ছোট গল্প হিশামুদ্দিনের হিসাব মোস্তফা আব্দুল্লাহ
হিশামুদ্দি নিজেকে সব সময়ই খুবই ব্যস্ত রাখে। ব্যস্ত না থাকতে পারলে হিশামুদ্দির বিশ্বাস তার জীবনের কোন মানেই থাকল না, মিছে মিছি সময়েরও অপচয়। এছাড়া অন্যের কাছে তার কোন প্রয়োজনও থাকবে না, না কেও তাকে সমীহের দৃষ্টিতে দেখবে – না কেও তাকে হিসাবে নেবে! হিশামুদ্দির জীবনে অন্যদের হিসাবটাই মুখ্য।
তাই প্রতিদিন সকালে উঠে নিয়মিত প্রাত্যহিক কিছু কাজ সেরে নেয় হিশামুদ্দি। টেলিভিশনের খবরটা দেখা - যদি তেমন কিছু ঘটে থাকে গত রাতে। খবরের কাগজে চোখ বুলানো – এমন কিছু তো ঘটেও থাকতে পারে গত কাল? গিন্নিকে সাবধান করা যাতে বাচ্চাদের স্কুলে যেতে দেরি না হয়; গাড়ি, না বাসে, না ট্রেনে যাবে। হিশামুদ্দি সব সময়ই ত্রস্ত ভাবনায় – কখনো ভ্রূ কুচকিয়ে, কখনো বা চোখ বন্ধ করে। হিশামুদ্দি প্রতিদিন অফিসে গিয়ে জমে থাকা কাজ গুলোর বিহিত করে। সে যদি কর্মচারী হয়ে থাকে তাহলে নিশ্চিত হতে চায় যে বড় বাবু তাকে সময় মত কাজে হাজির হতে দেখেছে। আর যদি নিজেই বড় বাবু হয়, তরি ঘড়ি করে সবাইকে কাজে লাগানোই তার কাজ। খুব একটা জরুরী কাজ যদি হাতে না পায় – হিশামুদ্দিকে কিছু একটা খুঁজে বার করতেই হবে, নতুবা আটতে হবে নূতন কোন পরিকল্পনা। হিশামুদ্দি সর্বদাই খুবই ব্যস্ত মানুষ। ব্যস্ত না থাকতে পারলে যে জীবনটাই শূনের খাতায়।
হিশামুদ্দি যদি বড়-বাবু হয় তা হলে লাঞ্চের সময় সতীর্থদের সাথে বসে নূতন নূতন কর্ম-পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করবে, প্রতিদ্বন্দ্বীদের খুঁত খুঁজে বের করবে আর গর্বের সাথে অভিযোগ করবে যে তাকেই মাত্রাতিরিক্ত কাজ করে যেতে হয়। আর সে যদি নিজে বড়-বাবু না হয় তা হলে বন্ধুদের সাথে বসে বড়-বাবুদের ভুল গুলো খুঁজে বার করবে, নিজের খাটুনির কথা জানাবে আর কিছুটা উৎকণ্ঠা ও গর্বের সাথে সবাইকে বোঝাবে যে অফিসের গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলি সমাধা করার জন্য তার আর কোন বিকল্প নাই। হিশামুদ্দি বড়-বাবুই হোক আর কর্মচারী হোক, বিকেল গড়িয়ে যাওয়া পর্যন্ত কাজ করবে, মাঝে মাঝে ঘড়ি দেখবে – শেষ অব্ধি টুক টাক সব কাজ সমাধা করে তার পর বাড়ির পথে রওনা দেবে। হিশামুদ্দিন সত্যই একজন সজ্জন – সর্বদাই অন্যদের প্রত্যাশা পূরণে নিবেদিত।
দিন শেষে ঘড়ে ফিরে কাপড় চোপড় বদলে ফ্রেশ হয়ে খাবার টেবিলে বসে গিন্নিকে সারা দিনের খবর জিজ্ঞেস করে হিশামুদ্দি – ছেলে মেয়েদের কাছে জানতে চায় স্কুল ও হোম ওয়ার্ক এর খবর। ছেলে মেয়েদের সময়ের খুব অভাব – তাড়াতাড়ি যে যার কম্পিউটার বা ট্যাব নিয়ে সরে পরে। গিন্নি বাসন কোসন গোছাতে ব্যস্ত। হিশামুদ্দি টেলিভিশন এর সামনে গিয়ে বসে, সারা দিনের ঘটনা গুলি জানা খুবই জরুরী। শুতে যাবার সময় হিশামুদ্দি একটা কর্মক্ষেত্রে সফলতা বিষয়ক জার্নাল নিয়ে শুতে যায় – কর্মচারীই হোক বা কর্মকর্তাই হোক, এই প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকতে হলে হাল-নাগাদ জ্ঞান আহরণ একান্তই জরুরী। স্ত্রীর সাথে কিছু মৃদু আলাপ, হাজার হোক হিশামুদ্দি একজন যোগ্য পরিবার প্রধান, সে পরিবারের জন্য জান কোরবান পর্যন্ত করে দিতে পারে।
এক সময় হিশামুদ্দি ঘুমিয়ে পরে। স্বপ্নে দেখতে পায় দেবদূত তাকে প্রশ্ন করছে;
"তুমি এমন করে চলছ কেন?"
"আমি যে একজন দায়িত্ববান ব্যক্তি, আমার চার পাশের সবাই আমাকে একজন দায়িত্ববান হিসাবে গণ্য করবে এটাইতো আমার কাম্য"।
"তোমার চার পাশের সবার চোখ দিয়ে না দেখে, নিজের চোখ দিয়ে কি তুমি নিজেকে ও তোমার নিজের চার পাশটা একবার ভাল করে দেখবে? দিনে মাত্র পনর মিনিটের বিরতি নিয়ে, আত্ম উপলব্ধি করবে মাত্র পনর মিনিটের জন্য - সমস্ত কাজ কর্ম বন্ধ করে?"
"সেটা করতে পারলে খুবই ভাল হয়, কিন্তু আমার হাতে যে একেবারেই সময় নাই"
"তুমি ভুল বলছ - সবার কাছেই সময় আছে, কিন্তু সবার সাহস নাই এই পনর মিনিটের আত্ম উপলব্ধির আশীর্বাদকে আলিঙ্গন করার"।
গায়ে হিম-কাটা দিয়ে হিশামুদ্দির ঘুম ভেঙে যায়।
সাহস? যে পরিবার জন্য জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করতে পারে, যে চার পাশের মানুষের তুষ্টি অর্জনের জন্য নিজের অস্তিত্বকে পর্যন্ত ভুলতে বসেছে, সে কিনা দিনে মাত্র পনর মিনিটের জন্য সব কর্ম কাণ্ড বন্ধ করে থাকতে পারবে না? বহুদিন পর হিশামুদ্দি নিজের মনে মনেই হেসে উঠল। যাক, এটা কেবল একটা স্বপ্নই মাত্র। হিশামুদ্দি আবার ঘুমাতে যায়।
হিশামুদ্দি অবিশ্রান্ত ভাবে তিরিশ বৎসরের ওপর কাজ করে যায়। সন্তানাদিদের মানুষ করে, নিজেকে এক জন যোগ্য অভিভাবক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করে পরিবার এর কাছে। কিন্তু একবারও কি নিজেকে প্রশ্ন করে – কেন এসব, কিসের জন্য? তার একটাই ভাবনা; সে যতটা ব্যস্ত থাকতে পারবে, এ জগত তাকে ততটাই গুরুত্ব দেবে! অন্যের খাতার হিশাবটাই হিশামুদ্দির কাছে মুখ্য বিষয়।
এক দিন ছেলেমেয়েরা লেখা পড়ার পাট চুকিয়ে যে যার সংসার গুছিয়ে যার যার পথে চলে গেল। হিশামুদ্দি অফিস থেকে একটা কলম বা ঘড়ি, আর সাথে একটা মানপত্র উপহার নিয়ে বাড়ি ফেরে সুদীর্ঘ কর্ম জীবনের কর্তব্যপরায়নতার নিদর্শন হিসাবে। সে এখন একজন মুক্ত মানুষ, এটাই তো বোধ হয় সে চেয়েছিল? মনে মনে ঠিক করে, কদিন বিশ্রাম করার পর প্রতি দিন পনর মিনিটের বিরতি নিয়ে নিজের নিয়ে চার পাশটা ভাল ভাবে দিনে অন্তত একবার করে দেখবে, দেখবে নিজের দিকে, মাত্র পনর মিনিটের জন্য - সমস্ত কাজ কর্ম বন্ধ করে।
শুরুতে কিছু দিন মাঝে মধ্যে পুরানো অফিসটা ঘুরে এলো – ঘুম থেকে উঠলো একটু বেলা করে, যা কিনা সে বহুদিন করতে চেয়েছে। পাড়া পড়শিদের সুনজরে আসার জন্য বহুদিনের অবহেলিত বাগানটার কাজে লেগে গেল। ব্যস্ত হতে পারায় হিশামুদ্দির মনটা আবার ফুরফুরিয়ে উঠলো। কিছুদিন পর বুঝল যে গাছগুলো যার যার নিজের নিয়ম মাফিক কলি ছাড়িয়ে ফুল ফোটায় - অন্যের ইচ্ছায় নয়। যাদুঘর, লাইব্রেরি, চিরিয়াখানা ঘুরে ঘুরে দেখল – বেরিয়ে গেল দেশ ভ্রমণে। তুলল হাজারো ছবি – বন্ধু বান্ধব দের পাঠাতে হবে না? তা না হলে সবাই বুঝবে কেমন করে যে সে কতটা সুখী!
হিশামুদ্দি এখন আরও বেশি সময় ধরে টেলিভিশন দেখে, হাতে অফুরন্ত সময়। দেশ বিদেশের বিভিন্ন খবরা খবর অনেকক্ষণ ধরে মনোযোগের সাথে শুনে নিজেকে বেশ ওয়াকিবহাল বলে মনে হয়। খুঁজে ফিরে কারো সাথে সে সব বিষয়ে আলাপ আলোচনা করার জন্য। কিন্তু হিশামুদ্দির চার পাশের সবাই ব্যস্ত, ব্যস্ত নিজেদেরকে অন্য সবার কাছে অতীব প্রয়োজনীয় করে তুলতে। ছেলে মেয়েরা মাঝে মধ্যে ছুটি ছাটায় দেখা করতে আসে – হিশামুদ্দি মনে মনে ভাবে নিশ্চয়ই সে নিজেকে একজন যোগ্য পিতা রূপে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে।
হিশামুদ্দি ভাবতে ভাবতে এক সময় ঘুমিয়ে পরে। স্বপ্নে বহুদিন পর দেবদূতকে দেখে অনেকটা আড়ষ্ট হয়ে বলে;
"দেবদূত, এখন আমার হাতে অফুরন্ত সময়, প্রতি দিন পনর মিনিটের সময় নিয়ে আমি নিজের দিকে ও আমার নিজের চার পাশটা দেখার জন্য প্রস্তুত"।
"আমি তো দেবদূত নই, আমি যে যমদূত। আমার হাতে তো আর ক্ষণিকেরও সময় নাই – এখনই যে তোমাকে আমার সাথে যেতে হবে। বাল্যশিক্ষার প্রথম পাঠে কি কখনো পড় নাই; আজকের কাজ কালকের জন্য কখনো ফেলে রাখতে নাই।"
"তাতো পড়েছি বহুবার গুরুদেব – পড়তে পড়তে মুখস্থ করে ফেলেছি সেই বালক বয়স থেকেই"। *বিশ্বখ্যাত ব্রাজিলিয়ান লেখক Paulo Coelho এর তিন পর্বে লেখা Manual নামক লেখাটির ছায়া অবলম্বনে রচিত।
মোস্তফা আব্দুল্লাহ, সিডনি
|