গল্প গল্পের ভেতরে গল্প মোস্তফা আব্দুল্লাহ
 - ঠিক আছে মা, বুঝেছি – শুয়ে পড়ব এক্ষণই - টেলিভিশনের শব্দ শুনছি, ওটা বন্ধ করে দাও – টেলিভিশন দেখতে থাকলে তোমার হুশ থাকে না। - বন্ধ করছি মা - ভালো করে দেখে শুনে দরজা জানালা বন্ধ করে শোবে – ঠাণ্ডা যেন না লাগে। - মা, এখন সবে মাত্র এপ্রিল মাস, এখনি ঠাণ্ডা আসবে কোথা থেকে? - কথা বাড়িও না, যা বলছি তাই কর। - ঠিক আছে মা, দরজা বন্ধ করব, ছিটকি দেব, তালা লাগাবো, জানালা সিল গালা করবো, তার পর ঘুমাতে যাবো! - পাকামো করোনা আমার সাথে – এখন শুতে যাও, কাল সকালে আবার ফোন করবো।
মা নিশ্চয়ই ফোনটা স্পীকারে দিয়ে কথা বলছিল। ফোনটা রাখতে রাখতে পেছন থেকে হেমা আর রিমার হি-হি হাসির শব্দ কানে গেল। যাক এখন থেকে ওই দুষ্ট দুটোর যন্ত্রণা আর পোহাতে হবে না জুবেরকে। মা দুর থেকে আর কতই বা তার ওপর নজর দারি করতে পারবে।
বছর দুই-এক বয়সের সময় জুবের বাবা-মায়ের সাথে অস্ট্রেলিয়াতে আসে। সিডনীর উত্তরাঞ্চলে বসবাস, বোন দুটোর জন্ম এদেশেই। পড়াশোনায় সবসময়ই তুখোড় জুবের। ইউনিভার্সিটি পরীক্ষার ফল বেরনোর আগেই এডেলেইড এর এক খ্যাতনামা হাই-টেক কোম্পানির কাছ থেকে লোভনীয় চাকুরীর প্রস্তাব পায়। মা ছেলেকে একা একা এত দুরে ছেড়ে দিতে রাজি নন। বাবা এত ভাল সুযোগ হাতছাড়া করার বিপক্ষে। আর এ দিকে জুবের এর এই ধরনের কাজই পছন্দ। অবশেষে বাপ-বেটার কাছেই হার মেনে নিতে হোল মাকে।
জুবেরের ফ্ল্যাটের বারান্দার কাঁচের দরজাটা খুলে দাঁড়ালে চোখে পড়ে এক ঘন সবুজ বনাঞ্চল। নয় তালার বারান্দা থেকে দিনের আলোতে সবুজের ফাকে ফাকে রং-বেরঙের চোখ ভোলানো সমারোহ। অন্ধকার রাতে মনে হয় পুরো বনটাই যেন একটা কালো চাদর জড়িয়ে বসে থাকে। গা’টা কেমন ছম-ছম করে। ওই অন্ধকারের মাঝে কি লুকিয়ে থাকতে পারে? চিন্তাটা ঝেড়ে ফেলে কাঁচের দরজা দুটো টেনে বন্ধ করে ঘরে ফিরে আসে জুবের। সে এখন একজন প্রাপ্ত বয়স্ক স্বাধীন যুবক। ওসব ঠাকুরমার ঝুলির ভুত-পেত্নীর গল্প কি আর ওকে মানায়? দেয়ালের সদ্য পেইন্টে সামান্য মাদকতার আবেশ এখনো রয়ে গেছে কিছুটা। জুবের সেদিন বিকালেই তার হোটেল রুম ছেড়ে এই নূতন ভাড়া করা ফ্ল্যাটে এসে উঠেছে। সদর দরজা দিয়ে ঢুকতেই মাঝারি সাইজের বসার ঘর, হাতের বায়ে রান্না ঘর, খাবার টেবিল। ডান দিকে বাথ রুম আর শোবার ঘরটা। মোটামুটি খোলা-মেলা, বসার ঘরের বড় কাঁচের দরজা খুলে দিলে আলো বাতাসের কমতি নেই। একটা লাউঞ্জ সেট আর দেয়ালে ঝোলানো টেলিভিশন এর মুখো-মুখী আরাম করে শুয়ে বসে টেলিভিশন দেখার জন্য রিক্লাইনার সোফা। এক কোনে ছোট্ট একটা সাইড টেবিলের ওপর টেলিফোনটা রাখা। মোটা মুটি পছন্দসই। কেবল মাত্র বাথ রুমের বেসিনের লিক করা কল থেকে টপ টপ করে পানি পড়ার আওয়াজটাই একঘেয়েমি। কাল সকালেই ম্যানেজারকে জানাতে হবে এর একটা বিহিত করার জন্য।
অফিস করে দিন শেষে হোটেল ছেড়ে এই নূতন বাসাতে ওঠাটা বেশ ক্লান্তিকর ছিল। তাই একটু তাড়াতাড়িই শুয়ে পড়ার প্রস্তুতি নেয় জুবের। মার বকুনির কথা মনে হতেই সদর দরজার ছিটকানিটা লাগিয়ে ভাল করে পরখ করে নিলো। বেসিনের কলের পানির টপ টপ আওয়াজটা বেশ বিরক্তিকর। তবে কিছুক্ষণ পর সেটা দেয়াল ঘড়ির টক-টক ছন্দের সাথে মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়। এক ধরনের ঐকতানের আমেজে গভীর ঘুমে নেতিয়ে পড়ে জুবের।
ঠক ঠক ঠক, দরজায় টোকা দেয়ার শব্দ – কিছুক্ষণ পর আবার। এবার নিশ্চিত যে এটা তারি দরজায় - স্বপ্নে নয়।
দরজার কি-হোলে চাবি ঢোকানোর খর-খর শব্দ। জুবের বিছানা থেকে উঠে লাফ দিয়ে পরখ করে দেখে ভিতর থেকে ছিটকানিটা ঠিক মত লাগান আছে তো? কি করবে এখন সে? নিঃশ্বাসের আওয়াজেরও যেন শব্দ না হয় সেই ভাবে চুপ চাপ বসে রইল। কে হতে পারে এত রাতে তার দরজা চাবি দিয়ে খুলতে এসেছিল? সে তো অফিসের গোটা কয়েক নূতন পরিচিত সহকর্মী ছাড়া এই শহরের আর কাওকেই চেনে না! এটা কি ওই অনর্গল কথা বলা অতি বন্ধু-সুলভ ট্যাক্সি ড্রাইভারটা, যে আজ সন্ধ্যায় তাকে হোটেল থেকে এখানে নিয়ে এসেছে? নাকি ফ্ল্যাটের উল্টো পাশের অতি আলাপী প্রতিবেশীটা, যে তার মালামাল উঠাতে সাহায্য করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিল?
অপরিচিত কারো সাথে কথা বলার সময় আমার আরও সাবধান হওয়া উচিৎ। মা এ ব্যাপারে আমাকে বার-বার সাবধান করে দিয়েছিলেন। বলেছেন অপরিচিত কাওকে যেন কোন ভাবেই ঘড়ে ঢুকতে না দেই। কিন্তু আমি কি করব? ট্যাক্সি ড্রাইভারটা যেভাবে আমাকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে প্রশ্ন করছিল! আর অন্য ভদ্রলোকটি তো মালামাল ঘরে পৌঁছে না দিয়েই ছাড়বে না। শিখ ড্রাইভারটির পাশের সিটে বসে ওর খোঁচানো প্রশ্নগুলিকে খুব একটা বিরক্তিকর বলে মনে হয়নি তখন। ও জানতে চাইছিল আমার নতুন চাকরীটির নিশ্চয়ই অনেক বেতন, আমারদের পরিবার সম্ভবত বেশ ধনী, ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রতিবেশী ভদ্রলোকটিও আমার ব্যাগ-সুটকেস নিয়ে টানা-টানি করতে গিয়ে আমার পছন্দসই লাগেজগুলির তারিফ করতে থাকে। আমার মত আপাত দৃষ্টিতে ভদ্রবেশী একজন প্রতিবেশী দেখে সে খুশি হয়েছে বলে জানায়। এ সব কিছুই জুবেরকে ভবিয়ে তোলে। এতটা খোলাখুলি আলাপ কি ঠিক হয়েছে?
বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করতে থাকে জুবের। ওদিকে বেসিনের টপ টপ পানি পড়ার আওয়াজটা যেন মাথার ভিতর হাতুড়ি ঠুকছে এখন। উঠে গিয়ে কলের চাবিটা আরও শক্ত করে ঘুরিয়ে পানি পড়া বন্ধ করার চেষ্টা করে। কোন লাভ হয় না। একবার মনে হয় বাড়ীতে টেলিফোন করে রিমা হেমা’র সাথে কথা বলি – মনের অস্থিরতা হয়ত কিছু কমবে। থাক অনেক রাত হয়ে গেছে, বরং বারান্দার দরজাটা খুলে বাইরে গিয়ে দাঁড়ালে ঠাণ্ডা বাতাসটা ভালই লাগবে।
হঠাৎ ফোন বেজে উঠে। স্বস্তির হাসি হাসে জুবের। হেমা আর রিমার সাথে কথা বলে কিছুটা সময় কাটানো যাবে। অন্ধকারে হাতড়ে টেলিফোনটা খুঁজে পেতে পেতে ওদিক থেকে কে একজন ভারি কণ্ঠে মেসেজ রাখল; - আর কতদিন তুমি আর আমদের হাত থেকে পালিয়ে বাঁচবে? আজ হোক আর কাল হোক, তোমাকে আমাদের হাতে ধরা দিতেই হবে। কিছুক্ষণ পর ফোনটা আবার বেজে উঠে।, একটু পরে আবারো। জুবের ফোনের কাছ থেকে সরে গিয়ে ঘুমাতে চেষ্টা করে। - আমার দরজা যে খুলতে চেষ্টা করেছিল, সেইকি ফোন করল? - কলের টপ টপ শব্দে আর কিছুতেই ঘুম আসবেনা। - ওই লোকটা কি আবার কল করবে?
জুবের উঠে গিয়ে টেলিভিশনটা অন করে বসল। আওয়াজটা বাড়িয়ে দেওয়ায় পানির বিরক্তিকর শব্দটা কিছুটা চাপা পড়ল। চ্যানেল বদলাতে-বদলাতে আধা হওয়া একটা সিনেমায় অন্যমনস্ক চোখ রেখে বসে রইল। অবিবাহিত এক তরুণীর সদ্য প্রসূত অনাহূত সন্তানকে ত্যাগে করতে বাধ্য হওয়ার গল্প। বহুদিন পর সে তার সন্তানের খোঁজ পায়। ততদিনে সন্তানটি একজন স্বপ্রতিষ্ঠিত সামাজিক ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছে। পিতৃ-মাতৃ পরিচয় হীন অনাথ আশ্রমে বেড়ে ওঠা অভিমানী শিশুটি না-দেখা মা’টিকে কোনদিনই ক্ষমা করে নাই। চরম অভিমানে মাকে সে স্বীকার করতে অস্বীকৃতি জানায়। মা’র একটিই আকুতি, কেও জানবে না যে আমি তোমার মা। দিন গেলে একবার মাত্র আমি তোমাকে চোখের দেখা দেখতে চাই। ঠিক হল ছেলের সাথে দেখা করার জন্য গৃহকর্মীর বেশে মা’টি মাঝে মাঝে ছেলের বাসায় আসবে। আবার গৃহকর্মীর বেশেই ফিরে যাবে, কেও জানতেও পারবেনা মা ছেলের সম্পর্ক। তার পর থেকে রোমাঞ্চকর ভাবে ছবিটি এক এক বার এক এক দিকে মোড় নেয়। দর্শক ভাবে এক, গল্প নিয়ে যায় অন্য দিকে। প্রতিটি মুহূর্তের জন্য অধীর অপেক্ষা, না জানি দু’টি ভগ্ন হৃদয়ের মেল-বন্ধনের কি পরিণতি হয়?
ছবিটির রোলার-কোস্টার এর মত রোমাঞ্চকর পালা বদলের পরিস্থিতি জুবেরকে অস্থির করে তোলে। আর তার সাথে পাল্লা দিয়ে কলের পানি পড়ার শব্দটা যেন বিরক্তিকর ভাবে বেড়েই চলেছে। প্রতিটা বিজ্ঞাপন বিরতির সময় সে দৌড়ে গিয়ে কলটাকে আরও একটু জোরে বন্ধ করে দেয়। গল্পটির শেষ পরিনতির মুহূর্তে পানি পড়ার শব্দ অসহনীয় হয়ে পড়ে – সংলাপ পর্যন্ত শোনা অসম্ভব হয়ে যায়। প্রচণ্ড রাগে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে কলটাকে বন্ধ করতে গিয়ে সেটা ভেঙে গল-গল করে পানি ঝড়তে থাকে। সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে জুবের ফিরে আসে টেলিভিশনের সামনে শেষ পরিণতিটা দেখার জন্য।
- কলের বন্দবস্ত ছবিটা শেষ হলে দেখা যাবে – আর বেশিক্ষণ তো বাকি নেই।
ছবির গল্প আবার আরেক দিকে মোড় নেয়, শেষ পরিনতিতে আসতে আরও সময় লাগে। ততক্ষণে পানি বাথরুম ছেয়ে সারা বাড়িতে পায়ের গোছা পর্যন্ত এসে গেছে। কি করবে জুবের ভেবে পায় না। হাতের কাছে তোয়ালে কাপড় চোপর যাই পাওয়া গেল তা দিয়েই কলের মুখ বন্ধ করার আপ্রাণ চেষ্টা করেও কোন লাভ হলো না। ঘড়ের ভিতর পানি বেড়েই চলেছে। দরজা জানালা মজবুত ভাবে বন্ধ, পানি বেরোবার কোন পথই নেই। - আমাকে এই মুহূর্তেই এখান থেকে বেরোতে হবে, না হলে পানিতে ডুবে মৃত্যু অবধারিত। - ঘড়ের চাবি কোথায় রাখলাম, খুঁজে পাচ্ছি না কেন?
পানি আরও বাড়তে থাকে। মাল-পত্র ভরা ট্রলি ব্যাগটা হাতের কাছে পেয়ে তাই ছুড়ে মারে বারান্দার কাঁচের দরজার ওপর। দরজা যেমনি ছিল তেমনি দাঁড়িয়ে রইলো। উপায়ান্তর না দেখে দৌড়ে গিয়ে নিজেই ঝাপ দিয়ে পড়ে সদর দরজার ওপর, দরজা ভেঙে বেরিয়ে যাবার জন্য কিন্তু প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়ে মাটিতে পড়ে গিয়ে পানির নিচে দম বন্ধ হওয়ার জোগাড়। কোনরকমে হাঁটুর ওপর ভর করে নাকটা সামান্য পানির ওপর উঠিয়ে দম নেয়। চোখ খোলা ভার, কেমন জানি নোনা পানির স্বাদ। - এ আমি কোথায়, কি করছি? কোমর সমান উঁচু পানি গেল কোথায়? ফ্লোরে হাঁটু গেরে সিলিং এর দিকে মুখ উঁচু করে বসে আছে জুবের, টেলিভিশনে চলছে সকাল ছয়টার খবর! সমস্ত শরীর, মুখ, মাথা, গায়ের কাপড় চোপর ঘামে ভিজে একাকার!
ফোনটা বেজে উঠলো। - তুমি কি এখনো ঘুমাচ্ছ? - হা – না – ঠিক – তা – না, মা। - হা - না, কি আবোল তাবোল বকছো? দেরি করে ঘুমাতে গেছ নিশ্চয়ই – ফোন ধরলে না কেন – হেমা বলছে ও নাকি তোমাকে দুই বার ফোন করেছিল। - মা, আমি গত রাত ঠিক মত ঘুমাতে পারি নাই, তা ঠিক নয় – ঘুমিয়েছি, আবার উঠেছি। ঠিক বুঝতে পারছিনা কি হয়েছিল – আমি তোমাকে পরে ফোন করব। - নিশ্চয়ই কোন খারাপ স্বপ্ন দেখেছো। - আমি ঠিক জানি না মা – আমি তোমাকে পরে ফোন করব।
অফিসে বেরোবার পথে পানির কলটার কথা জানানোর জন্য ম্যানেজারের অফিসে ঢুকতেই, তিনি জানালেন যে জুবের যে গত রাত্রেই ফ্ল্যাটে উঠে গেছে তা তার জানা ছিল না। - তবুও নিশ্চিত হওয়ার জন্য গত রাতে আপনার দরজায় কয়েক বার টোকা দিয়েছি, ভাগ্যিস আপনার ঘুম ভাঙাইনি। - না ঠিক আছে, আমার ঘুমের কোন ব্যাঘাত হয়নি। - ও আপনাকে আর একটা কথা জানানো হয় নি। নতুন নাম্বার না দেওয়া পর্যন্ত আপনার ফোনটা কয়েকদিন বন্ধ থাকবে। আগের ভাড়াটের কথা আর কি বলবো; ফোনের বিল, আর কি কি সব না দিয়েই চলে গেছে। আপদ একটা বিদায় হয়েছে। তবে একটা মজার কথা কি জানেন; ওর বাসার কাজের মহিলাটা এখনো মাঝে মাঝে এসে ওর খোঁজ করে। ও ফিরেছে কিনা জানতে চায়। সম্ভবত ওর বেতন-টেতন না দিয়েই পালিয়েছে – কে বলতে পারে?
 মোস্তফা আব্দুল্লাহ, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া
|