চন্দ্র বিভ্রাট মোস্তফা আব্দুল্লাহ
"ভাই রোজা শুরু করলেন কবে, আগের দিন না পরের দিন?"
"আমি তো ভাই রমজান মাসের এক তারিখ থেকেই শুরু করেছি"
"আরে তাতো বুঝলাম, সোমবার না মঙ্গলবার?"
"এ আবার কেমন কথা – সোমবার ও মঙ্গলবার একই সাথে কি করে রমজান মাসের প্রথম তারিখ হয়?"
"আরে ভাই হয়, হবে না কেন – সম্ভব করলেই সম্ভব। আপনি রোজা করবেন চাঁদের মাস হিসাব করে আর দিন গুনবেন ইংরেজি মাসের, এই হযবরল তো ঘটবেই"।
"ব্যাপারটা কেমন একটু ঘোর প্যাঁচালো মনে হচ্ছে, একটু খোলাসা করে বলবেন?"
"বলছি ভাই, আশে পাশে খুব বেশি একটা লোকজন নাইত – পরে না আবার মাইর খাইতে হয়?"
"না ভাই, কেও নাই, আস্তে আস্তে বলেন - আমারও তো ভাই আর দুই দশজনের সাথে চলতে হয়"।
ধরেন আপনি সোমবার ৬ই জুন রমজানের চাঁদের পহেলা দিন রোজা শুরু করেছেন। অর্থাৎ আপনি চাঁদ দেখেন আর নাই দেখে থাকেন – আপনার বিশ্বাস ৫ই জুন রোববার সন্ধ্যাতেই চাঁদ উঠছে আর তার সাথেই সেই সন্ধ্যা থেকেই রমজান মাসের পহেলা তারিখ শুরু হয়ে গেল। আপনি সঠিক ভাবেই ১লা রমজান ৬ই জুনের প্রথম প্রহরে সেহেরি খেয়ে প্রথম রোজাটি রাখলেন। এর মধ্যে আমার মনে হয় ভুল খুঁজে পাওয়ার খুব একটা অবকাশ নাই।
তবে একটা জিনিষ একটু খেয়াল করেন, যেহেতু চাঁদের মাসের তারিখ শুরু এবং শেষ হয় এক সন্ধ্যা থেকে পরের সন্ধ্যায় আর ইংরেজি মাসের তারিখ এক মাঝ রাত থেকে পরের মাঝ রাত, ১লা রমজান যদিও ৬ই জুন সন্ধ্যাতেই শেষ হয়ে গেছে কিন্তু ৬ই জুন শেষ হতে তখনো ৬/৭ ঘণ্টা বাকি। অর্থাৎ ২রা রমজান যখন শুরু তখনো কিন্তু ৬ই জুন – ৭ই জুন নয়।
"তা নয় বুঝলাম, কিন্তু এর মধ্যে সমস্যাটা কোথায়?"
"সমস্যাটা তেমন কিছুই নাই যদি রমজান মাসের ১লা তারিখেই পৃথিবীর সব স্থানে রোজা শুরু হয়"
"তাই তো করার চেষ্টা চলছে, তাই নয় কি?"
রমজান শুরু করা হয়েছে চাঁদের জন্মের ওপর ভিত্তি করে ইংরেজি মাসের ৬ তারিখ থেকে। ইংরেজি মাসের ৬ তারিখে পৃথিবীর সব স্থানেই এক সাথে রোজা শুরু করতে গিয়ে পৃথিবীর একাংশ যদিও রমজানের ১লা তারিখেই রোজা শুরু করতে পেরেছে কিন্তু আরেক অংশে, যেখানে ৫ তারিখে তখনো সন্ধ্যা হতে অনেক সময় বাকি কিম্বা বহু আগেই সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে সেখানে পরের দিন সন্ধ্যা না হওয়া পর্যন্ত শাবান মাসের শেষ দিনটিই রয়ে গেছে – অর্থাৎ রমজান মাস শুরু হওয়ার আগেই তারা রোজা করতে শুরু করে দিয়েছে!
"সর্বনাশ, তাহলে ঈদের কি হবে?"
ওই একই কথা। আপনি যদি আরব দেশে (অস্ট্রেলিয়ার ৫ ঘণ্টার পশ্চিমে) সন্ধ্যায় নূতন চাঁদ দেখার পর একই ইংরেজি তারিখে অস্ট্রেলিয়াতে ঈদ করেন তাহলে রোজার শেষ দিন ঈদ করে ফেলার সম্ভাবনা রয়েছে! কেননা আপনার এখানে পরের দিন ইংরেজি তারিখের সন্ধ্যায় চাঁদ দেখা দিতেই রমজান মাস শেষ হয়ে শাওয়াল মাসের শুরু হবে।
তবে এই বৎসর খুশির খবর যে নূতন চাঁদ প্রথম আমাদের পূর্ব দিকে দেখা দিয়ে অস্ট্রেলিয়ার ওপর দিয়ে এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ ও আমেরিকার বিশাল অঞ্চলের যেখানে যেখানে সন্ধ্যা হতে থাকবে সেখান থেকেই ৫ই জুলাই দেখা দেয়ার সম্ভাবনা রয়েছে আর তাতেই বোধ হয় আমরা বেশির ভাগ জনগোষ্ঠী এবার পরের দিন ৬ই জুলাই একসাথে ঈদ করতে পারব। ( www.moonsighting.com/1437shw.html)
"সেইটা তো বুঝলাম – কিন্তু আমাদের পশ্চিম দিকে প্রথম চাঁদ দেখা গেলে তখন কি হবে?"
এর জন্য তো নূতন কোন সমাধান দেয়ার প্রয়োজন নাই। পৃথিবীর যে কোন জায়গায় চাঁদ উঠলে সেটা পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ক্রমান্বয়ে সব জায়গার ওপর দিয়েই যাবে। দেখা না গেলেও চাঁদটা যে যাবে সেটা নিশ্চিত ভাবে বলা যায়। এই প্রথম ২৪ ঘণ্টাটাই চাঁদের মাসের পহেলা তারিখ যা কিনা, আন্তর্জাতিক ডেট-লাইন এর কারণে, পৃথিবীর একাংশে ইংরেজি মাসের এক তারিখ এবং অন্য অংশে পরের তারিখ। চাঁদের এই ২৪ ঘণ্টা ঘূর্ণনের শুরুর দিকে এটাকে খুবই সরু দেখা যায় এবং শেষ দিকে বেশ চওড়া হয়ে উঠে। এই চওড়া চাঁদকেই অনেকে "দুই দিনের চাঁদ" বলে ভুল করেন।
ঠিক এমনি ভাবে যদি চাঁদের মাস দিয়ে আমরা বড়দিনকে দেখি তাহলে পৃথিবীর একাংশে বড়দিন হবে চাঁদের মাসের হিসাবে এক তারিখে এবং অন্য অংশে সেটা হবে পরের তারিখে। ২৫শে ডিসেম্বর পৃথিবীর যেখানেই মাঝ রাত হচ্ছে সেখানেই বড়দিন শুরু হয় – সমগ্র পৃথিবী জুরে একই সময় শুরু হয় না। আমরা আমাদের এখানে যখন সন্ধ্যা হয় তখনই আমরা মাগরিবের নামাজ পরি, আরব দেশের সন্ধ্যার সময় নয়।
সুতরাং ইংরেজি মাসের তারিখ ও চাঁদের মাসের তারিখ এই দুটাকে এক সাথে গুলিয়ে না ফেলে যেটা দিয়ে যেটাকে মাপার সেটা দিয়ে সেটাকে মাপলেই এই হযবরলর একটা সমাধান পাওয়া সম্ভব বলে মনে হয়। চাঁদের পরিক্রমণের সাথে সামঞ্জস্য রেখে চাঁদের মাসের তারিখের হিসাবে রোজা শুরু এবং শেষ করলে সমস্ত পৃথিবীর মুসলমানরাই একই দিনে এই সব উদযাপন করতে পারবে। আধুনিক বিজ্ঞানের সহায়তায় এই দিন গুলি বহু আগে হতেই নির্ণয় করা সম্ভব।
"সবই তো বুঝলাম ভাই, তবে আমার একটা শেষ কথা – যাদের মাতৃ ভাষা আরবি তারা কি এই সব না বুইঝাই আমাদেরকে ভুল দিনে ঈদ করতে বলতেছে?"
"এইটাও হক কথা – তবে কিনা জানেন ভাই, আমার জানা মতে ইংরেজি ভাষায় সাহিত্য রচনা কইরা যারা বিশ্ব-খ্যাতি অর্জন করছে তাদের বেশির ভাগেরই মাতৃ ভাষা ইংরেজি না। মাতৃ ভাষা হইলেই যে তারা অন্য সবার থাইকা বেশি বুঝবে এই রকম ভাবার পিছেনে কোন যৌক্তিকতা নাই। আর একটা কথা; আমার জানা মতে আরব দেশ বা মক্কা হতে এমন কোন নির্দেশ বা উপদেশ এর কথা শোনা যায় নাই যে সেখানে চাঁদ দেখা গেলেই সমগ্র পৃথিবী জুড়ে তার সাথে সাথেই রোজা বা ঈদ করতে হবে"।
মোস্তফা আব্দুল্লাহ, সিডনি
|