ভোটার আইডি ও স্বদেশে বিদেশী ট্রেন মমতাজ রহমান চম্পা
হঠাৎ করেই ঝটিকা সফরে যেতে হয়েছিল বাংলাদেশে। এই প্রথম বাংলাদেশে গেলাম যখন আম্মা নাই। মনে হয়েছে আমার আর কিছুই নাই দেশে। আম্মা আর দুই ভাইকে শেষ বিদায় জানাতেই আসলে যাওয়া তাড়াহুড়ো করে। নিজেকে মনে হলো অনেকটা আপন গৃহে পরবাসী। অনেক অম্ল মধুর স্মৃতি নিয়ে ফিরে এলাম।
দেশে যাওয়ার আরেকটা কারণ ছিল ভোটার আইডি কার্ড সংগ্রহ করা। সেই কার্ড করতে আমার যে হ্যাপা সামাল দিতে হয়েছে সেটাই একটু পাঠকে জানানোর প্রয়োজন মনে করলাম। এটা থেকে কেউ যদি উপকৃত হন, আমার ভালো লাগবে।
দেশে যাওয়ার আগেই ওয়েবসাইট চষে বেড়িয়েছি, একটু তথ্যের জন্য। যাকেই পেয়েছি খড়কুটোর মতো আঁকড়ে ধরেছি, কারণ এইবার নিয়ে চতুর্থ বারের মতো আমি চেষ্টা চালাতে যাচ্ছি! আমার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে এই কার্ড আমার বড়ই দরকার হয়ে পড়েছে। আগের বারগুলিতে নির্বাচন কমিশনারের অফিসে অগণিত মানুষের ভিড়, বাংলাদেশের মেয়াদ অনুত্তীর্ণ এমন পাসপোর্ট না থাকা, দেশে অবস্থানের স্বল্পতা, এই করছি করবো আলসেমি ভাব, যেটাই কারণ হোক মোট কথা আমার ভোটার আইডি নেয়াও হয়নি বা প্রয়োজন মনে করিনি। যাইহোক অনেক পড়াশোনা করে এবং ক্যানবেরা দূতাবাসে খোঁজ খবর করে মোটামুটি জানা গেল যে আমার জন্ম নিবন্ধন পত্র লাগবে। কেউ কেউ আবার বললেন ডিজিটাল জন্ম নিবন্ধন থাকতে হবে! মাথায় বাজ আর বলে কাকে! অনলাইনে আবেদন করতে হবে, জন্মস্থানের সিটি কর্পোরেশনের কাছে থেকে নাগরিকত্ব সনদ নিতে হবে আর মাধ্যমিক পরীক্ষা পাশের সনদ লাগবে। মাথার মধ্যে অসংখ্য প্রশ্ন ঘুরঘুর করছে দিচ্ছে না কেউ জবাব তার! আচ্ছা কেউ কি বলতে পারেন বাংলাদেশের গ্রামের কয়টি শিশুর জন্ম হাসপাতালে হয় আর তার জন্মের ক্ষণ তারিখ লিখে রাখেন বাবা মা? গ্রামের কয়টি ছেলে-মেয়ে মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবার সুযোগ পায়? তারা কি ভাবে ভোটার আইডি পাবে?
এখানে একটু বলে রাখা দরকার মনে করছি যে আমার এখন বাংলাদেশের ভ্যালিড পাসপোর্টও রয়েছে। এই ব্যাপারটাতেই একটু খটকা লাগলো, আমি নাগরিক না হলে ক্যানবেরা দূতাবাস আমাকে পাসপোর্ট দিল কেন? আমি তো ক্যানবেরাতে গিয়ে আঙুলের ছাপ দিয়ে ছবি তুলে পাসপোর্ট পেলাম। তাহলে ক্যানবেরা দূতাবাস কি অন্য দেশের নাগরিকদেরও মুক্তহস্তে পাসপোর্ট ইস্যু করে থাকে! যাহোক রাজশাহীতে কাউন্সিল অফিসে গিয়ে জন্ম নিবন্ধন আর পাসপোর্ট দেখিয়ে একটি নাগরিকত্ব সনদের আবেদন করলাম। উনারা আমার জন্ম নিবন্ধন দেখতে চাইলেন, সাথে পাসপোর্ট আর মাধ্যমিক পরীক্ষা পাশের সনদ। তারপর উনারা প্রথম ভুল যেটা আবিষ্কার করলেন যে আমার জন্ম নিবন্ধন পত্রে বর্তমান পদবি (Surname) নাই, মানে জন্ম নিবন্ধন আছে বিয়ের আগের নাম। আমি বললাম ভাই জন্মের সময় আমার বাবা মা জানতেন না আমার কার সাথে বিয়ে হবে বা আদৌ কখনও বিয়ে হবে কিনা! জানলে ম্যারেড নামেই আবেদন করতেন। বললাম ম্যারেড সার্টিফিকেট এনেছি দেখে নিন। কে কার কথা শোনে! উনারা অনড় অনেকটা হাকিম নড়ে তো হুকুম নড়ে না। উনারা জবান দিয়ে দিলেন ভোটার আইডি নিতে হোলে আপনাকে বিবাহ পূর্ব নামেই নিতে হবে অথবা জন্ম নিবন্ধনের নাম পরিবর্তন করে আনতে হবে।
আমার হাতে সময় গোনা মাপা, বললাম তাই সই। এক বন্ধু উপদেশ দিলেন অস্ট্রেলিয়ার নাম বাংলাদেশে ব্যবহার করবেন না। তবে এই দুই তিনটি লাইন টাইপ করতে ঘণ্টা খানেক লেগে গেল, যেন হাতের আঙুলে এই মাত্র মেহেন্দি লাগিয়েছেন, দ্রুত কাজ করলে মেহেন্দিতে রঙ ধরবে না। টাইপিং এর এই অবস্থা সর্বক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হয়েছে সেটা ব্যস্ত বিমানবন্দরই হোক বা ব্যাংকেই হোক!
এরপরে ভয়ে ভয়ে জানতে চাইলাম এর পরে কোথায় যেতে হবে। কেও মুখের দিকে ভালো করে তাকায় না পাছে অশুচি কিছু দেখে অজু নষ্ট হয়ে যায়! শুধু বলে দিল অনলাইনে আবেদন করতে হবে। আমার সম্বল একমাত্র মোবাইল ফোন। চিন্তিত হয়ে বের হয়ে আসছি অফিস থেকে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা এক দিদি নিজে থেকেই কাছে এসে বললেন আপনাদের রক্তের গ্রুপ করা হয়েছে? আমি না বলায় উনি এক মেডিক্যাল সেন্টারের নাম বলে দিলেন আরও বলে দিলেন যে অমুক দোকানে চলে যান তারা আপনাকে অনলাইনে আবেদন করতে সাহায্য করবে আর বলেও দেবে এর পরে কি করবেন। ওই দিদির কথা অক্ষরে-অক্ষরে মিলে গেল! অজস্র ধন্যবাদ সেই নাম না জানা উপকারী বন্ধুকে।
অনলাইনে যিনি সাহায্য করলেন তিনি বার বার বললেন বিবাহ পূর্ব নামে করলে ভবিষ্যতে সমস্যা হবে। তাই তিনি দুই নামে দুইটা আবেদন পত্র দিলেন আর বললেন আবারও সেই স্থানীয় কাউন্সিলরের অফিস থেকে সত্যায়িত করে নির্বাচন কমিশন অফিসে জমা দিতে হবে।
কিন্তু আবারও সমস্যা। কাউন্সিলরের অফিসে বাবা মা'য়ের ভোটার আইডি চাইল। বললাম আমার আব্বা যখন মারা যান তখন বাংলাদেশের জন্মই হয়নি, ভোটার আইডি তো দুরাস্ত! চেয়ারে বসে থাকা পায়ের গোড়ালির সমান বয়সের একটা ছেলে আমাকে শুধালো আপনার আব্বা যে মারা গিয়েছেন ডেথ সার্টিফিকেট নিয়ে আসেন। আমি বললাম আব্বার ডেথ সার্টিফিকেট স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় হারিয়ে গেছে। আমার আব্বা যে মারা গিয়েছেন তা আমার মাধ্যমিক পরীক্ষা পাসের সনদে আছে। সে কিছুক্ষণ ক্যালিগ্রাফিতে লেখা সার্টিফিকেট এর দিকে তাকিয়ে থাকল, পড়তে পারল কিনা বুঝা গেল না। যদিও আমার আব্বা অনেক আগে গত হয়েছেন কিন্তু ওই অফিসে অনেকেই আব্বা কে চেনেন দেখলাম! তারপরও পদে পদে জটিলতা। অনেক কথা খরচের পরে আব্বা আম্মার ডেথ সার্টিফিকেট কপি বের করতে সক্ষম হলাম। তবে এতকিছুর পরও না বলে পারছি না যে কাউন্সিলরের অফিস সন্ধ্যার পরেও খোলা থাকে। এই ব্যাপার টা ভালো লেগেছে। এর ফলে আমি সারাদিনটাই কাজে লাগাতে পেরেছি। এই রকম আরও কতযে বিচিত্র প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হোল। নির্ধারিত দিনে ছবি তুলে এলাম। তবে আমার এই অভিযানে দুই তিন জন বন্ধু কে পাশে পেয়েছিলাম বলেই আমি সফল হতে পেরেছি। উনারা জানালেন ভোটার আইডির হার্ড কপি ২০২৫ এ পাবো তবে সফট কপি এক মাসের মধ্যে এসএমএস করে পাঠানো হবে।
এতো দৌড়াদৌড়ির মাঝেও রাজশাহী শহরের উন্নতি চোখ এড়ায়নি। ঢেলে সাজানো হয়েছে রাজশাহী শহর আর পদ্মার পাড়। ছোট বেলায় সন্ধ্যার পরে ঘুটঘুটে অন্ধকারে ভুতুড়ে লাগতো শহরটাকে। এখন সন্ধ্যার পরে আলোয় ঝলমল করে শহরের রাস্তা। রাস্তার ধারে রাজশাহীর বিখ্যাত কলাইয়ের রুটির দোকানীরা অবসর-হীন। এত মজার গরম গরম রুটি, আগে কখনো খাইনি। যারা এখনো যাননি রাজশাহী, যেতে পারেন হতাশ হবেন না।
 আমাকে অবাক করে দিয়ে পাঁচ দিনের মাথায় সফট কপি এসে গেল! সব কষ্ট এক মুহূর্তে উধাও হোল। কবিগুরুর বাণী মনে এল - যা পাইনি তাও থাক, যা পেয়েছি তাও তুচ্ছ বলে যা চাইনি তাই মোরে দাও...
ভোটার আইডি হাতে পেয়ে ফুরফুরে মেজাজে মনে হলো এবার ঢাকার বিদেশি ট্রেনে ভ্রমণ করে আসি। আমি ইউটিউব ভিডিও তে অনেক অভিযোগ আর অনিয়মের কথা শুনেছি কিন্তু - “আমার চোখে তো সকলই শোভন, সকলই নবীন, সকলই বিমল” লেগেছে।
আমি আগারগাঁও তে ছিলাম আর আগারগাঁওতেই স্টেশন তাই সকালে বেরিয়ে পড়লাম। দেখলাম এখন আর আগারগাঁও আগের মতো নেই। বিএনপি বস্তি উধাও! সেখানে বড়বড় অফিস বিল্ডিং আর চওড়া রাস্তা। খুবই ভালো লাগলো এই উন্নয়ন। স্টেশনে গিয়ে শুনলাম এই ট্রেন প্রতি দিন সকাল আটটা থেকে দুপুর বারোটা পর্যন্ত দশ মিনিট পরপর চলাচল করে। স্টেশন দেখেই আমি মুগ্ধ! কি সুন্দর এস্কেলেটর, লিফট! চারিদিক ঝকঝকে পরিষ্কার। আমি ৬০ টাকা দিয়ে শেষ স্টেশন উত্তরার টিকেট কিনলাম অটোমেটিক বুথ থেকে। কোন ঝামেলা ছাড়াই ভাংতি টাকা মেশিন থেকে বেরিয়ে এলো। এর পরে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা। সিডনির মতোই যাত্রীদের সুবিধার্থে বার বার ঘোষণা দিচ্ছিল সহজ সরল ভাবে। যাত্রীরা কোথায় দাঁড়াবেন, কোন ট্রেন কোথায় যাচ্ছে। মানুষের মধ্যেও পরিবর্তন দেখলাম, ধাক্কা ধাক্কি নাই। ট্রেন এসেও গেল সময় মতন। আমি উঠে পড়লাম। বসার সীটগুলো মেটালের কড়া হলুদ রঙের। ট্রেন ছেড়ে দিল, হঠাৎ একটি ইউনিফর্ম পরা ছেলে খুব সুন্দর করে এক পুরুষ যাত্রীকে বললেন ভাইয়া এই কেবিনটা কেবলমাত্র মহিলা আর শিশুদের জন্য। কোনো কথা না বাড়িয়ে উনি অন্য কেবিনে চলে গেলেন, ভালো লাগলো! সিডনির মেট্রো-রেল এর যেমন একটি লম্বা কম্পার্টমেন্ট, এখানে দরজা দিয়ে আলাদা করা। পনের মিনিটের ভেতর পৌঁছে গেলাম উত্তরায়, অলৌকিক ব্যাপার যেন! আগারগাঁও থেকে আমি গাড়ি, উবার, বাস যে কোন মাধ্যমেই আসি না কেন ৩/৪ ঘণ্টার কমে আসার কথা চিন্তাই করা যায় না। উবার ভাড়া ১৫০০ উঠত, কি আরও বেশি। আমি আগারগাঁও থেকে বাংলা একাডেমীর বই মেলাতে ৪৫০ টাকায় গিয়েছিলাম। ট্রেনে কয়েকজনের সাথে কথাও বললাম, তাদের খুশি দেখে আমারও অনেক অনেক ভালো লাগলো। তবে খুব একটা ভিড় ছিল না সেদিন। শুনে আসলাম স্টেশনের সংখ্যা ও চলাচলের সময়-সীমা আরও বাড়বে। আগামী ২৬ শে মার্চ থেকে রাত ১২ টা অব্দি চলবে এই ট্রেন। আমিও আশাবাদী হলাম বাংলাদেশের ভেতরে এই বিদেশি ট্রেন দেখে। এই ট্রেন কে বাস্তবরূপ দিতে যারা কাজ করেছেন সংশ্লিষ্ট সবাই কে মনে মনে অনেক ধন্যবাদ দিয়ে বাড়ি ফিরে আসলাম।
 মমতাজ রহমান চম্পা, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া
|