হালাল খাবার ও সাম্প্রদায়িকতা মোস্তফা আব্দুল্লাহ
সম্ভবত ঈদের পর দিন, ৭ই জুলাই সন্ধ্যা। চ্যানেল নাইন এর কারেন্ট এফেয়ারসে অস্ট্রেলিয়াতে হালাল খাবারের ওপর একটা আলোচনা চলছিল। নানা জনে নানা মত দিচ্ছিলেন। এর মাঝে এক মহিলা বললেন তিনি অনেক অনুসন্ধান করে বের করেছেন যে হালাল খাবার অন্যান্য খাবার থেকে অস্বাস্থ্যকর ও তা খেলে নানা ধরনের রোগ বালাই, এমন কি ক্যান্সার হওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে। আমার ধারনা তার এই ধরনের কথা মনে হওয়ার কারণ হালাল খাবার সম্বন্ধে তার অজ্ঞতা। জবেহ করা পশুর শরীর থেকে রক্ত প্রায় পুরোপুরি বের হয়ে যায় বলে এই পন্থা অনেক বেশি স্বাস্থ্য সম্মত। উপরিউক্ত মহিলা হালাল খাবারের স্বাস্থ্যগত দিকটির কথাই শুধু আলোচনা করেছেন কিন্তু কয়েক দিন আগে সিডনীতে অনুষ্ঠিত এক আলোচনা সভায় এক বক্তা হালাল খাওয়ার সাথে বাংলাদেশের মানুষের সাম্প্রদায়িকতার একটা যোগ সূত্র খুঁজে বের করেছেন। আলোচনার বিষয় ছিল "মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনা এবং আজকের বাংলাদেশ"। সেখানে জনৈক বক্তা বলেছেন; "এক সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহসিন হলের যে বন্ধুটিকে মহসিন হল থেকে জগন্নাথ হলে নিয়মিত খেতে আসতো, সেই বন্ধুটি এখন হারাম-হালাল নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তর্ক করে, হালাল ছাড়া খায় না"। এখানে খেয়াল রাখতে হবে বাংলাদেশের প্রায় নব্বুই শতাংশ মানুষ মুসলিম এবং তারা ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে হালাল খেয়ে থাকে। বাংলাদেশে হাটে বাজারে যে মাংস বিক্রি হয় তা মূলত হালাল মাংস। বক্তা প্রকারান্তরে এই বিশাল জনগোষ্ঠীকেই হালাল খাওয়ার কারণে সাম্প্রদায়িকতার দোষে দুষলেন!
হালাল বা হারাম খাওয়ার জন্য যে কেউ সাম্প্রদায়িক বা অসাম্প্রদায়িক হয় না। এটা কোন অস্বাভাবিক বিষয় নয় যে কেউ জীবনের কোন এক সময় ধর্মীয় অনুশাসন সমূহ পুরোপুরি মেনে না চললেও পরবর্তীতে তা পরিপূর্ণ ভাবে পালন করার চেষ্টা করতে পারে। বরং এটাই আমাদের উপমহাদেশের জন্য স্বাভাবিক – যেখানে বেশির ভাগ মানুষই বয়োবৃদ্ধির সাথে সাথে ধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়ে। এটা সব ধর্মের মানুষের জন্যই কমবেশি সত্যি। তাহলে বিশেষ এক ধর্মানুসারীদের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ কেন?
সাম্প্রদায়িকতার সূতিকাগার মূলত অসুস্থ রাজনীতি। লোভ, লালসা, পরশ্রীকাতরতা ও অন্যায় ক্ষমতার লিপ্সা জন্ম দেয় সাম্প্রদায়িক মানসিকতার। সেটা বাংলাদেশের টারগেটেড কিলিং এর বেলাই হোক আর ২০০২ সালে গুজরাটে মুসলিম নিধনের বেলাই হোক, কারণটা সব ক্ষেত্রে একই। যে ব্যক্তিটি অন্য সম্প্রদায়ের প্রতি অহেতুক ঘৃণা বা বিরাগ ভাব পোষণ করে সে নিশ্চয়ই সাম্প্রদায়িকতার দূষণে দূষিত। তবে যে অন্য সম্প্রদায়ের ধর্মীয় সঙ্গত আচার আচরণে আপত্তি জানায় তাকেই বা অসাম্প্রদায়িক বলি কি করে। এই অসাম্প্রদায়িকতা প্রমাণের প্রয়াসের একটি ঘটনার কথা এখানে উল্লেখ না করে পারছি না। বেশ কিছুদিন আগে এই সিডনি শহরে একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস উপলক্ষে এক অনুষ্ঠানে আয়োজকদের পক্ষ থেকে উদ্বোধনি বক্তৃতায় আস’সালামো-আলাইকুম বলে শুরু না করার প্রস্তাব করেন জনৈক ব্যক্তি। তিনি আরও প্রস্তাব করেন; সভা শেষে শহীদের রুহের মাগফেরাত কামনা করে প্রস্তাবিত মোনাজাত টিকেও অনুষ্ঠান সূচি থেকে বাদ দেয়ার জন্য। তার বিশ্বাস এতে উপস্থিত অমুসলিমরা বিব্রত বোধ করতে পারে। যদিও যাদের উদ্দেশে মোনাজাত করার কথা তারা সবাই মুসলমান। সালাম, রফিক জব্বার, বরকত যদি অন্য কোনো ধর্মের অনুসারী হতো তাহলে তাদের নিজ নিজ ধর্মানুসারেই তাদের জন্য প্রার্থনার করার প্রস্তাবে কারো আপত্তি থাকতো বলে আমার মনে হয় না। ধর্ম পালন সাম্প্রদায়িকতা নয়। কোনো বিশেষ ধর্মের প্রতি অন্যায় পক্ষপাতিত্ব সাম্প্রদায়িকতা।
আবার ফিরে যাওয়া যাক কয়েক দিন আগের সিডনীতে অনুষ্ঠিত সেই আলোচনার সভার কথায়। ওই একই বক্তা আরও অভিযোগ করেছিলেন "ব্যক্তিগত ভাবে অনেকেই হিন্দুদেরকে বন্ধু বলে গ্রহণ করে কিন্তু সমষ্টিগত ভাবে হিন্দুদেরকে ঘৃণা করে"। এ অভিযোগ সত্য হতে পারে না কেননা ব্যক্তিকে নিয়েই সমাজ তৈরি হয়। হিন্দুদেরকে কি কারণে কিভাবে ঘৃণা করা হয় সে সম্বন্ধে তার আলোক পাত করা উচিত ছিল।
ঘৃণার কথা যখন উঠেছে ছোট বেলার একটা ঘটনার কথা না বলে পারছি না। আমি তখন সবে মাত্র সাত বছর বয়সের, ঢাকা থেকে দেশের বাড়িতে বেড়াতে গেছি, হিন্দু মুসলমান বাড়ীর নিয়ম কানুন চাল চলন এর কিছুই জানি না। খেলতে খেলতে বল খুঁজতে গিয়ে হিন্দু প্রতিবেশীর রান্না ঘরে ঢুকে পরেছিলাম। এর জন্য ফুফুদের বকুনি ও মার হাতে কান মলাও খেয়েছি। সেদিন যদিও আমার অপরাধটা কোথায় তা বুঝে উঠতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল, তবে পরে তাদের ওই দিনকার সমস্ত রান্না করা খাবার ফেলে দেয়ার কারণ জানার পর তাদের ব্যাবহার আর অস্বাভাবিক মনে হয়নি। সেটা তারা করেছিলেন তাদের ধর্মবিশ্বাসের কারণে।
১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর এই প্রথম বারের মত, বর্তমান সরকারের একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ হোল সংখ্যা লঘুদের প্রতি সুবিচার ও তাদের সব ধরনের সুযোগ সুবিধার অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করা। তারপরও কেন এই সরকার ও দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে দোষারোপ করা হচ্ছে সেটা জানা বোধ হয় সবার জন্যই মঙ্গল জনক।
যদিও আলোচনার বিষয় ছিল "মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনা এবং আজকের বাংলাদেশ", বক্তারা হয় ভুলে গেছেন কিম্বা সযত্নে পরিহার করে গেছেন; মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনা নিয়ে যারা আজকের এই বাংলাদেশকে নয় মাস সংগ্রাম করে লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে ছিনিয়ে এনেছেন, তাদের প্রায় সবাই হালাল খাওয়া মানুষ। অর্থাৎ উক্ত বক্তার ভাষায় "সাম্প্রদায়িক"।
কারো ধর্মীয় অনুভূতিকে আঘাত করে কোন আলোচনা মুক্ত চিন্তার সনদ পেতে পারে, তবে তা কোন ভাবেই সুস্থ চিন্তার বহিঃপ্রকাশ হতে পারে না। এই আলোচনা সভার একজনকে বিশেষ সাধুবাদ জানাতে হয়। তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ অস্ট্রেলিয়া শাখার সভাপতি ব্যারিস্টার সিরাজুল হক; সভার মূল বক্তব্যের সাথে দ্বিমত পোষণ করার জন্য।
বাঙলা সাহিত্যের অপরাজেয় কথাশিল্পী শরৎচন্দ্রের একটি উপন্যাসে উক্তি ছিল "বাঙালীদের সাথে মুসলমানদের ফুটবল খেলা"। কিছুটা হলেও আশাবাদের সাথে বলতে পারি যে সেদিনকার সেই মন মানসিকতাকে উৎরিয়ে আজ আমরা অনেকটাই এগিয়ে যেতে পেরেছি। তবুও আমাদের মাঝে এখনো যে এখানে সেখানে স্বার্থ সিদ্ধির উদ্দেশ্যে সাম্প্রদায়িকতার দানব মাথা চাড়া দিয়ে উঠবে না সেটা হলপ করে বলা শক্ত। তাই আসুন আমরা একে অপরকে শুধু অভিযোগ না করে সবাই মিলে এই অশুভ শক্তিকে প্রতিহত করার জন্য হাত মিলাই।
মোস্তফা আব্দুল্লাহ, সিডনি
|