জীবন যখন শুকায়ে যায়! মমতাজ রহমান চম্পা
আমি ২০২০ এর মার্চ এর সাথে ১৯৭১ এর মার্চ মাসের কোথায় যেন একটা মিল খুঁজে পাচ্ছি। এখন বাইরে বের হলেই দেখি সবাই কেমন ভীত সংকুচিত হয়ে আছে। কারো মুখে হাসি নেই যেভাবে আমরা থাকতাম ৭১ এ! প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো যত তাড়াতাড়ি কিনে বাড়ি ফিরে যাচ্ছে মানুষ। চোখের নিমেষে দোকানের শেল্ফ খালি হয়ে যাচ্ছে। চাহিদার চেয়ে যোগান কম। তবে ৭১ এর সাথে বড় যে অমিল তা হলো নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম একটুও কিন্তু বাড়েনি আর সে যুদ্ধটা ছিলো কেবল বাংলাদেশীদের একার যুদ্ধ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কিন্ত আজকের এই যুদ্ধ সারা পৃথিবীর এক অদৃশ্য ভাইরাসের বিরুদ্ধে। কেউ জানে না আক্রমণটা কখন কোথায় কিভাবে আসবে।
রোগটা ধরা পড়ার পরে কয়দিন হাতে সময় পাওয়া যাবে তাও বলা যাচ্ছে না। আমি তো ভেবে পাচ্ছি না যদি আমাকে এই ভাইরাস ধরে আমি কিভাবে সামাল দেব! সময় পাব তো সব গুছিয়ে উঠতে, আমার ছেলে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিতে পারবে তো আমার কিছু হয়ে গেলে! স্কুল খোলা থাকলেও, ওকে স্কুলে পাঠানো বন্ধ করেছি। প্রাইভেট পড়াতেও পাঠাচ্ছি না। কিন্তু আমাকে তো কাজে যেতেই হবে। সরকারি হুকুম মতো, বাসায় বসে কাজ করার বিলাসিতা আমাদের নাই তাই পরিবর্তনগুলো নিজের চোখেই দেখছি।
এই ভাইরাসের নাম জানুয়ারি মাসে যখন প্রথম শুনলাম তক্ষণ আমি বাংলাদেশে যাচ্ছি। শুনলাম চীনে দেখা দিয়েছে এই ভাইরাস তাই তেমন গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন মনে করিনি। তাও কয়েকটা মাস্ক আর হান্ড-সানিটাইজার সাথে নিয়েছিলাম হংকং হয়ে যাচ্ছিলাম বলে। দেশে থাকতেই এই ভাইরাসের আগ্রাসনের খবর দেখি টিভিতে আর ভয় বাড়তে থাকে। একটা অশান্তি নিয়ে ফিরলাম। দেখলাম এয়ারপোর্টে, প্লেনে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে। দিন দিন এই ভাইরাসের সংক্রমণ দ্রুত বেড়েই চলেছে।
আমার কাজের জায়গা একটা বেশ বড় এবং জমজমাট শপিং সেন্টারে। এই শপিং মলের উল্টো দিকেই ম্যাককোয়েরি ইউনিভার্সিটি। ইউনিভার্সিটির সব ছাত্র-ছাত্রী তে গমগম করে মলটা। সেটা সকাল দুপুর বা সন্ধ্যা যখনই হোক। হঠাৎ শুনলাম ইউনিভার্সিটি বন্ধ কারণ করোনা ছোবল মেরেছে। বিশ বছরের পুরনো আমার প্রিয় জায়গাটা এখন আমারই কষ্ট হচ্ছে চিনতে। কয়েক দিনের ব্যবধানে কেমনে যেন ম্রিয়মাণ, প্রাণহীন হয়ে গেছে সব। খাবার দোকানে বসার চেয়ারগুলো উধাও। বেশিভাগই বন্ধ। সবার মুখে হাসি শুকিয়ে গিয়েছে। ভাইরাস সংক্রমণ এর চেয়ে চাকরি চলে যাওয়ার ভয়টাই এখন বেশি। সেন্টার লিংকের লাইনটা দেখলেই অনুমান করা যায়। আমার আসা-যাওয়ার পথে ফারনুসের পোশাক অল্টারেসনের দোকান। তাকে হঠাৎ অসময়ে দোকান বন্ধ করে ট্রলি ভর্তি জিনিসের উপর একটা সেলাই মেশিনে নিয়ে যেতে দেখে জানতে চাইলাম কাজ শেষ? মুখে করুণ একটা হাসি দিয়ে বললো শপ বন্ধ করে বাড়ি চলে যাচ্ছি। আরও জানাল গত সপ্তাহে ৩ টা সেলাই মেশিন কিনেছে। এখন কি হবে?
গতকাল লাঞ্চে উইলিয়ামসে গিয়েছিলাম। জুতোর দোকান। একটা সু সাইনার দরকার ছিল। ১২ ডলার দিলাম দোকানের ছেলেটাকে; সে আমাকে অনেক ধন্যবাদ দিয়ে বললো তুমি আজ আমার প্রথম ক্রেতা। সকাল ৯ টা থেকে বেলা দেড়টা পর্যন্ত কোন সেল হয়নি। মনটা সত্যি খারাপ হলো যখন সে বললো চাকরি থাকে কিনা সন্দেহ। কথা টা সত্যি; মানুষের জীবন নিয়ে যখন টানাটানি তখন জুতা কিনবে কে? আজ দেখলাম উইলিয়ামস বন্ধ। ২০ বছর এখানে কাজ করছি, পুরো শপিং মলের সবাই মোটামুটি পরিচিত, অনেকটা পরিবারের মতই। সব রাতারাতি তছনছ হয়ে যাচ্ছে। ভাবতেই চোখের পানি আটকাতে পারি না। চাকরি চলে যাওয়ার কষ্ট কি তা আমি জানি!
যে সব দোকান খোলা তারা সরকারি বিধি পালনে সক্রিয়। সার্ভিস নিউ সাউথ ওয়েলস, বিভিন্ন ব্যাঙ্ক, উলওয়ার্থস, কোলস মেঝেতে ফিতা দিয়ে দাগ দিয়ে রেখেছে। গ্রাহক যেন একে অপরের থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখে। বড় বড় নোটিস ঝুলছে।
অফিসে আসা যাওয়া করার সময়ও অনেক পরিবর্তন চোখ পড়ে। রাস্তায় আগের মত ট্রাফিক নেই। মেট্রো রেলের পার্কিং যেন গড়ের মাঠ। আজ মেট্রো স্টেশনে আমি আর একটা শালিক পাখি ছিলাম। বাচ্চাদের একটা ছড়া মনে পড়লোঃOne for sorrow Two for joy. মানতে পারছি না কিছুতেই। গত সপ্তাহটাও তো কতো আনন্দে ভরা ছিল। বিশ্ববীণা’র বুশ ফায়ার ভিক্টিম দের সাহায্যার্থে আয়োজিত অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। প্রথমে যে একটু অস্বস্তি হয়নি তা নয়, তবে ভয় পেয়ে না গেলে সত্যি খুব মিস হয়ে যেত। প্রাণ ভরে গান শুনলাম আর সাথে ঠাকুর বাড়ির রেসিপিতে রবি ঠাকুরের পছন্দের রকমারি খাবার দিয়ে লাঞ্চ। আহা! মনে হলো যেন শান্তিনিকেতন থেকে ঘুরে এলাম। একটা ফুর ফুরে মেজাজে বাড়ি ফিরলাম, ধন্যবাদ পুরটাই বিশ্ববীণা আর নীলাঞ্জনার প্রাপ্য। এত মানসিক চাপের মধ্যে একটু দখিনা হাওয়ার পরশ বয়ে আনার জন্য। মনে থাকবে অনেক দিন।
জানিনা কবে এই মুক্তি সংগ্রাম শেষ হবে!
মমতাজ রহমান চম্পা, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া
|