শতভাগ জন্ম নিবন্ধনে পাবনা জেলা মডেল হতে পারে মোশাররফ হোসেন মুসা
এদেশে ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌর কার্যালয়ে বহু বৎসর আগে থেকে একটি শ্লোগান লিপিবদ্ধ রয়েছে, তা হলো- জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন করুন। কিন্তু খুব কম সংখ্যক নাগরিকই এ শ্লোগানে আকৃষ্ট হয়ে নিজ দায়িত্বে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন করে থাকেন। অথচ একটি দেশের উন্নয়নমূলক কাজকে গতিশীল রাখতে শতভাগ জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন সম্পন্ন থাকা অত্যাবশ্যক। বর্তমান সরকার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে ২০২৪ সালের মধ্যে শতভাগ জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন নিশ্চিত করার ঘোষণা দিয়েছে। সেজন্য দেশের ৬৪টি জেলা প্রশাসন বিভিন্ন পদ্ধতি গ্রহণ করেছে।
পাবনা জেলা প্রশাসক বিশ্বাস রাসেল হোসেনের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় অগ্রগতির হার সূচকে ২০২১ এর নভেম্বর মাসে পাবনা জেলা প্রথম স্থান অধিকার করেছে। ডিসেম্বর মাসে দ্বিতীয় স্থান ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। অন্যান্য জেলা যদি পাবনা জেলাকে মডেল হিসেবে গ্রহণ করে তাহলে ২০২৪ সালের আগেই শতভাগ জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন করা সম্ভব হবে বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করেন।
১৮৮২ সালে লর্ড রিপন চৌকিদারি এ্যাক্ট পাশের মাধ্যমে এদেশে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার লিখিত রূপ দেন। বৃটিশ সরকার জনগণের জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধনে অনাগ্রহ দেখে ১৮৮৩ সালে জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন আইন পাশ করে। বাংলাদেশ সরকার ২০০৪ সালের ৭ ডিসেম্বর ১৮৮৩ সালের বৃটিশ আইন রহিত করে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন আইন ২০০৪ প্রবর্তন করে। আইনটি ২০০৬ সালের ৩ জুলাই হতে কার্যকর হয়। ২০০১ সাল থেকে ২০০৬ সালের পাইলট প্রকল্পটি জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন (২য় পর্যায়ে) নামে আরম্ভ হয়ে ২০১২ সালে শেষ হয়। প্রকল্পটির ৩য় পর্যায়ের কার্যক্রম ২০১২ সাল থেকে শুরু হয়ে ২০১৬ সালে শেষ হয়। বর্তমান সারা দেশে ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, সিটি কর্পোরেশন, ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড ও ৫৫টি দূতাবাস সহ মোট ৫১০৭ টি নিবন্ধক অফিসে সরাসরি ও নিয়মিত যোগাযোগ সমন্বয় করে অনলাইন নিবন্ধন কার্যক্রম চলছে। বর্তমান সরকার জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন আইন ২০০৪ (২০১৩ সালে সংশোধিত) এবং জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন বিধিমালা ২০১৮ এর মাধ্যমে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনের পূর্ণাঙ্গ প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো প্রতিষ্ঠা করে। এই আইনে বলা আছে, কেউ যদি ৪৫ দিনের মধ্যে তার শিশুর জন্ম নিবন্ধন না করে তাহলে তাকে সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা করা যাবে। বিদ্যমান জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন কার্যক্রম অব্যাহত ও গতিশীল রাখার স্বার্থে সরকার ইতোমধ্যে রেজিস্টার জেনারেলের অফিস স্থাপন করেছে। রেজিস্টার জেনারেল জাতীয় পর্যায় হতে স্থানীয় পর্যায় পর্যন্ত জন্ম-মৃত্যু নিশ্চিত করতে কাজ করে যাচ্ছেন।
সম্প্রতি স্থানীয়-সরকার মন্ত্রী বলেছেন- দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, প্রথম মিনিস্ট্রিয়াল কনফারেন্সে সিভিল রেজিস্ট্রেশন এ্যান্ড ভাইটাল স্ট্যাটিসটিক্স (সিআরভিএস) ডেকেইড (২০১৫-২০২৪) এর ঘোষণা অনুযায়ী ২০২৪ সালের মধ্যে শতভাগ জন্ম নিবন্ধন এবং পঞ্চাশ শতাংশ মৃত্যু নিবন্ধন নিশ্চিত করার অঙ্গীকার করা হয়েছে (ইত্তেফাক, ১৯ ডিসেম্বর ২০২১)। বিভিন্ন নিবন্ধক অফিস বার বার প্রচার করছে পাসপোর্ট, বিবাহ নিবন্ধন, মৃত্যু সনদ, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে ভর্তি, জমি রেজিস্টার সহ নানা গুরুত্বপূর্ণ কাজে সব বয়সী মানুষের জন্ম সনদের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তাতেও কাজ না হওয়ায় স্থানীয় সরকারের কর্মচারীদের নিযুক্ত করা হয়েছে।
এ বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল মনে করেন, যদি ০-৪৫ দিন বয়সী শিশুদের জন্ম-নিবন্ধন করা যায় এবং ৪৫ দিনের মধ্যে যদি মৃত ব্যক্তির নিবন্ধন নিশ্চিত করা যায়, তাহলে ২০২৪ সালের মধ্যে অতি সহজেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হবে। এক্ষেত্রে পাবনা জেলার উদাহরণ প্রাসঙ্গিক হবে। পাবনা জেলায় ৭৪টি ইউনিয়ন পরিষদ ৯টি পৌরসভা রয়েছে। রেজিস্টার জেনারেলের কার্যালয় হতে প্রতিটি ইউনিয়ন ও পৌরসভাতে জনসংখ্যার ভিত্তিতে মাসিক লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। ধরা যাক, একটি ইউনিয়নে জন্ম নিবন্ধনের লক্ষ্যমাত্রা ৮০জন এবং মৃত্যু নিবন্ধনের লক্ষ্যমাত্রা ২০ জন। যদি ইউনিয়নটি মাসিক লক্ষ্যমাত্রা মোতাবেক জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন করতে সক্ষম হয়, তাহলে ধরে নেওয়া হয় ইউনিয়নটি শতভাগ জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন সম্পন্ন করেছে। যদি কোনো ইউনিয়ন এর কম রিপোর্ট দেয় তাহলে সঙ্গে সঙ্গে ডিডিএলজি (মোঃ মোখলেছুর রহমান) টেলিফোনে এর কারণ জানতে চান। তিনি ইউনিয়ন পরিষদে উপস্থিত হয়ে চেয়ারম্যান, মেম্বর, সচিব, হিসাব সহকারী, উদ্যোক্তাদের সমস্যা সমাধানে পরামর্শ দেন। এছাড়াও তিনি মসজিদের ইমাম, গোরস্থান কমিটির সভাপতি/সেক্রেটারি ও এলাকার গণ্যমান্য ব্যাক্তিদের এ বিষয়ে সহযোগিতা করার জন্য অনুরোধ করেন। তিনি প্রত্যেক গ্রাম পুলিশকে রেজিস্টার খাতা কিনে দেয়ার ব্যবস্থা করেছেন। গ্রাম পুলিশরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করে সচিবের নিকট জমা দিচ্ছেন। কেউ যদি যথাসময়ে তার শিশুর জন্ম নিবন্ধন করাতে অস্বীকৃতি জানান তাহলে তিনি তার বাড়িতে গিয়ে জরিমানা করার আইনটি মনে করিয়ে দেন।
৬৪টি জেলার মধ্যে সর্বনিম্ন অবস্থানে রয়েছে ঢাকা জেলা। বড় শহর ও পৌরসভাগুলোতে সচেতন নাগরিক সমাজ বাস করলেও জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন করার বিষয়ে নাগরিকবৃন্দ যথেষ্ট সচেষ্ট নন। ঢাকা শহরে যারা বাস করেন তারা বেশিরভাগই অস্থায়ী। তাদের অনেকেই গ্রামের স্থায়ী ঠিকানায় জন্ম নিবন্ধন করে থাকে। ইউনিয়ন পরিষদে যত সহজে জন্ম নিবন্ধন করা যায় বড় শহরে তত সহজে কার যায় না। জনগণ নিবন্ধকের কার্যালয়ে গিয়ে নিযুক্ত কর্মকর্তাদের সাক্ষাৎ পায় না। অনেকে জানেন না জন্ম নিবন্ধন কোথায় করতে হয়। তাছাড়া শহরে দালালের দৌড়াত্ম থাকায় জনগণ বিভিন্ন হয়রানির শিকার হয়ে থাকে।
জন্ম নিবন্ধন প্রকল্পটি যখন শুরু হয় তখন জন্ম নিবন্ধন করা খুব সহজ কাজ ছিল। পরবর্তীতে বিভিন্ন ত্রুটি ধরা পরায় অনলাইনে নতুন নতুন তথ্য সংযোজন করা হয়েছে। ফলে এখন সহজে জন্ম তারিখ পরিবর্তন করা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। এদেশের অধিকাংশ মানুষ তার সন্তানের চাকরির স্বার্থে, কেউ কেউ কম বয়সে মেয়ের বিবাহ দেয়ার স্বার্থে সঠিক জন্ম তারিখ লিপিবদ্ধ করতে চান না।
জীবনের সত্য প্রতিষ্ঠার প্রথম ধাপ হলো সঠিক জন্ম তারিখ লিপিবদ্ধ করা- এটা বুঝানোর জন্য ব্যাপক সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। সেজন্য জনপ্রতিনিধি ও সরকারি কর্মকর্তা/কর্মচারীর পাশাপাশি বিভিন্ন দলের রাজনৈতিক কর্মী, সাংস্কৃতিক কর্মী, সাংবাদিক, লেখক-বুদ্ধিজীবীসহ সর্বস্তরের জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ জরুরি। লেখকঃ গণতন্ত্রায়ন ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার বিষয়ক গবেষক।
মোশাররফ হোসেন মুসা Center for Democratic Local Governance E-mail : musha.pcdc@gmail.com, সেল- ০১৭১২-৬৩৮৬৮২ ঈশ্বরদী, পাবনা
|