় আরেক দিন হবে।
সপ্তাহ ধরেই প্রতিদিন সকালে বরিশাল শহর থেকে স্পীড বোট করে আমরা বেড়িয়ে পড়তাম বরিশাল ও পটুয়াখালীর বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে। আজ এসেছিলাম পটুয়াখালীর খেপুপাড়ায় – সেখান থেকেই বিকেল নাগাদ রওনা দিচ্ছি বরিশালের উদ্দেশে, ঘণ্টাখানেক বা তার থেকে কিছু বেশি সময়ের পথ হয়ত বা হবে। স্পীড বোটটা ধীর গতিতে চলে এসে খাল মুখ থেকে বড় নদীতে পড়তে যাচ্ছে, এমন সময় অন্য দিক থেকে আসা এক নৌকা থেকে এক বেদেনী জানতে চাইল “যাও কম্মে গোনে?” অর্থাৎ কোথায় যাবে? বরিশাল যাচ্ছি শুনে বেদেনী শঙ্কা প্রকাশ করে বলল; আঁধার হওয়ার আগে পোঁছতে পারবেতো? আমাদের ড্রাইভার তো হেসেই খুন; এইটা কি তোমার বৈঠা বাওয়া নাও নাকি? চক্ষের পলকে বরিশাল নিয়া যামু। “হে গেলে তো ভালোই - যাও” বলে বেদেনীর নৌকাটা পাশ কেটে খালের ভিতর ঢুকে গেল।
আমরাও ধীরে ধীরে খাল মুখ পেড়িয়ে নদীতে পরতেই আমাদের অতি উৎসাহী ড্রাইভার মহাশয় বোটটা সরা-সরি এক লাফে ফুল স্পীড দিয়ে চলতে শুরু করতেই সেটা একটা প্রচণ্ড রকম লম্ফ দিয়ে কাপতে কাপতে স্থির হয়ে গেল। আমাদের শঙ্কিত চেহারা দেখে ড্রাইভার অভয় দিয়ে জানালো ও কিছু না, কোথাও নাকি কি একটা ময়লা টয়লা জমে গেছে, খুইল্লা একটা ঝাঁকি দিয়া ঘষা দিলেই সব ঠিক ঠাক - এই এক মিনিটের ব্যাপার আর কি। মিনিটের পর মিনিট গড়িয়ে যেতে থাকল, বোটটাও ভাসতে ভাসতে ততক্ষণে অনেকটা নদীর মাঝখানে চলে এসেছে। আর চুপ করে থাকতে না পেরে ড্রাইভারকে বলতে হোল যে আপনি ঘষা দিয়া ঝাঁকি একটু পরে দিন, আপাতত বৈঠা দিয়ে বোটটাকে বেয়ে নিয়ে আবার খালের ভিতর ফিরে যান। ততক্ষণে খালের ভিতর দিয়ে নৌ চলাচলও কমে এসেছে, দু পাড়েও খুব বেশি একটা লোকজন দেখা যাচ্ছেনা, সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতে যে খুব একটা দেরি নেই! খেপুপাড়া তো দুরের কথা, বরিশালেই আমার জীবনের এই প্রথম আসা, সাথে দুই বিদেশি, দিনের আলো নিভু নিভু প্রায়, বৈঠা বেয়ে ধীরে ধীরে খালের ভিতর ঢুকছি, কোথায় যাচ্ছি জানি না! ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করে তেমন একটা সদুত্তর পাওয়া গেল না – বরং তার চেহারায় শঙ্কার ছায়া দেখে আমাদের হৃদ-মাঝারে যে কম্পন শুরু হয়ে গিয়েছিল তার বর্ণনা দেবার চেষ্টা আজ আর নাইবা করলাম।
কোথায় যাবো, কার কাছে সাহায্য চাইব, কি করবো - ভেবে কূল কিনারা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। আজ যখন সেদিনকার কথা মনে পড়ে – মনে মনে ভাবি আমাদের অবস্থা সেদিন সম্ভবত হয়েছিল কূল কিনারা হীন গভীর সমুদ্রে ঝড়ের মাঝে বিকল হয়ে যাওয়া নৌযানের কোন এক নাবিকের মত। এরকম একটা পরিস্থিতিতে একজন নাবিক কি করে? সম্ভবত প্রথমে ওয়্যারলেসের মাধ্যমে সাহায্যের চেষ্টা করে। কিন্তু সেটাও অকেজো, কোন উত্তর পাওয়া যাচ্ছে না, লাইফ বোট’টাও ঝড়ের ঝাপটায় ছিঁড়ে কোথায় চলে গিয়েছে, লাইফ জ্যাকেট’টা এই ঝড়ের তাণ্ডবের মাঝে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সবার কাছে সব চাওয়া বা সব দরজাই যখন বন্ধ – নাবিকটি তখনই মাত্র আকাশের দিকে মুখ তুলে বিধাতার সাহায্য কামনা করে! মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, বিধাতার এ কি রকম কৌতুক - আমাদের জন্য যখন এক মাত্র তার দরজাটি ছাড়া আর সবগুলো দরজায়ই বন্ধ করে দেন, তখনো কেন তিনি মাঝে মাঝে এ রকম “মাল্টিপল চয়েস” দিয়ে পরীক্ষা নেন আমাদের? এটা সম্ভবত অনেকটা আমাদের অফিস আদালতের “রিফ্রেশার ট্রেনিং” এর মত নয়কি? যে কথাটাকে সদাই মনে রাখার কথা, সেটাকেই হয়ত বা মনে করিয়ে দেয়ার জন্য।
সে সন্ধ্যায় আমি আকাশের দিকে মুখ তুলে চেয়েছিলাম কিনা মনে নাই, তবে আলবৎ, যত দোয়া দরুদ আর যত সুরা মুখস্থ ছিল তার সব কটাই যে অনবরত মনে মনে পড়ে চলেছিলাম সে ব্যাপারে একেবারেই নিঃসন্দেহ। দোয়া দরুদ পড়তে পড়তেই মনের চোখে ভেসে আসলো; খাল দিয়ে যাওয়া আসার পথে একটা পুলিশের চৌকি বা থানার মত কিছু একটা দেখেছিলাম না? ড্রাইভারও তেমন একটা কিছু দেখেছে বলাতে সাহস করে আর কিছুটা খালের ভিতর ঢুকতেই খাল পাড়েই থানার ঘড়টা চোখে পড়ল। বোট থেকে নেমে থানার কর্তব্যরত অফিসারকে আমাদের অবস্থার সবিস্তার বর্ণনা দেয়ার পর তিনি তার সাধ্যমত সব রকম সাহায্য সহযোগিতা করলেন। ওয়্যারলেস করে বরিশাল সদরে আমাদের অফিসে খবর পাঠাবার বন্দোবস্ত ও রাত্রি যাপনের জন্য কাছেই সরকারী রেস্ট হাউসে লোক সাথে দিয়ে আমাদের পৌছিয়েও দিলেন।
যুদ্ধ-বিধ্বস্ত স্বাধীনতা উত্তর পরিস্থিতিতে ওই রাতে, ওই স্থানে, যে একটা আশ্রয় পাওয়া গেছে আর তা যে তখন আমাদের জন্য এক পরম পাওয়া তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ঘড়টির মাঝে আসবাব পত্র বলতে ছিল কেবল মাত্র গোটা দুই নড়বরে চেয়ার, আর বালিশ ও তোষক বিহীন খটখটে একটা চৌকি মাত্র। কিন্তু এর কিছুই ওই মুহূর্তের চরম প্রাপ্তির উচ্ছ্বাসকে এতটুকু পর্যন্ত ম্লান করতে পারে নাই। পদার্থ বিজ্ঞানের ছাত্র হয়েও থিওরি অব রিলেটিভিটির মর্মার্থ সেই রাত্রিতে যেভাবে অনুধাবন করতে সামর্থ্য হয়েছিলাম, আমার মনে হয় স্বয়ং আইনস্টাইন এসে বুঝিয়ে বললেও সেভাবে বুঝতাম কিনা হলপ করে বলতে পারব না!
বাকি রাতটুকু হেটে বসে গাল গপ্প করেই যে কাটিয়ে দিতে হবে তা নিয়ে কারো মনে কোন দ্বিধা দ্বন্দ্বের অবকাশ ছিল না। কিন্তু বাদ সাধল বিদেশী দুজনের সাথে নিয়ে আসা পানিয়-জল ফুরিয়ে যাওয়া ও চতুর্দিক থেকে মশক বাহিনীর যুগপৎ আক্রমণ। কদিন ধরেই আবহাওয়ার অব্যাহত নিম্নচাপের ফলে সৃষ্ট ভ্যাঁপসা গরমে দুজনে ভিজে জবজবা আর এদিকে তাদের খাবার পানিও প্রায় শেষ – এ ভাবে চলতে থাকলে ওই দুজন ভোর হওয়া পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে কিনা সন্দেহ – আবার অন্য দিকে ওখানকার পানি খেলে রাতেই যে অক্কা পাবে না তাও তো বলা যায় না! ঘামে ভিজা গায়ের শার্ট খুলতেই মশাগুলো যেন দ্বিগুণ উৎসাহে মেতে উঠে সাহেব দুজনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। আমি আর ড্রাইভার হাতের কাছে যা ছিল তা দিয়েই মশা তাড়াবার ব্যর্থ চেষ্টায় ক্ষান্ত দিয়ে যার যার আপন প্রাণ বাঁচাতে মননিবেশ করলাম। এমন সময় হারিকেন হাতে এক মাঝ বয়স্ক ভদ্রলোক এসে সালাম দিয়ে জানলেন যে তিনি কাছের বাড়ীটাতেই থাকেন – থানা থেকে খবর পাঠিয়েছে যেন আপনাদের একটু খোঁজ-খবর করি। আলাপে জানতে পারলাম তিনি স্থানীয় স্কুলের একজন শিক্ষক। জানতে চাইলেন রাতের খাবারের কোন বন্দোবস্ত হয়েছে কিনা। সেই ক্ষণে বিদেশী দুই জনের জন্য একমাত্র বিশুদ্ধ খাবার পানি ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারছিলাম না। অন্তত কটা ডাব পাওয়া গেলেও হয়ত রাতটা পার করা সম্ভব হতো। গ্রাম গঞ্জে মাঝ রাতে গাছে উঠে কেও যে সেটা পেড়ে আনবে না - জেনেও মাস্টার সাহেবের কাছে কথাটা পাড়লাম।
খানিক বাদে একজন একপ্রস্ত তোষক বালিশ ও একটা মশারি দিয়ে গেল সাহেবদের মশার কামড় থেকে পরিত্রাণ পাবার জন্য। দুজনের অবস্থা ততক্ষণে আরও করুণ – গা দিয়ে দর দর করে ঘাম ঝরছে, পানির পিপাসায় চোখ মুখে ঢুলু ঢুলু ভাব, মশার কামড়ে সারা গায়ে লাল লাল দাগ। দুইজনকে এক বিছানায় এক মশারির নিচে চিন্তা করতে যদিও মনে মনে হাসি পাচ্ছিল তবুও উপায়ন্তর না দেখে সেই প্রস্তাবটাই করলাম। মশার হাত থেকে নিস্তার পাওয়ার জন্য তারা তখন যে কোন কিছু করতেই প্রস্তুত। দুজনকে মশারির ভিতর বসিয়ে দিয়ে আমরা দুজন বারান্দায় নড়বড়ে চেয়ার দুটোতে বসে মাঝ রাতের নিস্তব্ধতায় কাছ থেকেই ভেসে আসা সমুদ্রের গর্জন শুনছিলাম আর ড্রাইভারের মুখে শুনলাম যে গত বড় ঘূর্ণিঝড়ের সময় এ ঘড়টার চলার ওপর দিয়েই নাকি পানি গেছে! হঠাৎ ঘরের ভিতর থেকে একটা হুড়মুড় শব্দ পেয়ে ছুটে গিয়ে দেখি মশারি টশারি ছিঁড়ে দুইজনই খাট থেকে নেমে নিচে দাঁড়িয়ে আছে। কি ব্যাপার? কিছুক্ষণ মশারির ভিতর বসে থাকার পর নাকি তাদের দম বন্ধ হয়ে মরার যোগার – তাই উপায়ন্তর না দেখে প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে ছুটে বেরিয়ে এসেছে!
মাস্টার সাহেব আবার ফিরে এলেন, পেছনে দুজন লোক, একজনের হাতে সদ্য গাছ থেকে পারা এক কাঁদি ডাবের ছরা ও অন্যজনের হাতে গামলা ভর্তি ভাত ও টকটকে লাল ঝোলের মুরগীর মাংসের তরকারি! আমি এখনো ভেবে পাই না কেমন করে মাস্টার সাহেব সেই রাত বিরাতে কাওকে গাছেই বা উঠতে রাজি করালেন আর কেমন করেই বা মুরগি জবেহ করলেন। এই দুটোই আমাদের দেশ-গ্রামের কুসংস্কার পূর্ণ বিশ্বাসের কারণে একেবারেই অসম্ভব ব্যাপার! ওই মুহূর্তে আর এ নিয়ে ভাবার অবকাশ ছিল না। তৎক্ষণাৎ কয়েকটা ডাব কেটে সাহেবদের প্রাণ ফিরে পাওয়ার ব্যবস্থা করা গেল।
তরকারীতে সম্ভব্য ঝাল মসলার আধিক্যের কথা ভেবে ওদের দুজনকে সেটা না খাওয়ারই পরামর্শ দিলাম। কিছুক্ষণ ভেবে তারা জানলো যে সেটা সম্ভব নয় – তাতে মাস্টার সাহেব ও যারা এই মাঝ রাতে ওই সব রান্না করেছেন, তাদের সেই পরিশ্রম ও উদ্দেশের প্রতি অসম্মান প্রদর্শন করা হবে। তারা যদি আমাদের জন্য রাত বিরাতে এতটা কষ্ট করতে পারে, আমাদের যতই অসুবিধাই হোক না কেন, আমারা কি এইটুকু অসুবিধা মেনে নিতে পারবনা? খেতে যত কষ্টই হোক এবং তার পরিণতিতে যত শারীরিক অসুস্থতাই হোক না কেন – তারা তা মেনে নিয়ে মাস্টার সাহেব ও তার পরিবারের প্রতি সম্মান ও কৃতজ্ঞতা প্রদর্শনের জন্য খাবেন বলেই মনস্থ করলেন। যতদূর মনে পড়ে, মুরগীর মাংসের টুকরাগুলি ঝোল থেকে উঠিয়ে ডাবের পানি দিয়ে ধুয়ে নেয়ার পর তারা কিছুটা খেতে পেরেছিলেন।
ভোর হওয়ার কিছু পর থানা থেকে খবর আসলো যে বরিশাল থেকে অন্য একটা বোট এসেছে আমাদের ফিরিয়ে নেয়ার জন্য। মাস্টার সাহেব ও থানার কর্মকর্তা আমাদের খাল ঘাটে বিদায় জানালেন। তাদের দু’জনের কাছে আমাদের অশেষ কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানাতে গিয়ে মাস্টার মশায়ের হাত ধরে যেমনি বলেছি, “স্যার, আপনার ও আপনার পরিবারের প্রতি আমাদের ঋণ আমারা কোন দিন পরিশোধ করতে পারবোনা”ওমনি তিনি আমার হাতটা ছাড়িয়ে জোড়-হাত করে বিনীত ভাবে বললেন, “ছি ছি আপনি একি বলছেন, আপনাদের মতন জ্ঞানী-গুণী শিক্ষিত মানুষ আমাকে স্যার বলে অপরাধী করবেন না!”
আজ যখন ওই দিনটির কথা মনে পড়ে তখন ভাবি জীবনে কতজনকেই তো স্যার বলে সম্বোধন করেছি, বা করতে হয়েছে। তাদের সবাই কি সত্যিকারের “স্যার” বলে সম্বোধন পাওয়ার যোগ্য ছিল?
মোস্তফা আব্দুল্লাহ, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া
|