বিক্ষিপ্ত ভাবনা মমতাজ রহমান চম্পা
আমার মনে হয় আমি খুব ভাল দর্শক এবং শ্রোতা। আমার সব দেখতে ভাল লাগে - মানুষ, আকাশ, পাখি, গাছ, ফুল, দিবা স্বপ্ন, সব। ছোট বেলায় সবাই স্কুলে যখন খেলত আমি ওঁদের সাথে না খেলে মুগ্ধ হয়ে ওদের খেলা দেখতাম। গানের ক্লাসে গান না করে সহপাঠীদের গান গাওয়া দেখতাম। এখনও আমার এই অভ্যাস রয়ে গিয়েছ। যখন আমাদের গানের মহড়া চলে বা মঞ্চে গান করি অন্যরা এত ভাল গায় তাই দেখে নিজের গান করার কথা মনেই থাকে না। পরে খেয়াল করি সবাই গাইছে আর আমি ওদের গান শুনছি।
এই বেহুঁশ হয়ে দেখা বা শোনার খেসারত দি মাঝে মাঝে। এইতো সেদিন অফিস থেকে ফেরার সময় বাসে উঠে কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে গান শুনছি আর রাস্তার গাড়ি, মানুষ আর আকাশ দেখছিলাম। আকাশ অন্ধকার করে ঝড় আসব আসব করছে। একটু ঝিমুনি এসেছিল হয়তো হঠাৎ খুব জোরে শিলা বৃষ্টি শুরু হল। খুব জোরে শব্দ হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল বাসের ছাঁদ ভেঙ্গে পড়বে মাথায়। বৃষ্টি আমার খুবই পছন্দের বিষয় সাথে রবীন্দ্র সঙ্গীত হলে তো কথাই নেই! কিন্তু এই বৃষ্টি ছিল ভয়ঙ্কর। বন্ধুকের গুলির মত হাজার হাজার শিলা পড়ছে। গাছের বড় বড় ডাল ভেঙ্গে পড়েছে রাস্তায় আর ঘাসগুলো আর দেখাই যাচ্ছে না, সব সাদা! আমার বাস গ্লেনউড এ এসে পড়েছে। বাস মোটামুটি খালি একটু পরে আমাকে নামতে হবে হঠাৎ খেয়াল হল আজ আমি গাড়ি সেভেন হিলস এ রেখেছি গ্লেনউডে না! সর্বনাশ! সকালে তাড়াহুড়া করে ছাতাটাও আনা হয়নি! শিলা বৃষ্টির তোড় একটুও কমেনি কিন্তু আমার স্টপ এসে গেছে। কি করবো না বুঝেই বাস থেকে নামতে যাচ্ছি হঠাৎ বাস ড্রাইভার তার নতুন ছাতাটা কভার খুলে আমার দিকে বাড়িয়ে দিল। আমি বললাম আমি এটা নিলে তোমার চলবে কি ভাবে? সে উত্তর দিল আমার চেয়ে এখন ছাতাটা তোমার দরকার বেশী। আমি যখন রান শেষ করব তখন হয়ত আর বৃষ্টি থাকবে না।
আরেক দিনের কথা মনে পড়ছে সেদিনও বৃষ্টি ছিল আর আমিও দিবা স্বপ্নে মগ্ন ছিলাম বাস যে কখন সেভেন হিলস ছেড়ে ব্ল্যাকটাউন এর রাস্তা ধরেছে খেয়াল করিনি। কি আর করা - বাস যখন থামল আমি চালককে বললাম আমাকে সেভেন হিলস এর একটা টিকেট দাও। সে বলল আমি এখন বাস ডিপোতে যাচ্ছি এই বাস আর যাবে না। আমাকে চিন্তিত দেখে সে বলল বাস ডিপও সেভেন হিলের দিকে আমি তোমকে কাছে কোথাও নামিয়ে দিতে পারি। আমি রাজি হলাম কিন্তু সে আমাকে রাস্তায় না নামিয়ে সেভেন হিলস ষ্টেশনেই নামিয়েছিল। তার মহানুভবতায় আমি মুগ্ধ!
এসব সময় বাংলাদেশের কথা মনে হয় আর মনটা বিষণ্ণ হয়ে যায়। যে দেশে বাস চালক বেপরোয়া ভাবে গাড়ি চালিয়ে চলে যায় মানুষের উপর দিয়ে। বাসের চালকরা মহিলা যাত্রীদের একা পেলে তাদের শ্লীলতা হানি করে বাস থেকে কলার খোসার মতন ছুড়ে ফেলে দেবার ঘটনাও ঘটছে অহরহ কিন্তু এদের কোন শাস্তির খবর চোখে পড়ে না কখনো। তাই দিনের পর দিন বেড়েই চলছে এই ধরনের ঘটনা। যার প্রতিবাদে রাস্তায় নামতে বাধ্য হয়েছে আমাদের কোমলমতি স্কুল কলেজের বাচ্চারা! এই বাচ্চারা পৃথিবীতে ভাল ভাবে বেঁচে থাকতে চায় তাই আজ তারা পথে! আমার আম্মা তো আন্দোলন করতে পারেন না তাই খবরের কাগজ পড়া আর টেলিভিশন দেখাই বন্ধ করে দিয়েছেন। বেপরোয়া বাস আব্রার এর মাথাটা পিষে দিয়ে চলে গেল তার বাবার চোখের সামনে। কি মর্মান্তিক! ভাবলেও গা শিউড়ে উঠে! আজ প্রথম আলোয় পড়লাম বাসটা আসলে চালাচ্ছিল সহকারী, কারণ হল বাস চালক তার আগে আরেকটি স্কুলের মেয়েকে চাপা দিয়ে পালিয়ে যায় তাই তার সহকারী জোরে বাস নিয়ে পালাতে গিয়ে আব্রারকে চাপা দেয়। “অদ্ভুত উটের পীঠে চলেছে স্বদেশ” কথাটা অক্ষরে অক্ষরে সত্যি। আব্রার এর দুর্ঘটনার খবরের দু’দিন পরেই দেখলাম সিলেটে আরেকটি ছেলেকে বাস থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে হত্যা করেছে আরেক বাসের সহকারী!
বাস ড্রাইভাররা কেমন বন্ধু হয় তা হনলুলু তে গিয়ে দেখলাম। আমরা কিছু চিনি না কোথায় নামতে হবে, কোন বাস নিলে ভাল হবে সবই আমরা জেনেছি বাস ড্রাইভারদের কাছ থেকে! কয়েক বার ট্যাক্সি তে যাতায়াত করে বুঝলাম খরচ অনেক বেশী তাই ঠিক করলাম বাসেই ঘুরব। তাদের যাত্রী-সেবা অসাধারণ। একদিন বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলাম দেখলাম হুইল চেয়ারে বসা এক যাত্রী অনেক বাজার নিয়ে বাসের জন্য অপেক্ষা করছে। তার বাস আসার পর ড্রাইভার নীচে নেমে এসে তাকে বাজার-সদাই সহ বাসে উঠতে সাহায্য করল। আমি বলছি না এসব দেশে দুর্ঘটনা ঘটে না তবে তা দুর্ঘটনাই আমাদের দেশের মত তা নিয়মে পরিণত হয় নি। এখানে প্রাণ খড়-কুটোর মত রাস্তায় ঝড়ে পড়ে না। এখানে অপরাধীর বিচার হয়।
এক জরীপে দেখা গেছে বাংলাদেশে তরুণরাই সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয় বেশী। শতকরা ১২ .৫০ ভাগ। কারণ হিসাবে বলা হয়েছে চালকদের বেপরোয়া মনোভাব আর অতিরিক্ত গতি। নিরাপদ সড়কের জন্য ছাত্র-ছাত্রীদের আন্দোলন এই মৃত্যু হার কমাতে পারছে না। বাচ্চারা তাহলে কি করবে? দিনের পর দিন বাসের চাকায় পিষ্ট হতেই থাকবে? আমার মত প্রতিটা মা ই চায় তার বাচ্চারা দিন শেষে নিরাপদে ঘরে ফিরে আসুক। তাদের নিরাপত্তা বিধান করবে কে!
মমতাজ রহমান চম্পা, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া
|